বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

২৯৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ আবদুল বাসেত, বীর প্রতীক  তুমুল যুদ্ধের বীর শহীদ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আবদুল বাসেত ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকল। একটু একটু করে তাঁরা অগ্রসর হচ্ছেন সামনে। আর পাকিস্তানি সেনারা ক্রমেই পিছে হটছে। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিলেন।


তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা। বিজয় যখন সন্নিকটে এমন সময় হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হলেন আবদুল বাসেত। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তাঁর শরীরের উষ্ণ রক্তে সিক্ত হতে থাকল মাটি। একটু পর নিভে গেল তাঁর জীবনপ্রদীপ। এ ঘটনা কৃষ্ণপুরে। ১৯৭১ সালের ১১ বা ১২ নভেম্বর।
কৃষ্ণপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘কে’ ফোর্সের ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে সীমান্ত এলাকা থেকে কুমিল্লা অভিমুখে অভিযান শুরু করে। ১১ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কৃষ্ণপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হন। তখন তাঁরা (৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি) পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলে ছিলেন আবদুল বাসেত।
১১ ও ১২ নভেম্বর কৃষ্ণপুর ও পার্শ্ববর্তী বগাবাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। দুই দিনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আবদুল বাসেতসহ দুজন শহীদ এবং একজন আহত হন। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এরপর তারা শালদা নদী, কসবা, মন্দভাগ প্রভৃতি এলাকার প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে নভেম্বর মাসের শেষে কুমিল্লা সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়।
কৃষ্ণপুরের যুদ্ধে আবদুল বাসেত অমিত সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। সহযোদ্ধারা পরে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় মুক্তাঞ্চল কসবাতে তাঁর মরদেহ সমাহিত করেন। তাঁর সমাধি সংরক্ষিত।
আবদুল বাসেত ১৯৭১ সালে কৃষিকাজ করতেন। আনসারের প্রশিক্ষণও তাঁর নেওয়া ছিল। আনসার বাহিনীর অনিয়মিত সদস্য ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঘরে না বসে থেকে স্থানীয় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। পরে ভারতে যান। ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তিনটি বিশেষ ফোর্স গঠন করা হয়। এর একটি ছিল ‘কে’ ফোর্স। কে ফোর্সের জন্য তখন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও ২ নম্বর সেক্টরের গণযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। আবদুল বাসেতকেও নবগঠিত এই রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ আবদুল বাসেতকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪৮। আবদুল বাসেতের প্রকৃত নাম আবুল বাশার।
শহীদ আবদুল বাসেতের পৈতৃক বাড়ি ফেনী জেলার সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামে। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম সুলতান আহমেদ। মা মোছা মোস্তফা বেগম।
এলাকায় আবদুল বাসেতের নামে একটি সড়ক আছে। তবে তাঁর পরিবারের সদস্যরা বেশ দরিদ্র। এক ভাই রিকশা আরেক ভাই টেম্পো চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। শহীদ আবদুল বাসেতের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী), জালাল আহমেদ (শহীদ আবদুল বাসেত বীর প্রতীকের ভাই) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.