প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন by সরদার সিরাজুল ইসলাম
সদস্যদের শুধু ভয় প্রদর্শনই করা হয়নি,
পবিত্র কোরান স্পর্শ করে বিক্ষোভকারীদের ইচ্ছামতো চলার শপথ করতেও বলা হয়।
পরিষদ কক্ষ থেকে পুলিশের সাহায্যে সদস্যদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময়ও
বিক্ষোভকারীরা অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করে এবং তাদের গাড়ির দিকে ইটপাটকেল
নিক্ষেপ করে যার ফলে গাড়িগুলোর ক্ষতি হয়, কয়েকজন সদস্য আঘাতপ্রাপ্ত হন।
১৪ জন পুলিশ আহত হয় ...।
১৬ মার্চ পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৭ মার্চ ঢাকায় সকল শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রজনসভায়
সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহম্মদ। বক্তৃতা দেন শামসুল
হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব। এই দিন বিকেলে
তাজউদ্দীন আহমদ ও নঈমুদ্দিন আহম্মদদের ওপর গু-ারা হামলা করে, কিন্তু
ঘটনাচক্রে তারা বেঁচে যান। সভায় আসন্ন ঢাকা সফরের সময় জিন্নাহ সাহেবকে
সংবর্ধনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেদিন বিকেলে তাজউদ্দীন আহমদ ১৬ মার্চের
ঘটনাবলীর একটি ব্যাখ্যামূলক বিবৃতি তৈরি করেন।
পাকিস্তানের প্রথম গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ও শেষবারের মতো পূর্ববাংলায় আসেন ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ বিকেলে। তাঁকে রাজকীয় সংŸর্ধনা দেয়া হয়। ২১ মার্চ বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে নাগরিক সংবর্ধনার জবাবে জিন্নাহ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বক্তব্য রাখেন। এতে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তিনি বলেন, “প্রদেশের অধিবাসীরা স্থির করবেন আপনাদের প্রদেশের ভাষা কি হইবে। কিন্তু আমি আপনাদের সুস্পষ্টভাবে বলিতে চাই যে, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে, অন্যকোন ভাষা নহে। একটি রাষ্ট্রভাষা ব্যতীত কোন জাতীয় সংহতি থাকিতে পারে না এবং কাজ করিতে পারে না।”
বিরাট জনসমুদ্রের মাঝেও জিন্নাহ সাহেবের উক্তির প্রতিবাদে ছাত্রদের ‘না না’ ধ্বনি উঠেছিল। ২৪ মার্চ সকালে কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যোগদান করেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা রেসকোর্স বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি করে ভারতের শত্রুতা, পূর্ব বাংলায় মুসলিম পঞ্চমবাহিনীর বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত, মুসলিম লীগের অপরিহার্যতা ইত্যাদি বিষয় ছাড়াও ‘আমার মতে একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা’ ধরনের দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। জিন্নাহ সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে যে উক্তি করেন ছাত্র-জনতা তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, নো, নো ধ্বনির মাধ্যমে। একই দিন সন্ধ্যায় জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাৎদান করেন পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রধান সচিব আজিজ আহম্মদের মিন্টুরোডস্থ বাসভবনে। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহম্মদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, লিলি খান, মোঃ তোয়াহা, আজিজ আহম্মদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহম্মদ, শামসুল আলম ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারে জিন্নাহ সাহেব ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন যে চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তা তিনি মানেন না বলে জানান। জিন্নাহ সাহেবের মতে চুক্তিটি জোর করে নাজিমুদ্দিনের সই নেয়া হয়েছে এবং একতরফাভাবে করা হয়েছে; কেননা, তাতে নাজিমুদ্দিন কি করবেন কেবল তা-ই বলা হয়েছে। অপরপক্ষের কি করণীয়Ñ তার উল্লেখ নেই। জিন্নাহর সঙ্গে প্রতিনিধিদের তুমুল বিতর্ক হয়, কিন্তু জিন্নাহ উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আলোচনার এক পর্যায়ে মাগরিবের আজান হলে শামসুল হক জিন্নাহকে লক্ষ্য করে নামাজের জন্য কিছুক্ষণ আলোচনা স্থগিত রাখার প্রস্তাব করলে জিন্নাহ বিরক্ত হন এই জন্য যে, তিনি নামাজ পড়েন না বলে ভেবেছিলেন ছাত্ররাÑহয়ত তাকে অপদস্ত করার জন্য এই প্রস্তাব করছে। সাক্ষাতকারের সময় কমরুদ্দিন আহম্মদ জিন্নাহর কাছে একটি স্মারক লিপি পেশ করেন। এতে পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ লোকের ভাষা বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়।
