কারওয়ান নদী ও আম্বর সেতু by সৈয়দ আবুল মকসুদ
সিএ ভবনে প্রথম আলো ও অন্যান্য
প্রতিষ্ঠানের অফিস। ভবনটি যে রাস্তার ওপরে, তার নামকরণ হয়েছে জাতীয় কবির
নামে। একটা নম্বরও বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১০০ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ। সিএ
ভবনের ঠিক প্রবেশপথেই কারওয়ান নদীর ঘাটে নৌকা বাঁধা। বেশ বড় ছান্দি নৌকা।
দুজন মাঝি যাত্রীসহ নৌকাটি নিয়ে পুব দিকে গেল পাণ্ডু নদীর দিকে। পাণ্ডু বেশ
বড় নদী। পাণ্ডু নদী মগবাজারকে করেছে দ্বিখণ্ডিত।
কারওয়ান নদীটি একটি ছোট শাখানদী। বৈশাখ মাসে তাতে হাঁটুপানি থাকলেও জ্যৈষ্ঠে বৃষ্টি শুরু হতেই পানি বাড়তে থাকে। আষাঢ়ে দুই তীর টইটম্বুর। পূর্ণিমা সিনেমা হলের কাছে আন্ডারপাসের ওখানে শ্রাবণ-ভাদ্রে ফোটে প্রচুর শাপলা। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। আশ্বিনের ঝড়ে কোনো কোনো বছর সোনারগাঁও রোডের চৌরাস্তায় ফোয়ারার গোলচক্করে নৌকাডুবিতে মারাও যায় দু-চারজন। একটু দূরেই হাতির ঝিলে সারা বছর যে পানি থইথই করে, তাতে মনে হয় যেন কাস্পিয়ান হ্রদ।
কারওয়ান নদীর পাশেই আম্বর সেতুটি নির্মাণ করেন আম্বর শাহ নামে একজন পুণ্যবান মানুষ। তিনি প্রভাবশালী ও বিত্তবান ছিলেন। কারওয়ান নদীর তীরে এলাকার মানুষের জন্য তিনি নির্মাণ করেন একটি ছোট সুরম্য মসজিদ।
ফ্রেঞ্চগঞ্জ (ফরাশগঞ্জ) থেকে নৌকায় চান খাঁ সাহেবের পুল হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসীমউদ্দীন ও জিয়াউর রহমান হলের ওপর দিয়ে পরীবাগ হয়ে অনেকে কারওয়ান নদীর তীরে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে আসেন। কারওয়ান নদী থেকে যে খালটি চলে গেছে দোলাই নদীতে (বহু পরে যার নাম হয় ধোলাই খাল), তার পানি অতি স্বচ্ছ। মাছের সাঁতার কাটা দেখা যায় নৌকায় বসে ও পাড় থেকে।
এতক্ষণ আমি যা লিখলাম তা পড়ে মাথামুণ্ডু কেউ যে কিছু বুঝতে পারবেন, তা মনে হয় না। আমার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে বলে কেউ মনে করলেও তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। বহু বছর ধরে কেউ কলাম লিখলে তার মাথা-মগজে বিশেষ কিছু থাকে না। হয় গালগল্প লেখেন, নয়তো গালাগাল, অথবা আবোলতাবোল সব কথা। কারওয়ান বাজার এলাকায় যানজট ও গাড়ির ভিড়ে এখন অনেকেরই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ওখানে নৌকা কোথায়? আন্ডারপাসের ওখানে শাপলা কোথায়? কারওয়ান নদীটি কোথায়? আম্বর শাহ সেতুটি কোথায়? পাণ্ডু নদীর অস্তিত্ব নেই। ভরাট কারওয়ান নদীর ওপর গড়ে উঠেছে বিরাট বাজার। তার নাম এখন কারওয়ান বাজার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় কারওয়ান নদীর যে জায়গায় মাছ সাঁতার কাটত, জেলেরা ভেসাল ফেলে মাছ ধরতেন, এখন সেখানে মাছ ব্যবসায়ীর ডালায় মরা মাছের ওপর মাছি ভনভন করে।
