গণতান্ত্রিক রাজনীতি বনাম অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো হরতালকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করে থাকে। তাদের দাবি অনেকটাই সংগত। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আন্দোলন অনেক দীর্ঘমেয়াদি যেমন হয়, তেমনি আবার এর অর্জন ও সম্ভাবনা নিয়েও নতুন নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়। ফলে গণতান্ত্রিক অধিকারের আগের এবং বর্তমানের ধারণা ও বাস্তবতায় অনেক তারতম্য
ঘটে থাকে। দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেকেই সেই ধারণা, বাস্তবতা ও তারতম্যকে সব সময় গুরুত্বের সঙ্গে নেন না। একভাবেই দেখা, বোঝা ও প্রয়োগের কথা বলে থাকেন, চেষ্টাও করে থাকেন। এতে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও সামাজিক সংকট অনেকটাই অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমার মনে হয়, হরতালের অতীত এবং বর্তমান ধারণা ও প্রয়োগের মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান ঘটে গেছে, এর চরিত্রে যে ভিন্নতাগুলো প্রবেশ করেছে, তার ফলে হরতালকে গণতান্ত্রিক অধিকারের সাধারণ সংজ্ঞায় ফেলা যায় কি না তা নিয়েই সমাজে মস্তবড় প্রশ্ন ও বিরোধ তৈরি হয়ে গেছে। অথচ রাষ্ট্র ও দলের ক্ষমতা এবং শক্তির কারণে বিষয়টি নিয়ে জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকারের ধারণাটি যথাযথভাবে আলোচনা-পর্যালোচনার সুযোগ পাচ্ছে না। এর স্বাভাবিক বিকাশও তাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তরুণ সমাজের মধ্যে গণতন্ত্র, হরতাল, রাজনীতি ইত্যাদি নানা প্রশ্নেই গণতান্ত্রিক ধারণার চেয়ে ভুল, বিকৃত ও বিভ্রান্তি বেশি বেশি স্থান করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এটি একটি মস্তবড় অশনিসংকেত বলে আমরা মনে করি। বিষয়টি দেশের কর্ণধার, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারকদের এখনই গভীরভাবে অনুধাবন করতে বলব। নতুবা এর পরিণতি বহন করার শক্তি বাংলাদেশের দুর্বল গণতন্ত্রের খুব একটা নাও থাকতে পারে।
একটি বিষয় পরিষ্কার থাকতে হবে_ঔপনিবেশিকতা এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন, বিদ্রোহ, বিক্ষোভ ইত্যাদি প্রকাশ যে ধরনের থাকে, স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশে কিন্তু তা হওয়া উচিত নয়। আমরা ব্রিটিশ যুগে বিদ্রোহ করেছি দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার আকাঙ্ক্ষা থেকে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা বিষয়েই সংগ্রাম, আন্দোলন ও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে। সে সময় অসহযোগিতার মতো কর্মসূচি ছিল জনগণের প্রাণের দাবি, ভেতর থেকে উঠে আসা তাগিদ হিসেবে। মানুষ তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করেছে। ৯ মাস সাড়ে সাত কোটি মানুষ যুদ্ধ করেছে। এসবই ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনার বাস্তবতা এবং স্বাভাবিকতাও। স্বাভাবিক সময়ে তা আশা করা যায় না। এমনকি সামরিক শাসন থেকে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতেও মানুষকে হরতাল, আন্দোলনের মতো অনেক কর্মসূচি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করতে হয়েছে। স্বীকার করতেই হবে, এর জন্য মানুষকে বেশ কষ্টে পড়তে হয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র, জীবন-জীবিকার বাস্তবতা এখন অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের লড়াই এই পর্বে