ঐতিহ্য-গোল্লাছুট প্রথম আলো গল্পলেখা প্রতিযোগিতা ২০১১-এ পুরস্কার পাওয়া গল্পগুলো আজ থেকে ছাপা হচ্ছে- বন্ধু by অর্ঘ্য দত্ত
অপুর মন ভালো নেই। ওদের পুরোনো বাড়িটা ভেঙে সেখানে নতুন করে দশতলা বিল্ডিং হবে। ডেভেলপারদের সঙ্গে পাকা কথা বলে বাবা মিষ্টির বাক্স নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। বললেন, নতুন বাড়িতে লিফটে চড়ে উঠবি, নামবি। কত মজা হবে, তাই না?
— কিন্তু বাড়ির সামনে আমার খেলার মাঠ?
— পুরো বাড়ি আর মাঠজুড়েই তো বিল্ডিং হবে।
— আমি খেলব কোথায়?
— দশতলার ছাদে।
— বাড়ির সামনে আমাদের শজনেগাছটা থাকবে তো?
বাবা হেসে বললেন, তুই দেখছি আসলেই বোকা ছেলে। শজনেগাছ থাকলে বিল্ডিং হবে কী করে?
— তাহলে আমার নতুন বাড়ির দরকার নেই।
— দরকার নেই, মানে?
অপুর কথায় বাবা রীতিমতো অবাক! বললেন, এই তো সেদিন বললি অভ্ররা ওদের ছয়তলার নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছে। ওরা লিফটে ওঠানামা করবে। কত মজা করবে। অথচ এখন বলছিস...
— কিন্তু শজনেগাছটা যে থাকবে না।
বাবা হেসে বললেন, দশতলা নতুন একটা বাড়ির কাছে ওই বুড়ো শজনেগাছটার কোনো দাম আছে?...
রাতে শোয়ার আগে অপু জানালা খুলে বাইরে সজনেগাছটার দিকে তাকাল। শজনেগাছটাও যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গাছটা পুরোনো। সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু লম্বা সবুজ শজনে ডাঁটায় গাছটা যখন ভরে যায়, অপুর তখন খুব ভালো লাগে। বৃষ্টির মধ্যে গাছটা ভিজে জবজবে হলে মনে হয় একটা বুড়ো মানুষ রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছে। শজনের ডাঁটা বেয়ে টপ টপ করে বৃষ্টির জল পড়ে আর অপু মনে মনে বলে, বড় হলে আমি তোমার জন্য অনেক বড় একটা ছাতা কিনে দেব।
কিন্তু কী হলো হঠাৎ, বুড়ো শজনেগাছটা কথা বলতে শুরু করল। বলল, ওরা আমায় মেরে ফেলবে। তুমি আমাকে বাঁচাও।
চমকে উঠল অপু, গাছ কথা বলছে! গাছের প্রাণ আছে অপু বইয়ে পড়েছে, কিন্তু গাছ যে এভাবে কথা বলতে পারে, অপুর কাছে তা একেবারেই অজানা।
সে রাতেই অপুর প্রচণ্ড জ্বর এল। অপু চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। ডাক্তারের ওষুধে অপুর জ্বর কমল ঠিকই, কিন্তু অপু যেন সেই আগের অপু আর নেই। সারা দিন বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকে। কারও সঙ্গে কথা বলে না। ঠিকমতো খায় না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মাঝে-মাঝে ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ডাক্তার নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ঘরের বাইরে এসে বাবাকে বললেন, ওকে একজন শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলে ভালো হতো। ডাক্তারের কথা শুনে মা তো হাউমাউ করে কেঁদে অস্থির। বাবা বললেন, ব্যস্ত হোয়ো না। চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডক্টর রায়হান আমার বন্ধু। অপুকে আমি আজই ওর কাছে নিয়ে যাব।
ডক্টর রায়হান একেবারে অন্য রকম একজন ডাক্তার। অপুর মেডিকেল রিপোর্টগুলোর দিকে একনজর চোখ বুলিয়ে বললেন, অপুর সঙ্গে আমি একা কথা বলব।
বাবা-মা চেম্বারের বাইরে চলে গেলেন। ডক্টর রায়হান এসে বসলেন অপুর মুখোমুখি। বললেন, আমি কিন্তু কোনো অসুখের কথা বলব না। খেলাধুলার কথা বলব।
— মানে?
চমকে উঠল অপু। কোনো ডাক্তার রোগীর কাছে খেলাধুলার কথা জানতে চায় নাকি?
— মানে কিছুই না, আমি জানতে চাই, তুমি কী খেলতে পছন্দ করো?
কী বলবে অপু, বাড়ির সামনে ওর খেলার জায়গাটুকুই তো আর কদিন পর হারিয়ে যাবে। কাটা পড়বে শজনেগাছ। অপুর চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে দেখে ডক্টর রায়হান বললেন, ভয় নেই। তুমি বলো। আমি তোমার সব কথা শুনব। কারা তোমার বন্ধু, তুমি কী পছন্দ করো, কোথায় খেলো, বলো।
— আমার খেলার মাঠটা তো আর থাকছেই না, আমি কোথায় খেলব?
— মাঠ থাকছে না মানে?
ডক্টর রায়হান এরপর অপুর কাছ থেকে সব কথা শুনলেন। এরপর অপুর বাবা-মাকে ভেতরে ডাকলেন। মুখ গম্ভীর করে বাবাকে বললেন, নতুন বাড়ি করছ, কথাটা আমায় জানাওনি কেন?
— না মানে, এই সেদিন মাত্র ডেভেলপারদের সঙ্গে কথা হলো...
— নতুন বাড়ি কি তোমার ছেলের চেয়েও বেশি দামি?
— মানে?
ডক্টর রায়হান এরপর অপুর বাবাকে খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন, শজনেগাছটা কেটে ওখানে বিল্ডিং করা হলে মস্ত ভুল করা হবে। বাবা ডক্টর রায়হানকে কথা দিলেন, এমন ভুল তিনি করবেন না।
ঘরে এল অপু। খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখল, বুড়ো শজনেগাছটার মুখে হাসি। গাছটা যেন বলছে, তোমার জন্য বেঁচে গেলাম। এবার আমি তোমার বন্ধু হব। হাসি পেল অপুর, বুড়ো শজনেগাছ অপুর বন্ধু।
সেন্ট গ্রেগরিজ উচ্চবিদ্যালয়, ঢাকা
— পুরো বাড়ি আর মাঠজুড়েই তো বিল্ডিং হবে।
— আমি খেলব কোথায়?
— দশতলার ছাদে।
— বাড়ির সামনে আমাদের শজনেগাছটা থাকবে তো?
বাবা হেসে বললেন, তুই দেখছি আসলেই বোকা ছেলে। শজনেগাছ থাকলে বিল্ডিং হবে কী করে?
— তাহলে আমার নতুন বাড়ির দরকার নেই।
— দরকার নেই, মানে?
অপুর কথায় বাবা রীতিমতো অবাক! বললেন, এই তো সেদিন বললি অভ্ররা ওদের ছয়তলার নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছে। ওরা লিফটে ওঠানামা করবে। কত মজা করবে। অথচ এখন বলছিস...
— কিন্তু শজনেগাছটা যে থাকবে না।
বাবা হেসে বললেন, দশতলা নতুন একটা বাড়ির কাছে ওই বুড়ো শজনেগাছটার কোনো দাম আছে?...