আমি পলাশীর যুদ্ধের সময়ের মানুষ নই। সিপাহি বিদ্রোহটাও দেখিনি ১৮৫৭-তে। সুতরাং আঠারো ও উনিশ শতকের কারওয়ান বাজার, চান খাঁর পুল বা দোলাই নদীর অবস্থা জানলাম কীভাবে? ভাষা আন্দোলন ও একাত্তর নিয়ে স্মৃতিচারণা করে যা খুশি তাই লিখলেও নতুন প্রজন্মের মানুষ তা বিশ্বাস করতে বাধ্য। কিন্তু আঠারো ও উনিশ শতকের ঢাকা নিয়ে কাহিনি ফাঁদলে লোকে বলবে গাঁজাখোর। আমি যে জায়গার নদী ও জলাশয়ের কথা বললাম, তা আমার কথা নয়, সেকালের প্রত্যক্ষদর্শী লেখকদের রচিত বইপত্রের কথা। ১০০ বছর আগে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত রেভিনিউ হিস্ট্রি অব বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য ফিফ্থ রিপোর্ট (১৯১৭) এবং ফাইনাল রিপোর্ট অব দ্য সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অব ঢাকা প্রভৃতি বইপত্রে ঢাকার ভেতরের ও আশপাশের নদ-নদী ও খাল-ঝিলের কথা লেখা আছে।
দুজন ঢাকা-বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হয়েছিল আমার। তার একজন প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ আহমদ হাসান দানী এবং আর একজন আজিমুশ্শান হায়দার। ড. দানীর মতো পণ্ডিত ও ভালো মানুষ আমি জীবনে জনা পাঁচেকের বেশি দেখিনি। তাঁর লেখার বাইরে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তায় ঢাকা সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানতে পারি। তা ছাড়া আর একজন ঢাকা-বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদ হাকিম হাবিবুর রহমানের লেখা বই ও কাগজপত্র দেখারও সুযোগ হয়। তাঁর উর্দু লেখার পাঠোদ্ধার করতে আমাকে সাহায্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু-ফারসি বিভাগের অধ্যাপক প্রয়াত ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ। ঢাকার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে হলে শুধু ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের ওপর নির্ভর করা যাবে না। উর্দু ও ফারসি লেখার সাহায্য নিতে হবে। আমার দুর্ভাগ্য, ওই বিদ্যায় আমি নিরক্ষর।
ভাদ্র বা আশ্বিনের জোছনা রাত। আকাশ পরিষ্কার। নবাব আবদুল গণি এবং তাঁর পুত্র নবাব বাহাদুর খাজা আহসানুল্লাহ তাঁদের বেগমদের নিয়ে (দুই নবাবের বেগম পাঁচ-ছয়জনের কম নয়) অবস্থান করছেন তাঁদের দিলকুশার বাগানবাড়ির প্রাসাদে। সন্ধ্যায় তাঁরা ছাদে পায়চারি করছেন। ডানে-বামে উদ্যানে বড় বড় বৃক্ষ। দক্ষিণ-পূর্ব দিক শীতলক্ষ্যা পর্যন্ত আদিগন্ত খোলা। ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে রংবেরঙের পালের নৌকা নদীতে। নদীর শীতল হাওয়া নবাব পরিবারের সদস্যদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। নৌকাগুলো যাচ্ছে মতিঝিল ওয়াপদা অফিসের পেছন দিক দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের কাছে কমলাপুর।
নবাব আবদুল গণি ও নবাব আহসানুল্লাহ যে ভবনের ছাদ থেকে মতিঝিলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীতে নৌকার যাতায়াত দেখতেন, সেটি বর্তমান বঙ্গভবনের আদি ভবন। কী ভালোই না হতো এখন যদি আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাদে গিয়ে নদীতে নৌকা দেখতে পেতেন। যেখানে ছিল খরস্রোতা নদী ও তাতে নৌকা, সেখানে এখন রেললাইন। নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ঝিক্ ঝিক্ ঝিক্ ঝিক্ করে রেলগাড়ি চলে। মতিঝিল শাপলা চত্বরে সত্যি সত্যি ফুটে থাকত হাজারো শাপলা ফুল।
