বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের ৫ কোটি টাকা লোপাট, তদনত্মে ফেঁসে গেছেন পাঁচ কর্মকর্তা- by মিজান চৌধুরী
দুর্নীতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের ৫ কোটি টাকা লুটে নেয়া হয়েছে। প্রশাসনের ৬ কর্মকর্তা যোগসাজশে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রম (এনএনপি) প্রকল্প থেকে ওই টাকা লুটে নেয়।
প্রকৃত মূল্য থেকে ওষুধের বেশি দাম দেখিয়ে ও বিদেশে প্রশিণের নামে ওই টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। ঘটনা বিশ্বব্যাংকের তদনত্মে ধরা পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের প থেকে ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জানিয়ে ওই প্রকল্পে নতুন করে সহায়তা না করার ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া টাকা ফেরত চেয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে এই ঘটনা তদনত্ম করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রমাণ পেয়েছে। ঘটনায় জড়িত দুই জনের বিরম্নদ্ধে সম্প্রতি বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। আরও দুইজনের বিরম্নদ্ধে মামলা দায়ের প্রক্রিয়া চলছে। তবে ছয়জনের মধ্যে অবসরে থাকা দুই কর্মকর্তার বিরম্নদ্ধে পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি এ্যাক্ট অনুযায়ী মামলা করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সংশিস্নষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।ফেঁসে যাওয়া কর্মকর্তারা হলেন, বাংলাদেশ ুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) চেয়ারম্যান ও এনএনপির সাবেক নির্বাহী পরিচালক আশরাফ মুহাম্মদ ইকবাল, স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব ও সাবেক এনএনপির পরিচালক লোকমান হাকিম তালুকদার, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব ও সাবেক এনএনপির পরিচালক শামস উদ্দিন আহমেদ, বিআরটিসির জেনারেল ম্যানেজার ও সাবেক এনএনপির পরিচালক শেখ রজ্জব আলী, সাবেক সচিব ও এনএনপির নির্বাহী পরিচালক কাজী মনোয়ারম্নল হক, এনএনপির সাবেক পরিচালক আজহার আলী তালুকদার।
সূত্র মতে, গত ২০০০ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সকল উপজেলায় জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রম (এনএনপি) প্রকল্পের কাজ শুরম্ন হয়। মা ও শিশুদের পুষ্টির মান উন্নয়নের জন্য কয়েকটি পর্যায়ে এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ বিতরণ করা হয়। প্রকল্পের ৮০ শতাংশ অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই কার্যক্রম চলতে থাকে। এনএনপি প্রকল্পের চুক্তিতে দাতা সংস্থার পূর্বশর্ত জুড়ে দেয় কোন কর্মকর্তা বিদেশে প্রশিণের মাধ্যমে এই প্রকল্পের টাকা খরচ করতে পারবে না। কার্যক্রম পরিচালনার সময় বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওষুধ কেনার শর্ত দেয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদনত্মে দেখা গেছে, বিদেশে প্রশিণের নামে এই প্রকল্পের আড়াই কোটি টাকার খরচ দেখানো হয়। এ ছাড়া বাজার মূল্য থেকে বেশি দামে ওষুধ কিনে প্রায় আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদনত্মমতে, ২০০৪ সালের মে মাসে এই কর্মসূচীর আওতায় ৪৭ লাখ পিস কৃমিনাশক ওষুধ কেনা হয়। সরকারের ক্রয়নীতি অমান্য করে ওষুধ কোম্পানি এসকে+এফ থেকে ওই ওষুধ বাড়তি দামে কেনা হয়। বাজারে ওইসময় একটি কৃমিনাশক ওষুধের মূল্য ২.৮৭ টাকা হলেও এনএনপির জন্য প্রতিপিস কেনা হয় ৩.৪০ টাকা দরে। এ খাতে প্রায় ৪২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। একই বছর এলকো থেকে একই ওষুধ এক লাখ পাতা কেনা হয়। প্রতিপিস বাজার মূল্য ওই সময়ে ২.৮৭ টাকা হলেও কেনা হয়েছে ৩.৭৫ টাকা দরে। এ খাতে লুটে নেয়া হয় ৬০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ওই বছর বিভিন্ন সময়ে ভিটামিন ও শিশুদের ক্যাপসুল বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে কেনা হয়। ফলে এনএনপি প্রকল্পে ওষুধ খাতে লুটপাট হয় আড়াই কোটি টাকা।
এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের দেয়া শর্ত ভেঙ্গে ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি এই প্রকল্পের টাকায় অস্ট্রেলিয়ায় ৫ কর্মকর্তাকে আট দিনের জন্য প্রশিণে পাঠানো হয়। এতে খরচ দেখানো হয় ৪০ লাখ ৮৫ হাজার ২১৫ টাকা। একই বছর মে মাসে ফিলিপিন্স ও অস্ট্রেলিয়াতে ২৩ কর্মকর্তাকে প্রশিণের জন্য পাঠনো হয়। এতে খরচ দেখানো হয় ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। জুন ও নবেম্বর মাসে সাত দিনের জন্য ১০ কর্মকর্তাকে প্রশিণের জন্য চীন ও থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়। সেখানে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ দেখানো হয়। এ ছাড়া এনএনপির পরিচালক লোকমান হাকিম তালুকদার, আজহার আলী ও শামস উদ্দিন আহমেদ বিদেশে প্রশিণের নামে অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও চীন সফর করেন। তদনত্মে উলেস্নখ করা হয় এনএনপি প্রকল্পের কর্মকর্তারা বিদেশে প্রশিণের অনুমতি দিয়ে দাতা সংস্থার দেয়া শর্ত ভঙ্গ করেছে। একইভাবে বিদেশে প্রশিণের নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ঘটনাটি বিশ্বব্যাংক তদনত্ম করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অবহিত করে। এই প্রকল্প শেষ হয় ২০০৯ সালে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে পুরো ঘটনাটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদনত্মে ঘটনাটি প্রমাণের পর সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব ও এনএনপির সাবেক পরিচালক লোকমান হাকিম তালুকদার এবং বিআরটিসির জেনারেল ম্যানেজার ও সাবেক এনএনপির পরিচালক শেখ রজ্জব আলীর বিরম্নদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিসিকের চেয়ারম্যান ও সাবেক এনএনপির নির্বাহী পরিচালক আশরাফ মুহাম্মদ ইকবালের বিরম্নদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের প্রক্রিয়া চলছে। অবসরে চলে যাওয়া অপর দুই কর্মকর্তা সাবেক সচিব ও এনএনপির নির্বাহী পরিচালক কাজী মনোয়ারম্নল হক এবং এনএনপির সাবেক পরিচালক আজহার আলী তালুকদারের বিরম্নদ্ধে পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি এ্যাক্ট অনুযায়ী মামলা দায়ের করার প্রসত্মুতি নেয়া হচ্ছে।
তবে এ ব্যাপারে বিসিকের চেয়ারম্যান আশরাফ মুহাম্মদ ইকবালের মনত্মব্য হচ্ছে তিনি এনএনপি পরিচালনার সময় প্রশিণের জন্য বিদেশে যাননি। বিদেশে প্রশিণের জন্য কোন কর্মকর্তাকে অনুমতি দেননি। এ প্রকল্প চলাকালীন বিদেশে প্রশিণের জন্য একটি কমিটি কাজ করেছে। ওই কমিটি প্রশিণের জন্য বাছাই করে। নির্বাহী হিসেবে তা আমি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় যাঁকে অনুমতি দিয়েছে, তিনিই বিদেশে প্রশিণের জন্য গেছেন। এনএনপির টাকা দিয়ে বিদেশে প্রশিণ করা যাবে না তা আমার জানা ছিল না। ওষুধ কেনার বিষয়টি দেখতেন পরিচালক প্রশাসন। তিনিই ভাল জানেন কোন্ মূল্যে কি ওষুধ ক্রয় করা হয়েছে।
No comments