আগের ধারায় অনেকটাই অসহনীয় এবং অচল হয়ে উঠছিল। গণমাধ্যম, প্রচারমাধ্যম, গণসচেতনতা ইত্যাদি জনমত তৈরিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখলেও তখনো সামরিক শাসনের বাধানিষেধের কারণে মাঝেমধ্যে জনমত বিস্ফোরিত হওয়ার সুযোগ ছিল। ঘটেও ছিল তাই। কিন্তু গত দুই-আড়াই দশকে বাংলাদেশের বাস্তবতা অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। জনগণ সরকারের সবলতা, দুর্বলতা, উদ্দেশ্য ইত্যাদি ধরতে পারছে, বুঝতে পারছে। এখন প্রচারমাধ্যম, শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশ ইত্যাদি মানুষকে অনেক কিছুই বুঝতে সাহায্য করে থাকে। বিশেষত ১৯৯১ সালে ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারা দুর্বলভাবে হলেও সূচিত হওয়ার পর বাংলাদেশে মানুষ এখন রাজনৈতিক সচেতনতার অবস্থান থেকে নতুন পর্বে উন্নীত হয়েছে। হ্যাঁ, জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে যে কয়বার সরকারের পক্ষ থেকে ষড়যন্ত্র করার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে ততবারই মানুষ হরতাল, ধর্মঘট, সভা-সমাবেশসহ নানা ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান অধিকার ভোট প্রদান, প্রতিনিধি নির্বাচন, সরকার গঠনে ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি এতবার বাধাগ্রস্ত হবে তা হয়তো মোটেও কাঙ্ক্ষিত ছিল না; কিন্তু বাস্তবতা হলো তেমন ঘটনা কয়েকবার ছিল। তবে এটিও লক্ষণীয়, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল প্রধান দুই শক্তির রাজনৈতিক আদর্শগত বৈপরীত্য এতটাই দূরবর্তী যে কারণে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সংঘাতগুলো অনেকটাই সেখান থেকেই ঘটেছে। যতই আমরা বলি না কেন, দুই দলের মধ্যে সহনশীলতা থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তার অনুপস্থিতির মূল কারণ হলো পরস্পরবিরোধী দুই স্রোতধারার আদর্শের রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশে প্রায় সমান সমান শক্তিতে অবস্থান করছে। এখানে তাই অনেকেই একমত হচ্ছে না, যখন বলা হয় যে আমরা একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে চাই। অথচ গণতন্ত্র নিজেই কিন্তু সেক্যুলার। সেক্যুলার না হলে গণতন্ত্র কোনোকালেই প্রতিষ্ঠা হবে না। আমাদের দুই শিবিরের রাজনৈতিক বিপরীত অবস্থান তো এখানেই স্পষ্ট। কারণ দেশটি গত ৪০ বছর যে পর্যায়ে চলে গেছে তার মধ্যে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরও মুক্তিযুদ্ধেরই শুধু নয়, প্রকৃত গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি এবং আদর্শের প্রশ্নেই দেশের অভ্যন্তরে কত ব্যাপক ক্ষত, বিরোধ, সংঘাত এবং দূরত্ব তৈরি হয়ে আছে তা ভাবাই কষ্টকর।
মূল প্রসঙ্গে আবারও ফিরে আসি, হরতাল তখনই গণতান্ত্রিক চরিত্র পাবে, যখন কোনো দল যথার্থ ইস্যুতে জনমত সৃষ্টি করে সময়মতো হরতালের আহ্বান করতে পারে। জনগণ যদি ওই দাবির যৌক্তিকতা সমর্থন করে, তা বোঝা বা প্রকাশ করার দেশে যথেষ্ট মাধ্যম রয়েছে। এক ঘণ্টার কর্মবিরতি হতে পারে। রাস্তার দুই ধারে দাবির পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যানার টানিয়ে সমর্থন জানানো যেতে পারে। অথবা পূর্ণদিবসও মানুষ কর্মসূচির পক্ষে সমর্থন জানিয়ে কর্মবিরতি পালন করতে পারে। কিন্তু সেটি হতে হবে জনগণের ইচ্ছায়, দলীয় কর্মীদের পিকেটিংয়ের ভয়ে, গাড়ি ভাঙচুর, জ্বালিয়ে বা রাস্তা অবরোধ করিয়ে নয়। বর্তমানে হরতালের ইস্যুই মানুষকে জানানো হয় না। বেতার-টিভিতে সংবাদ সম্মেলন করে বলে দেওয়া