ফরাশগঞ্জ, নারিন্দা, মৈশুণ্ডি থেকে হিন্দুদের অনেকে বর্ষাকালে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিতে যেতেন নৌকায়। সিদ্ধেশ্বরী-মালিবাগ তখন ঢাকা শহর থেকে অনেক দূরের গ্রাম। খিলগাঁও-বাসাবোর অধিবাসীরা নৌকায় গিয়ে হজরত নিয়ামতুল্লাহ বুৎশিকন্দের মাজার জিয়ারত করতেন রাজউক ভবনের পাশে। ১০০ বছর আগে ঢাকার আশপাশে নদী ছিল ৮-১০টি এবং ঢাকার মধ্যে খাল ছিল ৪০ থেকে ৪৩টি। পাণ্ডু, দোলাই, কারওয়ান নদী শেষ। ওদিকে তুরাগ, বালু নদী কোনোরকমে আছে বেঁচে, টঙ্গী ও চিলাই নদীর অস্তিত্ব নেই। তেজগাঁও গ্রামটির পাশে ছিল একটি ছোট নদী। তার নাম বাখু।
সুবেদার ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩) ঢাকাকে সুবা বাংলা বা বাংলা প্রদেশের রাজধানী করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। মধ্যযুগে ঢাকা ছিল বাংলার শ্রেষ্ঠ নগর। পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী দেড় শ বছরে ইংরেজরা অবহেলা করেন ঢাকাকে। তাঁরা গড়ে তোলেন কলকাতা। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে আবার ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তার সম্প্রসার ঘটে। ’৪৭ সালে প্রাদেশিক রাজধানী হলে এর আকার বাড়তে থাকে দ্রুত।
আমি শ দেড়েক বছর আগের ঢাকার দু-একটি দৃশ্য তুলে ধরেছি। এত অল্প সময়ে এত পরিবর্তন পৃথিবীর আর কোনো নগরের হয়নি। শিল্পোন্নত দেশেও নয়। ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন কিছু হবেই। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে পরিবর্তনটা আত্মঘাতী হয় না।
অতীতের কথা বলে লাভ নেই। দেড় শ বছর পরে কী অবস্থা হবে ঢাকার? যে হারে নদ-নদী, জলাশয় দখল ও ভরাট হচ্ছে, তাতে দেড় শ বছর অপেক্ষা করতে হবে না। ২০৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বরের মধ্যেই ভরাট করে বুড়িগঙ্গায় নির্মিত হবে ৪২ তলা শপিংমল। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম বিপণিকেন্দ্র। শীতলক্ষ্যা ভরাট করে তাতে স্থাপন করা হবে শিল্প-কারখানা। আমদানি করা এক গ্যালন পানি মানুষ কিনবে পাঁচ গ্যালন অকটেনের দামে।
পাঠানদের প্রতিষ্ঠিত ঢাকা তো নয়ই যে ঢাকা ছিল ইসলাম খানের সময়ে বা কর্নওয়ালিশের কালে, সেই ঢাকা, সেই নদ-নদী, খাল-ঝিলও আর ফিরে পাব না। নবাব আবদুল গণির সময়ের ঢাকাও নয়। স্যার সলিমুল্লাহর ঢাকাও নয়। তবে পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় যে জলাধার ছিল, তার অর্ধেক পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব না হয়, অন্তত একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর ঢাকায় যে খাল, ঝিল, জলাধার ছিল, সেটাই আমরা ফেরত চাই।
পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজের লোকদের শাসকশ্রেণী মনে করেন তাঁদের দুশমন। নদ-নদীর অবৈধ দখলদারেরা তাঁদের দোস্ত। এই আত্মঘাতী মনোবৃত্তির পরিবর্তন না হলে এক শতাব্দীর মধ্যে শুধু ঢাকা নয়, দেশের ছোট-বড় সব শহরই মহেঞ্জোদারো-হরপ্পায় পরিণত হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কারওয়ান নদীটি একটি ছোট শাখানদী। বৈশাখ মাসে তাতে হাঁটুপানি থাকলেও জ্যৈষ্ঠে বৃষ্টি শুরু হতেই পানি বাড়তে থাকে। আষাঢ়ে দুই তীর টইটম্বুর। পূর্ণিমা সিনেমা হলের কাছে আন্ডারপাসের ওখানে শ্রাবণ-ভাদ্রে ফোটে প্রচুর শাপলা। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। আশ্বিনের ঝড়ে কোনো কোনো বছর সোনারগাঁও রোডের চৌরাস্তায় ফোয়ারার গোলচক্করে নৌকাডুবিতে মারাও যায় দু-চারজন। একটু দূরেই হাতির ঝিলে সারা বছর যে পানি থইথই করে, তাতে মনে হয় যেন কাস্পিয়ান হ্রদ।
কারওয়ান নদীর পাশেই আম্বর সেতুটি নির্মাণ করেন আম্বর শাহ নামে একজন পুণ্যবান মানুষ। তিনি প্রভাবশালী ও বিত্তবান ছিলেন। কারওয়ান নদীর তীরে এলাকার মানুষের জন্য তিনি নির্মাণ করেন একটি ছোট সুরম্য মসজিদ।
ফ্রেঞ্চগঞ্জ (ফরাশগঞ্জ) থেকে নৌকায় চান খাঁ সাহেবের পুল হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসীমউদ্দীন ও জিয়াউর রহমান হলের ওপর দিয়ে পরীবাগ হয়ে অনেকে কারওয়ান নদীর তীরে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে আসেন। কারওয়ান নদী থেকে যে খালটি চলে গেছে দোলাই নদীতে (বহু পরে যার নাম হয় ধোলাই খাল), তার পানি অতি স্বচ্ছ। মাছের সাঁতার কাটা দেখা যায় নৌকায় বসে ও পাড় থেকে।
এতক্ষণ আমি যা লিখলাম তা পড়ে মাথামুণ্ডু কেউ যে কিছু বুঝতে পারবেন, তা মনে হয় না। আমার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে বলে কেউ মনে করলেও তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। বহু বছর ধরে কেউ কলাম লিখলে তার মাথা-মগজে বিশেষ কিছু থাকে না। হয় গালগল্প লেখেন, নয়তো গালাগাল, অথবা আবোলতাবোল সব কথা। কারওয়ান বাজার এলাকায় যানজট ও গাড়ির ভিড়ে এখন অনেকেরই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ওখানে নৌকা কোথায়? আন্ডারপাসের ওখানে শাপলা কোথায়? কারওয়ান নদীটি কোথায়? আম্বর শাহ সেতুটি কোথায়? পাণ্ডু নদীর অস্তিত্ব নেই। ভরাট কারওয়ান নদীর ওপর গড়ে উঠেছে বিরাট বাজার। তার নাম এখন কারওয়ান বাজার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় কারওয়ান নদীর যে জায়গায় মাছ সাঁতার কাটত, জেলেরা ভেসাল ফেলে মাছ ধরতেন, এখন সেখানে মাছ ব্যবসায়ীর ডালায় মরা মাছের ওপর মাছি ভনভন করে।
আমি পলাশীর যুদ্ধের সময়ের মানুষ নই। সিপাহি বিদ্রোহটাও দেখিনি ১৮৫৭-তে। সুতরাং আঠারো ও উনিশ শতকের কারওয়ান বাজার, চান খাঁর পুল বা দোলাই নদীর অবস্থা জানলাম কীভাবে? ভাষা আন্দোলন ও একাত্তর নিয়ে স্মৃতিচারণা করে যা খুশি তাই লিখলেও নতুন প্রজন্মের মানুষ তা বিশ্বাস করতে বাধ্য। কিন্তু আঠারো ও উনিশ শতকের ঢাকা নিয়ে কাহিনি ফাঁদলে লোকে বলবে গাঁজাখোর। আমি যে জায়গার নদী ও জলাশয়ের কথা বললাম, তা