রাতে শোয়ার আগে অপু জানালা খুলে বাইরে সজনেগাছটার দিকে তাকাল। শজনেগাছটাও যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গাছটা পুরোনো। সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু লম্বা সবুজ শজনে ডাঁটায় গাছটা যখন ভরে যায়, অপুর তখন খুব ভালো লাগে। বৃষ্টির মধ্যে গাছটা ভিজে জবজবে হলে মনে হয় একটা বুড়ো মানুষ রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছে। শজনের ডাঁটা বেয়ে টপ টপ করে বৃষ্টির জল পড়ে আর অপু মনে মনে বলে, বড় হলে আমি তোমার জন্য অনেক বড় একটা ছাতা কিনে দেব।
কিন্তু কী হলো হঠাৎ, বুড়ো শজনেগাছটা কথা বলতে শুরু করল। বলল, ওরা আমায় মেরে ফেলবে। তুমি আমাকে বাঁচাও।
চমকে উঠল অপু, গাছ কথা বলছে! গাছের প্রাণ আছে অপু বইয়ে পড়েছে, কিন্তু গাছ যে এভাবে কথা বলতে পারে, অপুর কাছে তা একেবারেই অজানা।
সে রাতেই অপুর প্রচণ্ড জ্বর এল। অপু চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। ডাক্তারের ওষুধে অপুর জ্বর কমল ঠিকই, কিন্তু অপু যেন সেই আগের অপু আর নেই। সারা দিন বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকে। কারও সঙ্গে কথা বলে না। ঠিকমতো খায় না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মাঝে-মাঝে ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ডাক্তার নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ঘরের বাইরে এসে বাবাকে বললেন, ওকে একজন শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলে ভালো হতো। ডাক্তারের কথা শুনে মা তো হাউমাউ করে কেঁদে অস্থির। বাবা বললেন, ব্যস্ত হোয়ো না। চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডক্টর রায়হান আমার বন্ধু। অপুকে আমি আজই ওর কাছে নিয়ে যাব।
ডক্টর রায়হান একেবারে অন্য রকম একজন ডাক্তার। অপুর মেডিকেল রিপোর্টগুলোর দিকে একনজর চোখ বুলিয়ে বললেন, অপুর সঙ্গে আমি একা কথা বলব।
বাবা-মা চেম্বারের বাইরে চলে গেলেন। ডক্টর রায়হান এসে বসলেন অপুর মুখোমুখি। বললেন, আমি কিন্তু কোনো অসুখের কথা বলব না। খেলাধুলার কথা বলব।
— মানে?
চমকে উঠল অপু। কোনো ডাক্তার রোগীর কাছে খেলাধুলার কথা জানতে চায় নাকি?
— মানে কিছুই না, আমি জানতে চাই, তুমি কী খেলতে পছন্দ করো?
কী বলবে অপু, বাড়ির সামনে ওর খেলার জায়গাটুকুই তো আর কদিন পর হারিয়ে যাবে। কাটা পড়বে শজনেগাছ। অপুর চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে দেখে ডক্টর রায়হান বললেন, ভয় নেই। তুমি বলো। আমি তোমার সব কথা শুনব। কারা তোমার বন্ধু, তুমি কী পছন্দ করো, কোথায় খেলো, বলো।
— আমার খেলার মাঠটা তো আর থাকছেই না, আমি কোথায় খেলব?
— মাঠ থাকছে না মানে?
ডক্টর রায়হান এরপর অপুর কাছ থেকে সব কথা শুনলেন। এরপর অপুর বাবা-মাকে ভেতরে ডাকলেন। মুখ গম্ভীর করে বাবাকে বললেন, নতুন বাড়ি করছ, কথাটা আমায় জানাওনি কেন?
— না মানে, এই সেদিন মাত্র ডেভেলপারদের সঙ্গে কথা হলো...
— নতুন বাড়ি কি তোমার ছেলের চেয়েও বেশি দামি?
— মানে?
ডক্টর রায়হান এরপর অপুর বাবাকে খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন, শজনেগাছটা কেটে ওখানে বিল্ডিং করা হলে মস্ত ভুল করা হবে। বাবা ডক্টর রায়হানকে কথা দিলেন, এমন ভুল তিনি করবেন না।
ঘরে এল অপু। খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখল, বুড়ো শজনেগাছটার মুখে হাসি। গাছটা যেন বলছে, তোমার জন্য বেঁচে গেলাম। এবার আমি তোমার বন্ধু হব। হাসি পেল অপুর, বুড়ো শজনেগাছ অপুর বন্ধু।
সেন্ট গ্রেগরিজ উচ্চবিদ্যালয়, ঢাকা
No comments