বিশেষজ্ঞদের মত ও গবেষণার তথ্য অগ্রাহ্য-বন্ধ্যাকরণ অস্ত্রোপচারে আবার অ্যান্টিবায়োটিক চালু by শিশির মোড়ল

স্থায়ী বন্ধ্যাকরণের অস্ত্রোপচার ও ইমপ্ল্যান্ট বসানোর ক্ষেত্রে সিপ্রোফ্লোক্সিন অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আবার চালু করেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। এ দুটি সেবাগ্রহীতার প্রত্যেককে প্রতিদিন দুটি করে সাত দিনের জন্য ১৪টি এ ওষুধ বিনা মূল্যে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


বিশেষজ্ঞদের মত ও গবেষণার তথ্য অগ্রাহ্য করে এবং অধিদপ্তরের জাতীয় কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এ ক্ষেত্রে কেনাকাটার সম্পর্ক থাকায় ১০ বছর পর আবার সবার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক চালু করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির বলেছেন, নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের দরকার হয় না। অধিদপ্তর কেন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।
অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, বছরে চার লাখ মানুষকে স্থায়ী বন্ধ্যাকরণের (ভলান্টারি সার্জিক্যাল কন্ট্রাসেপশন-ভিএসসি) জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়। ইমপ্ল্যান্ট পরানো হয় প্রায় দুই লাখ নারীকে। এ হিসাবে অধিদপ্তরকে বছরে ৮৪ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক বড়ি কিনে বিনা মূল্যে সেবাগ্রহীতাদের দিতে হবে। প্রতিটি সিপ্রোফ্লোক্সিনের বর্তমান খুচরা মূল্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানভেদে ১২ থেকে ১৪ টাকা।
অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রাম) এ কে এম মাহবুবুর রহমান গত বছরের ৩০ অক্টোবর স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ অস্ত্রোপচার ও ইমপ্ল্যান্ট পরানোর ক্ষেত্রে সিপ্রোফ্লোক্সিন দেওয়ার এ নির্দেশ দেন। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরপর থেকে সেবাগ্রহীতাদের ১৪টি করে এ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে।
অথচ বিভিন্ন গবেষণা এবং প্রতিবেশী দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ২০০০ সালে অধিদপ্তর অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে অ্যন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ বিষয়ে পরিপত্রও জারি হয়। কেবল ফলোআপের সময় সেলাইয়ের স্থানে সংক্রমণ থাকলে ১০-১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে বলা হয়েছিল। এরপর থেকে জাতীয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ ছিল।
অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, নব্বইয়ের দশকে জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের একটি দল নেপালে গিয়ে জানতে পারে, সেখানে স্থায়ী বন্ধ্যাকরণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় না এবং এতে মানুষের কোনো ক্ষতিও হয় না। এর আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদপুর ক্লিনিকে (বর্তমানে মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার) বন্ধ্যাকরণের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে ২০০ জনের ওপর একটি গবেষণা হয়। এ গবেষণার উপসংহারে বলা হয়, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে জটিলতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। গবেষণা প্রতিবেদনে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
সূত্র আরও জানায়, গত ২৭ জুলাই অধিদপ্তরের জাতীয় কারিগরি কমিটির (এনটিসি) সভায় এ দুটি ক্ষেত্রে আবার অ্যান্টিবায়োটিক চালুর সিদ্ধান্ত হয়। তবে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা নির্ধারণে ছয় সদস্যের কারিগরি কমিটিও করা হয়। সিদ্ধান্ত ছিল, ওই কমিটি মাত্রা নির্ধারণ করে অনুমোদনের জন্য এনটিসির পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করবে। এরপর আর এনটিসির সভা হয়নি। কিন্তু সিপ্রোফ্লোক্সিন আবার চালু হয়েছে।
মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেসের সূত্র জানায়, সেখানে প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন পুরুষ ও একজন নারীকে স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ করানো এবং দুজন নারীকে ইমপ্ল্যান্ট পরানো হয়। তাঁদের ১৪টি করে অ্যান্টিবায়োটিক বড়ি দেওয়া হচ্ছে।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করে কত মানুষ সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে অথবা গত ১০ বছর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করায় কী ক্ষতি হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান অধিদপ্তরে নেই।
বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির সাবেক মহাপরিচালক জহির উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রোপচারের আগে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা জোরদার না করে অ্যান্টিবায়োটিকের দিকে ঝোঁকার সিদ্ধান্ত দুঃখজনক। এ সিদ্ধান্তের কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে বছরে লাখ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক বড়ি লাগবে। এর সঙ্গে দরপত্র ও কেনাকাটার সম্পর্ক আছে। এতে কোটি কোটি টাকা হাতবদল হবে। এর পুরোটাই অপচয়। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন আ ব ম ফারুক বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, আছে কার্যকারিতা হারানোর আশঙ্কা। অধিদপ্তরের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে অর্থ ব্যয়েরও সম্পর্ক আছে। এসব বিবেচনা নিয়ে শুধু যাঁদের দরকার, তাঁদের ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে।
স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ অস্ত্রোপচার ও ইমপ্ল্যান্ট পরানোর ক্ষেত্রে আবার অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের নির্দেশ প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ (আরটিআই) ও যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রমণের (এসটিআই) ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক কেনা আছে। সেগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই সেগুলো স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ ও ইমপ্ল্যান্ট গ্রহীতার ক্ষেত্রে ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.