আমার কথা নয়, সেকালের প্রত্যক্ষদর্শী লেখকদের রচিত বইপত্রের কথা। ১০০ বছর আগে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত রেভিনিউ হিস্ট্রি অব বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য ফিফ্থ রিপোর্ট (১৯১৭) এবং ফাইনাল রিপোর্ট অব দ্য সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অব ঢাকা প্রভৃতি বইপত্রে ঢাকার ভেতরের ও আশপাশের নদ-নদী ও খাল-ঝিলের কথা লেখা আছে।
দুজন ঢাকা-বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হয়েছিল আমার। তার একজন প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ আহমদ হাসান দানী এবং আর একজন আজিমুশ্শান হায়দার। ড. দানীর মতো পণ্ডিত ও ভালো মানুষ আমি জীবনে জনা পাঁচেকের বেশি দেখিনি। তাঁর লেখার বাইরে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তায় ঢাকা সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানতে পারি। তা ছাড়া আর একজন ঢাকা-বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদ হাকিম হাবিবুর রহমানের লেখা বই ও কাগজপত্র দেখারও সুযোগ হয়। তাঁর উর্দু লেখার পাঠোদ্ধার করতে আমাকে সাহায্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু-ফারসি বিভাগের অধ্যাপক প্রয়াত ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ। ঢাকার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে হলে শুধু ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের ওপর নির্ভর করা যাবে না। উর্দু ও ফারসি লেখার সাহায্য নিতে হবে। আমার দুর্ভাগ্য, ওই বিদ্যায় আমি নিরক্ষর।
ভাদ্র বা আশ্বিনের জোছনা রাত। আকাশ পরিষ্কার। নবাব আবদুল গণি এবং তাঁর পুত্র নবাব বাহাদুর খাজা আহসানুল্লাহ তাঁদের বেগমদের নিয়ে (দুই নবাবের বেগম পাঁচ-ছয়জনের কম নয়) অবস্থান করছেন তাঁদের দিলকুশার বাগানবাড়ির প্রাসাদে। সন্ধ্যায় তাঁরা ছাদে পায়চারি করছেন। ডানে-বামে উদ্যানে বড় বড় বৃক্ষ। দক্ষিণ-পূর্ব দিক শীতলক্ষ্যা পর্যন্ত আদিগন্ত খোলা। ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে রংবেরঙের পালের নৌকা নদীতে। নদীর শীতল হাওয়া নবাব পরিবারের সদস্যদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। নৌকাগুলো যাচ্ছে মতিঝিল ওয়াপদা অফিসের পেছন দিক দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের কাছে কমলাপুর।
নবাব আবদুল গণি ও নবাব আহসানুল্লাহ যে ভবনের ছাদ থেকে মতিঝিলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীতে নৌকার যাতায়াত দেখতেন, সেটি বর্তমান বঙ্গভবনের আদি ভবন। কী ভালোই না হতো এখন যদি আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাদে গিয়ে নদীতে নৌকা দেখতে পেতেন। যেখানে ছিল খরস্রোতা নদী ও তাতে নৌকা, সেখানে এখন রেললাইন। নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ঝিক্ ঝিক্ ঝিক্ ঝিক্ করে রেলগাড়ি চলে। মতিঝিল শাপলা চত্বরে সত্যি সত্যি ফুটে থাকত হাজারো শাপলা ফুল।