হয় ২৪, ৩৬ বা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের কর্মসূচি পালন করার কথা। এরপর শুরু হয় পিকেটিং, গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর, জোরপূর্বক দোকানপাট বন্ধ রাখার ব্যবস্থা। দলের ক্যাডাররা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পথেঘাটে যা খুশি তা করতে পারে। গাড়িতে যেভাবে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাতে মানুষের জীবন প্রদীপও নিভে যায়। হরতালের এই চরিত্রটি মোটেও গণতান্ত্রিক নয়, এখানে জোর-জবরদস্তি, ভয়ভীতি, আতঙ্ক, ভাঙচুর ইত্যাদিই বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ তাই খুব প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের হতে চায় না। কিন্তু এখনকার কর্মময় জীবনে এভাবে ঘরে বসে থাকা কয়জনের পক্ষে সম্ভব? মানুষের স্বাভাবিক চলাচল, জীবন-জীবিকার ওপর বাধা দেওয়ার কোনো কর্মসূচিই তো গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করা চলে না। গণতান্ত্রিক সমাজে অধিকারের ধারণাই হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়। সেখানে শক্তি প্রয়োগের কোনো সুযোগ একেবারেই থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে ডাকা অধিকাংশ হরতালই হচ্ছে দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়, দলীয় উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মীদের জোর-জবরদস্তির ব্যাপার। জনগণের মতামত, ইচ্ছা, অনিচ্ছা ইত্যাদির কোনো মূল্য যেন কারো কাছেই নেই।
আসলে বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় গণতন্ত্রের আন্দোলন দেশে দেশে চলছে, চলবে। কিন্তু বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো হরতালের অপপ্রয়োগ তেমন কোথাও হতে খুব একটা দেখা যায় না। আমাদের রাজনীতিবিদদের হাতে পড়ে হরতালের মতো একটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচিও যে এর গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলছে, তা স্বীকার করতে হবে। জনগণের রায় দেওয়া, নেওয়া ও পাওয়ার নানা পথ এবং উপায় এখন বাংলাদেশেই রয়েছে। সেগুলোকে ব্যবহার না করে ঔপনিবেশিক যুগের আন্দোলনের হাতিয়ারকে এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় বারবার অপব্যবহার করতে গিয়ে আমরা আসলে একদিকে গণতন্ত্রকে দুর্বল করছি, অন্যদিকে বাংলাদেশকেও আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিচ্ছি না। দেশের রাজনীতিতে প্রকৃত গণতন্ত্রের ধারণার বিকাশ ঘটানোর উদ্যোগ না হটানো হলে দেশ 'গণতান্ত্রিক অধিকারের' নামে যে হরতালের দুষ্টচক্রে পড়েছে, তা আসলে মোটেও গণতান্ত্রিক হওয়ার নয়, জনগণের অধিকার আদায়ের হরতালও হওয়ার নয়। এর অর্থ যে দল যেমন বোঝে, তেমনই।
লেখক : শিক্ষাবিদ
একটি বিষয় পরিষ্কার থাকতে হবে_ঔপনিবেশিকতা এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন, বিদ্রোহ, বিক্ষোভ ইত্যাদি প্রকাশ যে ধরনের থাকে, স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশে কিন্তু তা হওয়া উচিত নয়। আমরা ব্রিটিশ যুগে বিদ্রোহ করেছি দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার আকাঙ্ক্ষা থেকে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা বিষয়েই সংগ্রাম, আন্দোলন ও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে। সে সময় অসহযোগিতার মতো কর্মসূচি ছিল জনগণের প্রাণের দাবি, ভেতর থেকে উঠে আসা তাগিদ হিসেবে। মানুষ তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করেছে। ৯ মাস সাড়ে সাত কোটি মানুষ যুদ্ধ করেছে। এসবই ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনার বাস্তবতা এবং স্বাভাবিকতাও। স্বাভাবিক সময়ে তা আশা করা যায় না। এমনকি সামরিক শাসন থেকে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতেও মানুষকে হরতাল, আন্দোলনের মতো অনেক কর্মসূচি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করতে হয়েছে। স্বীকার করতেই হবে, এর জন্য মানুষকে বেশ কষ্টে পড়তে হয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র, জীবন-জীবিকার বাস্তবতা এখন অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের লড়াই এই পর্বে আগের ধারায় অনেকটাই অসহনীয় এবং অচল হয়ে উঠছিল। গণমাধ্যম, প্রচারমাধ্যম, গণসচেতনতা ইত্যাদি জনমত তৈরিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখলেও তখনো সামরিক শাসনের বাধানিষেধের কারণে মাঝেমধ্যে জনমত বিস্ফোরিত হওয়ার সুযোগ ছিল। ঘটেও ছিল তাই। কিন্তু গত দুই-আড়াই দশকে বাংলাদেশের বাস্তবতা অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। জনগণ সরকারের সবলতা, দুর্বলতা, উদ্দেশ্য ইত্যাদি ধরতে পারছে, বুঝতে পারছে। এখন প্রচারমাধ্যম, শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশ ইত্যাদি মানুষকে অনেক কিছুই বুঝতে সাহায্য করে থাকে। বিশেষত ১৯৯১ সালে ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারা দুর্বলভাবে হলেও সূচিত হওয়ার পর বাংলাদেশে মানুষ এখন রাজনৈতিক সচেতনতার অবস্থান থেকে নতুন পর্বে উন্নীত হয়েছে। হ্যাঁ, জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে যে কয়বার সরকারের পক্ষ থেকে ষড়যন্ত্র করার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে ততবারই মানুষ হরতাল, ধর্মঘট, সভা-সমাবেশসহ নানা ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান অধিকার ভোট প্রদান, প্রতিনিধি নির্বাচন, সরকার গঠনে ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি এতবার বাধাগ্রস্ত হবে তা হয়তো মোটেও কাঙ্ক্ষিত ছিল না; কিন্তু বাস্তবতা হলো তেমন ঘটনা কয়েকবার ছিল। তবে এটিও লক্ষণীয়, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল প্রধান দুই শক্তির রাজনৈতিক আদর্শগত বৈপরীত্য এতটাই দূরবর্তী যে কারণে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সংঘাতগুলো অনেকটাই সেখান থেকেই ঘটেছে। যতই আমরা বলি না কেন, দুই দলের মধ্যে সহনশীলতা থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তার অনুপস্থিতির মূল কারণ হলো পরস্পরবিরোধী দুই স্রোতধারার আদর্শের রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশে প্রায় সমান সমান শক্তিতে অবস্থান করছে। এখানে তাই অনেকেই একমত হচ্ছে না, যখন বলা হয় যে আমরা একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে চাই। অথচ গণতন্ত্র নিজেই কিন্তু সেক্যুলার। সেক্যুলার না হলে গণতন্ত্র কোনোকালেই প্রতিষ্ঠা হবে না। আমাদের দুই শিবিরের রাজনৈতিক বিপরীত অবস্থান তো এখানেই স্পষ্ট। কারণ দেশটি গত ৪০ বছর যে পর্যায়ে চলে গেছে তার মধ্যে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরও মুক্তিযুদ্ধেরই শুধু নয়, প্রকৃত গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি এবং আদর্শের প্রশ্নেই দেশের অভ্যন্তরে কত ব্যাপক ক্ষত, বিরোধ, সংঘাত এবং দূরত্ব তৈরি হয়ে আছে তা ভাবাই কষ্টকর।