২২ মার্চ ঢাকায় জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের এক বিশেষ অধিবেশনে ২১ মার্চ জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সমর্থন জানানো হয়। ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্রের এক সভায় ভাষা প্রশ্নে এম, এ, জিন্নাহর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এতে শামসুল হুদা সভাপতিত্ব করেন এবং মোয়াজ্জম হোসেন চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন, আঃ কুদ্দুস চৌধুরী, ইসমাইল প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন। অপর প্রস্তাবে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং বাংলাকে পূর্ব বাংলার আইন আদালত ও শিক্ষার বাহনরূপে গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়। জিন্নাহ ২৮ মার্চ করাচী ফিরে যান। খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পর আন্দোলন এমনিতে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। জিন্নাহ সাহেব চুক্তিটি অস্বীকার করলেও সে সময় তার জনপ্রিয়তার ফলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন দাঁড় করানো সম্ভব না হলেও জিন্নাহর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। অপরদিকে আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করার ফলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতৃত্বে আন্দোলন এগিয়ে চলে; কেননা, তমুদ্দীন মজলিশ ইতিমধ্যেই আন্দোলনে কমিউনিস্টদের হাত আছে আবিষ্কার করে আন্দোলন থেকে পিছুটান দেয়।
১ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ পরিষদের মুসলীম লীগ দলীয় পার্লামেন্টারি বৈঠকের সভায় বাংলাকে পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা এবং ইংরেজীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ৮ এপ্রিল তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবটির ওপর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পরিষদকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানান। কিন্তু মুসলিম লীগ সদস্য আব্দুল বারী, শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদ, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর বিরোধিতার ফলে তা অগ্রাহ্য হয়। এছাড়া আব্দুস সবুর খান ও হাবিবুলাহ বাহার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করে পরিষদে ভাষণ দেন।
১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার কার্জন হলে পূর্ব বাংলার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের (১৯০৬-৬৬) উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমদিনের সভায় মূল সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায়, ভাষায় এমন বাঙালিত্বের ছাপ মেরে ছিয়েছেন যে মালা তিলক-টিকিতে কিংবা ধুতি- লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার যো নেই।” সভায় অন্যান্যের মধ্যে ভাষণ দেন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হাবিবুল্লাহ বাহার, সম্পাদক অজিত গুহ ও সৈয়দ আলী আশরাফ। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি জসীমউদ্দীন বেগম শামসুন নাহার, আবুল হাসনাত, অধ্যক্ষ শরফুদ্দিন, ত্রিপুরা শংকর সেন শাস্ত্রী, ড. এস আর খাস্তগীর, ড. আব্দুল ওয়াহেদ, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ।
১৯৪৮ সালের ১৮ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসেন। সে সময় ঢাকা শহরের ছাত্ররা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল। ২১ নবেম্বর রাজশাহী সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় যার ফলে মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা গোলাম রহমানকে রাজশাহী থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতন চলে। বেগম রানা লিয়াকত আলী মিটফোর্ড স্কুল ও হাসপাতাল পরিদর্শনকালে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার অপরাধে মুসলিম ছাত্রলীগ কর্মী আলী আহম্মদকে মিডফোর্ড স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২৭ নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া মানপত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। ইতিপূর্বে ১৭ নবেম্বর আতউর রহমান খানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভায় আজিজ আহম্মদ, আবুল কাসেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কমরুদ্দিন আহম্মদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান প্রমুখ স্মারকলিপি প্রদান করেন। (যা পাকিমন্ত্রী ঢাকা আসলে দেয়া হয় )
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রগতিশীল ছাত্র ও যুবকর্মীদের ওপর সরকারী নির্যাতন শুরু হয়। ঢাকাসহ প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত ছাত্রকে জেলে পাঠানো হয় ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম ছাত্রলীগ ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করে। এই উপলক্ষে এই ইশতেহারে খুলনা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রেফতার, পরোয়ানা ও বহিষ্কার আদেশ জারির মাধ্যমে যেসব ছাত্রের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তার একটি তালিকা প্রণয়ন করে জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালনের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, “এরা ছাত্রলীগের সুপরিচিত ছাত্রকর্মী সংগ্রামের পুরোভাবে ছিল। এদের ওপর দমন নীতি চালানোর কারণ এরা শিক্ষা সংস্কার চায়, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অবসান চায়। এরা ভারতে বেআইনী খাদ্যশস্য পাচারে বাধা দেয়। দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা আজ ভাঙ্গনের মুখে ছাত্র আছে, ছাত্রবাস নেই, স্কুল-কলেজ আছে শিক্ষক নেই। যে কয়জন শিক্ষক আছে তাদের পেটে ভাত, পরনে কাপড় নেই। শিক্ষা দফতর আছে, প্রসারের চেষ্টা নেই, দফতর আছে কিন্তু দফতরখানায় বাংলা ভাষা কমিটি ও ইনঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের ফাইল নেই। ছাত্ররা যখনই বলেন শিক্ষা সংকোচন চলবে না তখন ফতোয়া দেয়া হয়, “সব ঠিক হ্যায় ছাত্রলীগ গোলমাল করতা হ্যায়।” ছাত্ররা যখনই মুখ খোলেন তখন তাদের রাষ্ট্রের দুশমন বলা হয়।”
জুলুম-প্রতিরোধ দিবসকে ছাত্র ফেডারেশন সমর্থন করে, কিন্তু সরকারী ছাত্রলীগ দিবসটি বানচালের চেষ্টা করে। এই দিন ঢাকাসহ প্রদেশের সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। দুপুরে ছাত্রলীগ সভাপতি নজিম উদ্দিন আহম্মদের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও দবিরুল ইসলাম বক্তৃতা দেন। এই সময় সাংগঠনিক সফরে শেখ মুজিব, আবদুল হামিদ চৌধুরী ও আবদুল আজিজ দিনাজপুর পৌঁছালে জেলা প্রশাসকের আদেশে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের দিনাজপুর ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়। (চলবে)
পাকিস্তানের প্রথম গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ও শেষবারের মতো পূর্ববাংলায় আসেন ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ বিকেলে। তাঁকে রাজকীয় সংŸর্ধনা দেয়া হয়। ২১ মার্চ বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে নাগরিক সংবর্ধনার জবাবে জিন্নাহ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বক্তব্য রাখেন। এতে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তিনি বলেন, “প্রদেশের অধিবাসীরা স্থির করবেন আপনাদের প্রদেশের ভাষা কি হইবে। কিন্তু আমি আপনাদের সুস্পষ্টভাবে বলিতে চাই যে, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে, অন্যকোন ভাষা নহে। একটি রাষ্ট্রভাষা ব্যতীত কোন জাতীয় সংহতি থাকিতে পারে না এবং কাজ করিতে পারে না।”
বিরাট জনসমুদ্রের মাঝেও জিন্নাহ সাহেবের উক্তির প্রতিবাদে ছাত্রদের ‘না না’ ধ্বনি উঠেছিল। ২৪ মার্চ সকালে কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যোগদান করেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা রেসকোর্স বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি করে ভারতের শত্রুতা, পূর্ব বাংলায় মুসলিম পঞ্চমবাহিনীর বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত, মুসলিম লীগের অপরিহার্যতা ইত্যাদি বিষয় ছাড়াও ‘আমার মতে একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা’ ধরনের দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। জিন্নাহ সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে যে উক্তি করেন ছাত্র-জনতা তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, নো, নো ধ্বনির মাধ্যমে। একই দিন সন্ধ্যায় জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাৎদান করেন পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রধান সচিব আজিজ আহম্মদের মিন্টুরোডস্থ বাসভবনে। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহম্মদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, লিলি খান, মোঃ তোয়াহা, আজিজ আহম্মদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহম্মদ, শামসুল আলম ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারে জিন্নাহ সাহেব ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন যে চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তা তিনি মানেন না বলে জানান। জিন্নাহ সাহেবের মতে চুক্তিটি জোর করে নাজিমুদ্দিনের সই নেয়া হয়েছে এবং একতরফাভাবে করা হয়েছে; কেননা, তাতে নাজিমুদ্দিন কি করবেন কেবল তা-ই বলা হয়েছে। অপরপক্ষের কি করণীয়Ñ তার উল্লেখ নেই। জিন্নাহর সঙ্গে প্রতিনিধিদের তুমুল বিতর্ক হয়, কিন্তু জিন্নাহ উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আলোচনার এক পর্যায়ে মাগরিবের আজান হলে শামসুল হক জিন্নাহকে লক্ষ্য করে নামাজের জন্য কিছুক্ষণ আলোচনা স্থগিত রাখার প্রস্তাব করলে জিন্নাহ বিরক্ত হন এই জন্য যে, তিনি নামাজ পড়েন না বলে ভেবেছিলেন ছাত্ররাÑহয়ত তাকে অপদস্ত করার জন্য এই প্রস্তাব করছে। সাক্ষাতকারের সময় কমরুদ্দিন আহম্মদ জিন্নাহর কাছে একটি স্মারক লিপি পেশ করেন। এতে পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ লোকের ভাষা বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়।
২২ মার্চ ঢাকায় জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের এক বিশেষ অধিবেশনে ২১ মার্চ জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সমর্থন জানানো হয়। ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্রের এক সভায় ভাষা প্রশ্নে এম, এ, জিন্নাহর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এতে শামসুল হুদা সভাপতিত্ব করেন এবং মোয়াজ্জম হোসেন চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন, আঃ কুদ্দুস চৌধুরী, ইসমাইল প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন। অপর প্রস্তাবে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং বাংলাকে পূর্ব বাংলার আইন আদালত ও শিক্ষার বাহনরূপে গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়। জিন্নাহ ২৮ মার্চ করাচী ফিরে যান। খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পর আন্দোলন এমনিতে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। জিন্নাহ সাহেব চুক্তিটি অস্বীকার করলেও সে সময় তার জনপ্রিয়তার ফলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন দাঁড় করানো সম্ভব না হলেও জিন্নাহর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। অপরদিকে আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করার ফলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতৃত্বে আন্দোলন এগিয়ে চলে; কেননা, তমুদ্দীন মজলিশ ইতিমধ্যেই আন্দোলনে কমিউনিস্টদের হাত আছে আবিষ্কার করে আন্দোলন থেকে পিছুটান দেয়।
১ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ পরিষদের মুসলীম লীগ দলীয় পার্লামেন্টারি বৈঠকের সভায় বাংলাকে পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা এবং ইংরেজীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ৮ এপ্রিল তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবটির ওপর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পরিষদকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানান। কিন্তু মুসলিম লীগ সদস্য আব্দুল বারী, শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদ, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর বিরোধিতার ফলে তা অগ্রাহ্য হয়। এছাড়া আব্দুস সবুর খান ও হাবিবুলাহ বাহার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করে পরিষদে ভাষণ দেন।
১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার কার্জন হলে পূর্ব বাংলার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের (১৯০৬-৬৬) উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমদিনের সভায় মূল সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায়, ভাষায় এমন বাঙালিত্বের ছাপ মেরে ছিয়েছেন যে মালা তিলক-টিকিতে কিংবা ধুতি- লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার যো নেই।” সভায় অন্যান্যের মধ্যে ভাষণ দেন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হাবিবুল্লাহ বাহার, সম্পাদক অজিত গুহ ও সৈয়দ আলী আশরাফ। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি জসীমউদ্দীন বেগম শামসুন নাহার, আবুল হাসনাত, অধ্যক্ষ শরফুদ্দিন, ত্রিপুরা শংকর সেন শাস্ত্রী, ড. এস আর খাস্তগীর, ড. আব্দুল ওয়াহেদ, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ।
১৯৪৮ সালের ১৮ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসেন। সে সময় ঢাকা শহরের ছাত্ররা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল। ২১ নবেম্বর রাজশাহী সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় যার ফলে মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা গোলাম রহমানকে রাজশাহী থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতন চলে। বেগম রানা লিয়াকত আলী মিটফোর্ড স্কুল ও হাসপাতাল পরিদর্শনকালে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার অপরাধে মুসলিম ছাত্রলীগ কর্মী আলী আহম্মদকে মিডফোর্ড স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২৭ নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া মানপত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। ইতিপূর্বে ১৭ নবেম্বর আতউর রহমান খানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভায় আজিজ আহম্মদ, আবুল কাসেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কমরুদ্দিন আহম্মদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান প্রমুখ স্মারকলিপি প্রদান করেন। (যা পাকিমন্ত্রী ঢাকা আসলে দেয়া হয় )
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রগতিশীল ছাত্র ও যুবকর্মীদের ওপর সরকারী নির্যাতন শুরু হয়। ঢাকাসহ প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত ছাত্রকে জেলে পাঠানো হয় ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম ছাত্রলীগ ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করে। এই উপলক্ষে এই ইশতেহারে খুলনা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রেফতার, পরোয়ানা ও বহিষ্কার আদেশ জারির মাধ্যমে যেসব ছাত্রের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তার একটি তালিকা প্রণয়ন করে জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালনের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, “এরা ছাত্রলীগের সুপরিচিত ছাত্রকর্মী সংগ্রামের পুরোভাবে ছিল। এদের ওপর দমন নীতি চালানোর কারণ এরা শিক্ষা সংস্কার চায়, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অবসান চায়। এরা ভারতে বেআইনী খাদ্যশস্য পাচারে বাধা দেয়। দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা আজ ভাঙ্গনের মুখে ছাত্র আছে, ছাত্রবাস নেই, স্কুল-কলেজ আছে শিক্ষক নেই। যে কয়জন শিক্ষক আছে তাদের পেটে ভাত, পরনে কাপড় নেই। শিক্ষা দফতর আছে, প্রসারের চেষ্টা নেই, দফতর আছে কিন্তু দফতরখানায় বাংলা ভাষা কমিটি ও ইনঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের ফাইল নেই। ছাত্ররা যখনই বলেন শিক্ষা সংকোচন চলবে না তখন ফতোয়া দেয়া হয়, “সব ঠিক হ্যায় ছাত্রলীগ গোলমাল করতা হ্যায়।” ছাত্ররা যখনই মুখ খোলেন তখন তাদের রাষ্ট্রের দুশমন বলা হয়।”
জুলুম-প্রতিরোধ দিবসকে ছাত্র ফেডারেশন সমর্থন করে, কিন্তু সরকারী ছাত্রলীগ দিবসটি বানচালের চেষ্টা করে। এই দিন ঢাকাসহ প্রদেশের সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। দুপুরে ছাত্রলীগ সভাপতি নজিম উদ্দিন আহম্মদের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও দবিরুল ইসলাম বক্তৃতা দেন। এই সময় সাংগঠনিক সফরে শেখ মুজিব, আবদুল হামিদ চৌধুরী ও আবদুল আজিজ দিনাজপুর পৌঁছালে জেলা প্রশাসকের আদেশে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের দিনাজপুর ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়। (চলবে)
No comments