ফরাশগঞ্জ, নারিন্দা, মৈশুণ্ডি থেকে হিন্দুদের অনেকে বর্ষাকালে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিতে যেতেন নৌকায়। সিদ্ধেশ্বরী-মালিবাগ তখন ঢাকা শহর থেকে অনেক দূরের গ্রাম। খিলগাঁও-বাসাবোর অধিবাসীরা নৌকায় গিয়ে হজরত নিয়ামতুল্লাহ বুৎশিকন্দের মাজার জিয়ারত করতেন রাজউক ভবনের পাশে। ১০০ বছর আগে ঢাকার আশপাশে নদী ছিল ৮-১০টি এবং ঢাকার মধ্যে খাল ছিল ৪০ থেকে ৪৩টি। পাণ্ডু, দোলাই, কারওয়ান নদী শেষ। ওদিকে তুরাগ, বালু নদী কোনোরকমে আছে বেঁচে, টঙ্গী ও চিলাই নদীর অস্তিত্ব নেই। তেজগাঁও গ্রামটির পাশে ছিল একটি ছোট নদী। তার নাম বাখু।
সুবেদার ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩) ঢাকাকে সুবা বাংলা বা বাংলা প্রদেশের রাজধানী করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। মধ্যযুগে ঢাকা ছিল বাংলার শ্রেষ্ঠ নগর। পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী দেড় শ বছরে ইংরেজরা অবহেলা করেন ঢাকাকে। তাঁরা গড়ে তোলেন কলকাতা। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে আবার ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তার সম্প্রসার ঘটে। ’৪৭ সালে প্রাদেশিক রাজধানী হলে এর আকার বাড়তে থাকে দ্রুত।
আমি শ দেড়েক বছর আগের ঢাকার দু-একটি দৃশ্য তুলে ধরেছি। এত অল্প সময়ে এত পরিবর্তন পৃথিবীর আর কোনো নগরের হয়নি। শিল্পোন্নত দেশেও নয়। ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন কিছু হবেই। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে পরিবর্তনটা আত্মঘাতী হয় না।
অতীতের কথা বলে লাভ নেই। দেড় শ বছর পরে কী অবস্থা হবে ঢাকার? যে হারে নদ-নদী, জলাশয় দখল ও ভরাট হচ্ছে, তাতে দেড় শ বছর অপেক্ষা করতে হবে না। ২০৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বরের মধ্যেই ভরাট করে বুড়িগঙ্গায় নির্মিত হবে ৪২ তলা শপিংমল। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম বিপণিকেন্দ্র। শীতলক্ষ্যা ভরাট করে তাতে স্থাপন করা হবে শিল্প-কারখানা। আমদানি করা এক গ্যালন পানি মানুষ কিনবে পাঁচ গ্যালন অকটেনের দামে।
পাঠানদের প্রতিষ্ঠিত ঢাকা তো নয়ই যে ঢাকা ছিল ইসলাম খানের সময়ে বা কর্নওয়ালিশের কালে, সেই ঢাকা, সেই নদ-নদী, খাল-ঝিলও আর ফিরে পাব না। নবাব আবদুল গণির সময়ের ঢাকাও নয়। স্যার সলিমুল্লাহর ঢাকাও নয়। তবে পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় যে জলাধার ছিল, তার অর্ধেক পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব না হয়, অন্তত একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর ঢাকায় যে খাল, ঝিল, জলাধার ছিল, সেটাই আমরা ফেরত চাই।
পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজের লোকদের শাসকশ্রেণী মনে করেন তাঁদের দুশমন। নদ-নদীর অবৈধ দখলদারেরা তাঁদের দোস্ত। এই আত্মঘাতী মনোবৃত্তির পরিবর্তন না হলে এক শতাব্দীর মধ্যে শুধু ঢাকা নয়, দেশের ছোট-বড় সব শহরই মহেঞ্জোদারো-হরপ্পায় পরিণত হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments