একটি জাতির ডুবে যাওয়ার গল্প by সাজেদুল হক
আন্দোলন নেই। সহিংসতা নেই। তবুও ভাল নেই
বাংলাদেশ। মৃত্যুর মিছিল চলছে এখানে-সেখানে। আশার দেশে হতাশার রাজত্ব। একটি
ডুবন্ত লঞ্চ। যেন একটি জাতি-রাষ্ট্রের ব্যর্থতারই গল্প। পাঁচ দিন পেরিয়ে
গেল। অথচ পদ্মায় ডুবে যাওয়া পিনাকের খোঁজ আর মিললো না। এ তো শুধু একটি
লঞ্চের ডুবে যাওয়া নয়। তখন মানুষের মধ্যে জীবিত ফিরতে পেরেছেন সামান্যই।
মৃত ফেরা মানুষের সংখ্যাও কম। এক আশ্চর্য ব্যর্থতায় ডুবে গেছে কত মানুষের
স্বপ্ন, ভালবাসা। মুহূর্তে হারিয়ে গেছে কত সন্তান। মায়ের কাছে আর কোন দিনই
ফিরবেন না তারা। এক পিতা বর্ণনা করছিলেন কিভাবে তার দুই সন্তান হাত থেকে
ছুটে গেল। এই দুঃখ, এই যন্ত্রণার বর্ণনা দেয়ার ভাষা নেই। সদ্যবিবাহিত
স্ত্রী ঘাটে অপেক্ষা করছিলেন স্বামীর জন্য। চোখের সীমানার মধ্যে আসা লঞ্চ
আর ঘাটে ভিড়লো না। এ যন্ত্রণা সারা জীবনই বয়ে বেড়াতে হবে তাকে। লঞ্চ ডুবিতে
মৃত মানুষের লাশ ওঠাতে রাষ্ট্রের অবহেলার অভিযোগ আগেও উঠেছে। চার দশকে
লঞ্চ ডুবিতে নিহত ১০ হাজারের বেশি মানুষের অনেকের লাশই পাওয়া যায়নি। তবে
লঞ্চেরও খোঁজ না পাওয়ার ঘটনা অভাবনীয়। লাশ নয় এবার যেন হারিয়ে গেল লঞ্চও।
নানা উদ্ধার জাহাজ চেষ্টা করছে। কিন্তু কোথায় আছে লঞ্চটি তা-ও জানা যায়নি
এখনও। পদ্মার পাড়ে অপেক্ষা করা স্বজনদের আর্তনাদ হৃদয় ছোঁয়া। অতীতে প্রতিটি
লাশের জন্য ছাগল অথবা ২০ হাজার টাকা দিতে আমরা দেখেছি। লাশ খুঁজে না
পাওয়ায় হয়তো বা রাষ্ট্রের অর্থ সংকুলান হবে। এক স্বজনের আকুতি মর্মস্পর্শ-
প্রয়োজন হলে আমরা টাকা দেবো। তবুও আমাদের লাশ দেয়া হোক। এই যন্ত্রণার গল্প
অবশ্য বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। মৃত বিবেকের দেশে এতে কেউ অবাকও হন না। যেন
ডুবে মরার জন্য অথবা সড়কে চালকের খামখেয়ালিতে খুন হওয়ার জন্যই জন্ম হয়েছে
আমাদের। পিনাকের ডুবে যাওয়ার ক’দিন আগেই নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান
দাবি করেছিলেন, বিএনপির আমল থেকে আওয়ামী লীগ আমলে নৌ-দুর্ঘটনায় কম মানুষ
মরেছেন। ওই উক্তি প্রমাণ করে রাজনীতি কত জঘন্য। লঞ্চ ডুবিতে মৃত্যু নিয়েও
প্রতিযোগিতা। অথচ এই সব তো দুর্ঘটনা নয়। এক ধরনের সিস্টেমেটিক হত্যা।
পিনাকের কথাই ধরুন না। ধারণ ক্ষমতার দুই গুণের বেশি যাত্রী নিয়ে এ লঞ্চের
চলাচলে বাধা দেয়ার মতো কেউ বাংলাদেশে ছিল না। একই ধরনের খামখেয়ালি আর
অব্যবস্থাপনায় গত কয় দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় এক শ’র বেশি মানুষ প্রাণ
হারিয়েছেন। বাংলাদেশে সাধারণত ক্ষমতাহারা অথবা ক্ষমতাহীনদের মধ্যেই বিবেক
কাজ করে। যাদের আহ্বানে কিছু যায় আসে না। সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের
উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যেমন পিনাক উদ্ধার না হওয়াকে চরম
ব্যর্থতা হিসেবেই অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, পিনাক-৬ ডুবে যাওয়া অত্যন্ত
মর্মান্তিক। ডুবে যাওয়া লঞ্চের লাশগুলো বিকৃত হয়ে গেছে। তারপরও পদ্মার
পাড়ে এখন লাশের জন্য হাহাকার। এত অগ্রসর যুগেও লঞ্চ খুঁজে না পাওয়া চরম
ব্যর্থতা। যারা লঞ্চ ডোবার জন্য দায়ী, তাদের নামে মেরিটাইম কোর্র্টে অনেক
মামলা রয়েছে। কিন্তু এর একটারও বিচার হয়নি। লঞ্চ ডুববে আর মালিকেরা দায়ী
হবে না- এটা হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই এ ধরনের লঞ্চডুবির
ঘটনা চিরতরে বন্ধ হবে বলেও মন্তব্য করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আর সব কিছুর
মতো লঞ্চ দুর্ঘটনা বন্ধেও প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেন কিনা তাই এখন দেখার
বিষয়। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক তার এক লেখায় কয়দিন আগেই কোরিয়ায় ফেরি
দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর পর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা উল্লেখ
করেন। যে স্কুলের শিশুরা মারা গেছে তার দায়িত্বে থাকা সহকারী হেডমাস্টার
আত্মহত্যা করেন। সুপার মার্কেটের ছাদ ধসে পড়ার ঘটনায় পদত্যাগ করেছিলেন
লাটভিয়ার প্রধানমন্ত্রী। না, বাংলাদেশে কেউ পদত্যাগ করেননি। বাংলাদেশে কেউ
আত্মহত্যা করেননি। বাংলাদেশে এক মন্ত্রী বলেছিলেন, আমি পদত্যাগ করলে যদি আর
লঞ্চ না ডোবে তাহলে আমি পদত্যাগ করবো। সড়কে মৃত্যুর মিছিলের প্রতিবাদে যখন
সরব হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ তখন এক মন্ত্রী বলেছিলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স
পাওয়ার জন্য গরু, ছাগল চেনাই যথেষ্ট। না, বাংলাদেশে শত মৃত্যুতেও কারও টনক
নড়ে না। কেউ পদত্যাগ করেন না, কেউ আত্মহত্যা করেন না। কারণ আমাদের বিবেক
আত্মহত্যা করেছে।
No comments