৭ মার্চ-সামনে লাঠি, পেছনে কামান by আবু সাইয়িদ
সারাদেশের মানুষ ও বিশ্ব তাকিয়ে ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন কি-না। স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।
অন্যদিকে ঘোষণা দিলে পাকিস্তানি হিংস্র কামানের গোলায় লাখো মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অভাবিত ফলাফল রাওয়ালপিন্ডির আর্মি হেডকোয়ার্টারে সামরিক জান্তার সব হিসাব-নিকাশ ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। তিন দিনের মাথায় পরাজয়ের ধাক্কা কাটিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বাইরে বিকল্প পথ অন্বেষায় চক্রটি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এই সমীকরণে যে, কোনোক্রমেই বাঙালি নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া যাবে না। শুরু হয় ত্রিভুজ চক্রান্ত। সামরিক জান্তা, আন্তর্জাতিক চক্র এবং তিনি নিজে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন, যার ফলে আহূত ৩ মার্চের জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে যায়। ১৩ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করে বললেন, 'আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের আপনার কেবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করবেন।'
২৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশন উদ্বোধনের জন্য ঢাকায় আসার বিষয়টি নিশ্চিত ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সবকিছু উল্টেপাল্টে গেল। এর আগে বেসামরিক মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ২২ ফেব্রুয়ারি শীর্ষ পর্যায়ের জেনারেল, গভর্নর এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, 'শুধু পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন কঠোরভাবে আরোপ করা হবে।' জেনারেল পীরজাদা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'পশ্চিম পাকিস্তানে নয় কেন?' আইএসআই প্রধান বলেন, ভুট্টোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ও তরুণ সামরিক অফিসারদের মধ্যে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। প্রধান সেনাপতি জে. হামিদ, গভর্নর আহসান, জে. ইয়াকুব ও পীরজাদার সঙ্গে ইয়াহিয়া খান আলাপ করে বলেন, 'মুজিবের ওপর আমার কোনো বিশ্বাস নেই। তার মাথায় জোরে ধাক্কা দিতে হবে এবং শক্তির মাধ্যমে এমনভাবে ট্রেন চালাতে হবে, যাতে আওয়ামী লীগ ক্রাশ হয়ে যায়।'
বঙ্গবন্ধু এ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে শহীদ মিনারে এক ভাষণে তিনি বলেন, 'সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে তো একদিন মরতেই হয়। বাংলার মানুষকে আমি ডাক দিয়ে যাই, চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হন।' ২৮ ফেব্রুয়ারি সিদ্ধান্ত হয়, অধিবেশন স্থগিত করা হবে। ১ মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে আমরা যখন আসন্ন অধিবেশন সম্পর্কে আলোচনারত ছিলাম, সেদিন দুপুর ১টা ৫ মিনিটে অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা প্রচারিত হয়। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু জানতেন। এ ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে তিনি ঢাকা মহানগরীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার দাবি আরও বেগবান হলো। পুরো প্রশাসন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের করায়ত্ত। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন_ এটাকে তিনি বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেবেন না। কারফিউ জারি হলো। জনগণ কারফিউ ভেঙে ফেলে। ৩ তারিখে ছাত্র জনসভায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা প্রদর্শিত হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা অভিধায় ভূষিত হলেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন হরতাল এবং অসহযোগ কর্মসূচি। বললেন, ৭ তারিখে জনসভায় তার পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। সারাদেশ আন্দোলনে উত্তাল। উচ্চারিত হলো, 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।' এ অবস্থায় গুজব ছড়িয়ে পড়ল, বঙ্গবন্ধু একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। মার্কিন সিক্রেট ডকুমেন্টস বলছে_ এদিন থেকেই পাকিস্তানের দু'অংশের সম্পর্ক শূন্যের কোঠায় নেমে এলো। আরও লক্ষণীয়, ওইদিনই স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটি প্রতিবেদন তৈরি করে এভাবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কি-না।
৬ মার্চ রাতে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটতে থাকে। এক. ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট বললেন, 'যতক্ষণ তিনি সামরিক আইন প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট আছেন ততদিন পর্যন্ত সেনাবাহিনী অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় বদ্ধপরিকর থাকবে।' ওইদিন রাতেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া টেলিফোনে মুজিবের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেন এবং তাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে বলেন, 'এমন পদক্ষেপ যেন তিনি না নেন_ যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।' এরপর তিনি মুজিবের উদ্দেশে টেলিপ্রিন্টারে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। মধ্যরাতে আমার উপস্থিতিতে এ বার্তাটি ঢাকার সামরিক আইন সদর দফতরে পেঁৗছে। পাঠানোর আগে আমি তাড়াতাড়ি পড়ে নিলাম। পরবর্তী সময়ে আমার স্মরণের ওপর নির্ভর করে আমি সেটা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে ফেললাম। বার্তা সম্পর্কে আমার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ আছে : 'অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকায় আসছি এবং আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আপনার আকাঙ্ক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেওয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি মর্যাদা দেব। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে_ যা আপনাকে আপনার ছয় দফা থেকেও বেশি খুশি করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না।' দুই. প্রেসিডেন্ট অন্য একটি বার্তা পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের কাছে পাঠান_ 'আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার উদ্দেশ্যে শক্তি সঞ্চয় করা যায় সেভাবে পরিকল্পনা করো।' তিন. ৬ মার্চ রাতে রমনা রেসকোর্সে ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সজ্জিত বেলুচ রেজিমেন্টকে সতর্ক করে দেওয়া হলো এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে জিওসি মেসেজ পাঠালেন, 'যদি তিনি পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন তাহলে আমি সম্ভাব্য সবকিছুরই সমাবেশ ঘটাব। বিশ্বাসঘাতকদের হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই থাকবে। প্রয়োজন যদি হয়, ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্য কিছু থাকবে না।' চার. অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে সকালে দেখা করেন। রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে আমেরিকার নীতিমালা পরিষ্কার তুলে ধরেন। তিনি মুজিবকে পরামর্শ দেন, 'বিচ্ছিন্নতাবাদী খেলায় সাহায্যের আশায় তিনি যেন ওয়াশিংটনের দিকে না তাকান।' পাঁচ. ৬-৭ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে মিলিট্যান্ট গ্রুপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার অনুরোধ করে।
এ অবস্থায় সারাদেশের মানুষ ও বিশ্ব তাকিয়ে ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন কি-না। স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। অন্যদিকে ঘোষণা দিলে পাকিস্তানি হিংস্র কামানের গোলায় লাখো মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কী করবেন বঙ্গবন্ধু! জনগণের প্রত্যাশা স্বাধীনতা। তার সারা জীবনের লক্ষ্য বাংলার স্বাধীনতা অর্জন। স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা তাকে বলতেই হবে। কোন পথ বেছে নেবেন তিনি? স্বাধীনতা ও মুক্তির দিকনির্দেশনা যেমন ঘোষণা করতে হবে, তেমনি শত্রুপক্ষকে এমন কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না যাতে তারা জনগণের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। সবকিছু মাথায় রেখেই স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তার সারা জীবনের সাধনা, নির্যাতন, কারাবাস, মৃত্যুযন্ত্রণা ও অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বপ্ন পূরণের মুহূর্তগুলো সামনে। এমনই এক ক্রান্তিকালীন সময়ে মহীয়সী সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেসা তার পাশে বসে বললেন, 'তোমার সামনে লাখো জনতা। তাদের হাতে লাঠি। তারা যেন হতাশ না হয়। আবার পেছনে ইয়াহিয়ার কামান। মানুষগুলোর কথা চিন্তা করতে হবে। তোমাকে যে যা-ই বলুক, মন থেকে যা আসবে, সারা জীবন যে স্বপ্ন দেখেছ জনসভায় তা-ই বলবে।' ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ বৈরী পরিবেশে বাংলার স্বাধীনতা তখন চরম মুহূর্তে উত্তেজনায় প্রতীক্ষারত।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ : সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অভাবিত ফলাফল রাওয়ালপিন্ডির আর্মি হেডকোয়ার্টারে সামরিক জান্তার সব হিসাব-নিকাশ ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। তিন দিনের মাথায় পরাজয়ের ধাক্কা কাটিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বাইরে বিকল্প পথ অন্বেষায় চক্রটি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এই সমীকরণে যে, কোনোক্রমেই বাঙালি নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া যাবে না। শুরু হয় ত্রিভুজ চক্রান্ত। সামরিক জান্তা, আন্তর্জাতিক চক্র এবং তিনি নিজে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন, যার ফলে আহূত ৩ মার্চের জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে যায়। ১৩ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করে বললেন, 'আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের আপনার কেবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করবেন।'
২৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশন উদ্বোধনের জন্য ঢাকায় আসার বিষয়টি নিশ্চিত ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সবকিছু উল্টেপাল্টে গেল। এর আগে বেসামরিক মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ২২ ফেব্রুয়ারি শীর্ষ পর্যায়ের জেনারেল, গভর্নর এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, 'শুধু পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন কঠোরভাবে আরোপ করা হবে।' জেনারেল পীরজাদা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'পশ্চিম পাকিস্তানে নয় কেন?' আইএসআই প্রধান বলেন, ভুট্টোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ও তরুণ সামরিক অফিসারদের মধ্যে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। প্রধান সেনাপতি জে. হামিদ, গভর্নর আহসান, জে. ইয়াকুব ও পীরজাদার সঙ্গে ইয়াহিয়া খান আলাপ করে বলেন, 'মুজিবের ওপর আমার কোনো বিশ্বাস নেই। তার মাথায় জোরে ধাক্কা দিতে হবে এবং শক্তির মাধ্যমে এমনভাবে ট্রেন চালাতে হবে, যাতে আওয়ামী লীগ ক্রাশ হয়ে যায়।'
বঙ্গবন্ধু এ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে শহীদ মিনারে এক ভাষণে তিনি বলেন, 'সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে তো একদিন মরতেই হয়। বাংলার মানুষকে আমি ডাক দিয়ে যাই, চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হন।' ২৮ ফেব্রুয়ারি সিদ্ধান্ত হয়, অধিবেশন স্থগিত করা হবে। ১ মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে আমরা যখন আসন্ন অধিবেশন সম্পর্কে আলোচনারত ছিলাম, সেদিন দুপুর ১টা ৫ মিনিটে অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা প্রচারিত হয়। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু জানতেন। এ ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে তিনি ঢাকা মহানগরীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার দাবি আরও বেগবান হলো। পুরো প্রশাসন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের করায়ত্ত। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন_ এটাকে তিনি বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেবেন না। কারফিউ জারি হলো। জনগণ কারফিউ ভেঙে ফেলে। ৩ তারিখে ছাত্র জনসভায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা প্রদর্শিত হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা অভিধায় ভূষিত হলেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন হরতাল এবং অসহযোগ কর্মসূচি। বললেন, ৭ তারিখে জনসভায় তার পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। সারাদেশ আন্দোলনে উত্তাল। উচ্চারিত হলো, 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।' এ অবস্থায় গুজব ছড়িয়ে পড়ল, বঙ্গবন্ধু একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। মার্কিন সিক্রেট ডকুমেন্টস বলছে_ এদিন থেকেই পাকিস্তানের দু'অংশের সম্পর্ক শূন্যের কোঠায় নেমে এলো। আরও লক্ষণীয়, ওইদিনই স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটি প্রতিবেদন তৈরি করে এভাবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কি-না।
৬ মার্চ রাতে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটতে থাকে। এক. ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট বললেন, 'যতক্ষণ তিনি সামরিক আইন প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট আছেন ততদিন পর্যন্ত সেনাবাহিনী অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় বদ্ধপরিকর থাকবে।' ওইদিন রাতেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া টেলিফোনে মুজিবের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেন এবং তাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে বলেন, 'এমন পদক্ষেপ যেন তিনি না নেন_ যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।' এরপর তিনি মুজিবের উদ্দেশে টেলিপ্রিন্টারে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। মধ্যরাতে আমার উপস্থিতিতে এ বার্তাটি ঢাকার সামরিক আইন সদর দফতরে পেঁৗছে। পাঠানোর আগে আমি তাড়াতাড়ি পড়ে নিলাম। পরবর্তী সময়ে আমার স্মরণের ওপর নির্ভর করে আমি সেটা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে ফেললাম। বার্তা সম্পর্কে আমার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ আছে : 'অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকায় আসছি এবং আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আপনার আকাঙ্ক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেওয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি মর্যাদা দেব। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে_ যা আপনাকে আপনার ছয় দফা থেকেও বেশি খুশি করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না।' দুই. প্রেসিডেন্ট অন্য একটি বার্তা পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের কাছে পাঠান_ 'আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার উদ্দেশ্যে শক্তি সঞ্চয় করা যায় সেভাবে পরিকল্পনা করো।' তিন. ৬ মার্চ রাতে রমনা রেসকোর্সে ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সজ্জিত বেলুচ রেজিমেন্টকে সতর্ক করে দেওয়া হলো এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে জিওসি মেসেজ পাঠালেন, 'যদি তিনি পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন তাহলে আমি সম্ভাব্য সবকিছুরই সমাবেশ ঘটাব। বিশ্বাসঘাতকদের হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই থাকবে। প্রয়োজন যদি হয়, ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্য কিছু থাকবে না।' চার. অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে সকালে দেখা করেন। রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে আমেরিকার নীতিমালা পরিষ্কার তুলে ধরেন। তিনি মুজিবকে পরামর্শ দেন, 'বিচ্ছিন্নতাবাদী খেলায় সাহায্যের আশায় তিনি যেন ওয়াশিংটনের দিকে না তাকান।' পাঁচ. ৬-৭ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে মিলিট্যান্ট গ্রুপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার অনুরোধ করে।
এ অবস্থায় সারাদেশের মানুষ ও বিশ্ব তাকিয়ে ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন কি-না। স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। অন্যদিকে ঘোষণা দিলে পাকিস্তানি হিংস্র কামানের গোলায় লাখো মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কী করবেন বঙ্গবন্ধু! জনগণের প্রত্যাশা স্বাধীনতা। তার সারা জীবনের লক্ষ্য বাংলার স্বাধীনতা অর্জন। স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা তাকে বলতেই হবে। কোন পথ বেছে নেবেন তিনি? স্বাধীনতা ও মুক্তির দিকনির্দেশনা যেমন ঘোষণা করতে হবে, তেমনি শত্রুপক্ষকে এমন কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না যাতে তারা জনগণের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। সবকিছু মাথায় রেখেই স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তার সারা জীবনের সাধনা, নির্যাতন, কারাবাস, মৃত্যুযন্ত্রণা ও অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বপ্ন পূরণের মুহূর্তগুলো সামনে। এমনই এক ক্রান্তিকালীন সময়ে মহীয়সী সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেসা তার পাশে বসে বললেন, 'তোমার সামনে লাখো জনতা। তাদের হাতে লাঠি। তারা যেন হতাশ না হয়। আবার পেছনে ইয়াহিয়ার কামান। মানুষগুলোর কথা চিন্তা করতে হবে। তোমাকে যে যা-ই বলুক, মন থেকে যা আসবে, সারা জীবন যে স্বপ্ন দেখেছ জনসভায় তা-ই বলবে।' ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ বৈরী পরিবেশে বাংলার স্বাধীনতা তখন চরম মুহূর্তে উত্তেজনায় প্রতীক্ষারত।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ : সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
No comments