মূল প্রসঙ্গে আবারও ফিরে আসি, হরতাল তখনই গণতান্ত্রিক চরিত্র পাবে, যখন কোনো দল যথার্থ ইস্যুতে জনমত সৃষ্টি করে সময়মতো হরতালের আহ্বান করতে পারে। জনগণ যদি ওই দাবির যৌক্তিকতা সমর্থন করে, তা বোঝা বা প্রকাশ করার দেশে যথেষ্ট মাধ্যম রয়েছে। এক ঘণ্টার কর্মবিরতি হতে পারে। রাস্তার দুই ধারে দাবির পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যানার টানিয়ে সমর্থন জানানো যেতে পারে। অথবা পূর্ণদিবসও মানুষ কর্মসূচির পক্ষে সমর্থন জানিয়ে কর্মবিরতি পালন করতে পারে। কিন্তু সেটি হতে হবে জনগণের ইচ্ছায়, দলীয় কর্মীদের পিকেটিংয়ের ভয়ে, গাড়ি ভাঙচুর, জ্বালিয়ে বা রাস্তা অবরোধ করিয়ে নয়। বর্তমানে হরতালের ইস্যুই মানুষকে জানানো হয় না। বেতার-টিভিতে সংবাদ সম্মেলন করে বলে দেওয়া হয় ২৪, ৩৬ বা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের কর্মসূচি পালন করার কথা। এরপর শুরু হয় পিকেটিং, গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর, জোরপূর্বক দোকানপাট বন্ধ রাখার ব্যবস্থা। দলের ক্যাডাররা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পথেঘাটে যা খুশি তা করতে পারে। গাড়িতে যেভাবে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাতে মানুষের জীবন প্রদীপও নিভে যায়। হরতালের এই চরিত্রটি মোটেও গণতান্ত্রিক নয়, এখানে জোর-জবরদস্তি, ভয়ভীতি, আতঙ্ক, ভাঙচুর ইত্যাদিই বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ তাই খুব প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের হতে চায় না। কিন্তু এখনকার কর্মময় জীবনে এভাবে ঘরে বসে থাকা কয়জনের পক্ষে সম্ভব? মানুষের স্বাভাবিক চলাচল, জীবন-জীবিকার ওপর বাধা দেওয়ার কোনো কর্মসূচিই তো গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করা চলে না। গণতান্ত্রিক সমাজে অধিকারের ধারণাই হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়। সেখানে শক্তি প্রয়োগের কোনো সুযোগ একেবারেই থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে ডাকা অধিকাংশ হরতালই হচ্ছে দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়, দলীয় উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মীদের জোর-জবরদস্তির ব্যাপার। জনগণের মতামত, ইচ্ছা, অনিচ্ছা ইত্যাদির কোনো মূল্য যেন কারো কাছেই নেই।
আসলে বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় গণতন্ত্রের আন্দোলন দেশে দেশে চলছে, চলবে। কিন্তু বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো হরতালের অপপ্রয়োগ তেমন কোথাও হতে খুব একটা দেখা যায় না। আমাদের রাজনীতিবিদদের হাতে পড়ে হরতালের মতো একটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচিও যে এর গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলছে, তা স্বীকার করতে হবে। জনগণের রায় দেওয়া, নেওয়া ও পাওয়ার নানা পথ এবং উপায় এখন বাংলাদেশেই রয়েছে। সেগুলোকে ব্যবহার না করে ঔপনিবেশিক যুগের আন্দোলনের হাতিয়ারকে এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় বারবার অপব্যবহার করতে গিয়ে আমরা আসলে একদিকে গণতন্ত্রকে দুর্বল করছি, অন্যদিকে বাংলাদেশকেও আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিচ্ছি না। দেশের রাজনীতিতে প্রকৃত গণতন্ত্রের ধারণার বিকাশ ঘটানোর উদ্যোগ না হটানো হলে দেশ 'গণতান্ত্রিক অধিকারের' নামে যে হরতালের দুষ্টচক্রে পড়েছে, তা আসলে মোটেও গণতান্ত্রিক হওয়ার নয়, জনগণের অধিকার আদায়ের হরতালও হওয়ার নয়। এর অর্থ যে দল যেমন বোঝে, তেমনই।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments