বাতিলের শর্ত রাখা হয়েছে-যৌথ উদ্যোগের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সই by অরুণ কর্মকার

প্রয়োজনে বাতিলের শর্ত রেখে গতকাল রোববার বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের চুক্তি সই হয়েছে। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি ২০১৬ সালে উৎপাদন শুরু করবে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতার দুই বছরের মাথায় এই চুক্তিটি হলো।


২০১০ সালের ৩০ আগস্ট এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। চুক্তিটি হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
দুই দেশের সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানির (এনপিটিসি) মধ্যে চুক্তিটি সই হয়। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এ দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে এটিই প্রথম যৌথ উদ্যোগের কোনো চুক্তি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও পরিচালনার জন্য একটি যৌথ উদ্যোগের কোম্পানি গঠন করা হবে।
গতকাল দুপুরে বিদ্যুৎ ভবনের বিজয় হলে স্বাক্ষরিত এ চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। তবে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও পিডিবির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভবিষ্যতে যদি দেখা যায় যে প্রকল্পটি আর্থিকভাবে লাভজনক হচ্ছে না, তখন উভয় পক্ষে মতৈক্য হলে এটি বাতিল করা যাবে। চুক্তিতে এমন বিধান রাখা হয়েছে।
চুক্তি সই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ রকম আরও যৌথ উদ্যোগের প্রকল্প করার সুযোগ আছে। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও দৃঢ়তর হতে পারে।
বিদ্যুৎসচিব মো. আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক এ করিম, ভারতের বিদ্যুৎসচিব পি উমা শংকর, এনটিপিসির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরূপ রায় চৌধুরী ও বাংলাদেশে ভারতের উপ-হাইকমিশনার সঞ্জয় ভট্টাচার্যও বক্তব্য দেন।
চুক্তি সই অনুষ্ঠানের পর দুই দেশের বিদ্যুৎসচিব, পিডিবি ও এনটিপিসির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে অংশ নেন।
বড় প্রশ্ন দাম: সংবাদ ব্রিফিংয়ে রামপাল কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম কত হবে জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান তা পাঁচ থেকে সাত টাকার মধ্যে হতে পারে বলে জানান। চেয়ারম্যান বলেন, প্রকৃত দাম নির্ভর করবে কেন্দ্রটির যন্ত্রপাতির দাম, নির্মাণ ঠিকাদারের ব্যয়, ঋণের সুদের হার (ব্যয়ের ৭০ শতাংশ ঋণ থেকে আসবে), কয়লার দাম ইত্যাদির ওপর।
তবে উল্লিখিত সূত্রগুলো জানায়, প্রকল্পের সর্বশেষ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে প্রতি টন কয়লার দাম ১০৫ মার্কিন ডলার ধরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ টাকা ৯০ পয়সা। আর প্রতি টন কয়লার দাম ১৪৫ ডলার ধরে নির্ধারণ করা হয়েছে আট টাকা ৮৫ পয়সা।
গত ডিসেম্বর মাসে দেশি প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের (লংকিং ওরিয়ন যৌথ উদ্যোগ) সঙ্গে মোট এক হাজার ৮৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের যে চুক্তি অনুস্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে বিদ্যুতের দাম পড়ছে অনেক কম।
এর মধ্যে ৫২২ মেগাওয়াটের মাওয়া কেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের দাম পড়ছে চার টাকা সাড়ে নয় পয়সা, খুলনা কেন্দ্রের তিন টাকা ৮৮ পয়সা এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রের তিন টাকা ৭৯ পয়সা। বর্তমানে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বড়পুকুরিয়ায় উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম পড়ছে সাড়ে পাঁচ টাকার মতো।
দাম সম্পর্কে চুক্তি সই অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তীব্র বিদ্যুৎসংকটের মধ্যে আছি। এই অবস্থায় সস্তা বিকল্প দেখার সুযোগ অনেক কম।’
সূত্র জানায়, বিদ্যুতের দামের এই পার্থক্য প্রকল্পটি বাতিলের অন্যতম কারণ হতে পারে।
‘পরিবেশে সমস্যা হবে না’: চুক্তি সই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। তা ছাড়া কেন্দ্রটিতে সর্বাধুনিক (সুপার ক্রিটিক্যাল প্রেসার হাই এফিশিয়েন্ট) যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে। ফলে এই কেন্দ্র থেকে দূষিত গ্যাস নিঃসরণের হার হবে ন্যূনতম। কাজেই পরিবেশের কোনো সমস্যা হবে না।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশসহ সারা বিশ্বে প্রচুর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে এবং নতুন করে হচ্ছে। আমাদের দেশে তেমন নেই। কাজেই পরিবেশের বিষয়টি এখানে মুখ্য বিবেচনার বিষয় হওয়া উচিত নয়।’
বিদ্যুৎকেন্দ্রের নৈকট্যের কারণে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষিত সুন্দরবনের ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদীরা। গত শুক্রবার দেশের ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ঝুঁঁকিপূর্ণ এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা: রামপাল কেন্দ্রের জন্য প্রতিবছর কয়লা লাগবে ৪৫ লাখ টনের মতো। এই বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানির জন্য বন্দরসুবিধার অভাব রয়েছে। জানা গেছে, সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই কেন্দ্রের কয়লা নামানোর জন্য আলাদা জেটি স্থাপন করা হবে। কিন্তু এতেও সব সমস্যা মিটবে না। জেটি পর্যন্ত কয়লার ছোট জাহাজ (লাইটার) আনতেও পানির গভীরতা দরকার ছয় মিটার। কিন্তু মংলায় গভীরতা মাত্র চার মিটার। অবকাঠামোগত এই সমস্যাও প্রকল্পটি বাতিলের অন্যতম কারণ হতে পারে বলে সূত্রের ধারণা।
সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ১১ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে। এ জন্য বছরে কয়লা লাগবে প্রায় আড়াই কোটি টন। ২০৩০ সালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ২০ হাজার মেগাওয়াট।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আমদানি করা কয়লা দিয়ে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অতি উচ্চাভিলাষী এবং অসম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দেশের কয়লা এখন না তুলে তা ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে দেওয়ার’ ঘোষণা দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.