বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্র by এ এম এম শওকত আলী

বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বহুবিধ দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। এর শুরু হয় প্রথমে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে। প্রাথমিকভাবে প্রধানমন্ত্রী সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ওই সময় তিনি এ কথাও বলেন, আইন ও বিধি যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যাহত করে, তাহলে সচিবরা যেন বিষয়টি তাঁর নজরে নিয়ে আসেন।


তিনি আরো প্রতিশ্রুতি দেন, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট আইন বা বিধি সংশোধন করা হবে। এ পর্যন্ত কয়টি এ ধরনের আইন বা বিধি তাঁর গোচরীভূত করা হয়েছে, তা জানা নেই। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অধিকতর সচল করতে তিনি দরপত্র আহ্বান ও চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়ায় যে বিধিগত সমস্যা ছিল, তা সংশোধন করেছেন। অন্য একটি ক্ষেত্র একই বিষয়ে_খাদ্যশস্য ক্রয়-সংক্রান্ত। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জরুরি প্রয়োজনে ক্রয়-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্যদের মধ্যে সার্কুলেশনের মাধ্যমে করা যাবে। উল্লেখ্য, মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সব বিষয়েই এ ধরনের বিধান সরকারি কার্য সম্পাদন বিধিমালায় বলা আছে। এরই ধারাবাহিকতায় অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে ক্রয়-সংক্রান্ত প্রস্তাব একই নীতিতে অতীতেও গ্রহণ করা হতো। এর জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো সভা আহ্বানের প্রয়োজন ছিল না। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ত্বরিত হতো। কাজেই এর জন্য নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি এটাই অতীতের নিয়ম হয়, তাহলে কেন নতুন করে আবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। নিন্দুকরা বলবেন, এটা নিছক প্রচারের জন্য করা হয়েছে। তবে বিষয়টি অন্য দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব এবং প্রয়োজনও। যেকোনো সরকারি ক্রয়ের প্রস্তাব অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পর এসব বিষয়ে দুর্নীতি-সংক্রান্ত মামলাও হয়েছে। এসব মামলায় প্রধানমন্ত্রীসহ ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্য এবং সভায় উপস্থিত সচিবরাও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। এ ধরনের মামলা রুজু করা কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে, তা আদালতই বিবেচনা করবেন। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ ধরনের বেশির ভাগ মামলা উচ্চতর আদালতে টেকেনি।
চলমান দিক নির্দেশনা প্রদানের প্রক্রিয়ায় সরকারি কার্য সম্পাদনে দক্ষতা বৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে কি না, তা জনগণই বিচার করবে। এ ধরনের নির্দেশনা সাম্প্রতিককালে উপদেষ্টাসহ মন্ত্রীরাও দিচ্ছেন। প্রশাসনের রাজনীতিকায়নের কথা বহুদিন ধরেই মিডিয়াসহ নাগরিক সমাজ ও গবেষকরা বলে আসছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি যথারীতি অস্বীকার করা হয়। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি মূল দর্শন হলো, প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। কারণ তা না হলে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়। দৈনন্দিন শাসন প্রক্রিয়ায়ও ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়। কিছুদিন পূর্বে জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও বদলির সিদ্ধান্তকে মিডিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। অবশ্য এ ধারা বহুদিন ধরেই পরিলক্ষিত হয়। ওই সময় বিষয়টি অস্বীকার করে একজন উপদেষ্টা বলেছিলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয়, এমন কোনো কর্মকর্তা পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। এ বিষয়টিও মিডিয়ায় বিতর্কিত হয়। বলা বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয় এমন চাকরিজীবী কি আছেন?
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয়, কিছু এমন সরকারি চাকরিজীবী এখনো রয়েছেন, তাহলে বলা যায়, এর প্রমাণ কী? যখন কোনো ব্যক্তি সরকারি কর্মকর্তা হন, বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিসে, তখন নিয়োগের পূর্বে তাঁর অতীত কার্যকলাপ পুলিশের বিশেষ বিভাগ যাচাই করে। এটাই চিরাচরিত নিয়ম। এর পরও যদি কোনো ব্যক্তি নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাহলে দেশের প্রতি তাঁর আনুগত্য হবে প্রশ্নাতীত। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন কোনো ব্যক্তির অনুমাননির্ভর উক্তির মাধ্যমে যোগ্যতা সাপেক্ষে ওই ব্যক্তির অবশ্যই পদোন্নতি পাওয়া উচিত। স্মরণ করা যেতে পারে, সরকার পরিবর্তনের পরই পুলিশ বিভাগের প্রাথমিক নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদানের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, পরবর্তীকালে হাইকোর্টের রায়ের বলে তাঁরা পুনরায় নিয়োগ লাভ করেন। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি মুখ্য তা হলো, একদল ক্ষমতায় থাকাকালে কেউ পদোন্নতি লাভ করলে পরবর্তীকালে অন্য দল ক্ষমতায় এসে মনে করে, ওই কর্মকর্তা অবশ্যই বিরোধী দলের প্রতি অনুগত। এ ধরনের নিছক অনুমাননির্ভর ব্যক্তিগত ধারণার ভিত্তিতেই যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। এটাই বাস্তব সত্য।
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী সরকারি কার্য সম্পাদনে দক্ষতা বৃদ্ধির একটি সংস্কারমূলক পদক্ষেপের কথা বলেছেন। তাঁর ধারণা, এ জন্য প্রয়োজন 'বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্র'। 'বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্র' কায়েম করলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে গতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বিশ্বস্ততা একমুখী কখনো হতে পারে না। যদি হয়, তাহলে সেটা হবে যান্ত্রিক প্রশাসন, যা কখনো জনস্বার্থ রক্ষায় কোনো কাজেই আসবে না। অথচ জনপ্রশাসনের মূলমন্ত্রই হলো জনস্বার্থ সুরক্ষায় প্রশাসনিক কাজ সম্পাদন করা। মিডিয়ায় প্রচারিত মন্ত্রীর এই উক্তি যদি সত্য হয়, তাহলে নিশ্চয়ই আশঙ্কার কারণ হবে। প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রী বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের উন্নয়ন ও সেবামূলক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়, যদি না 'বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্র' না থাকে। প্রশ্ন হলো, দেশ গড়ার কাজে 'বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্র' কি একমাত্র রক্ষাকবচ, নাকি নির্দলীয় দক্ষ আমলাতন্ত্র।
মন্ত্রীর কথিত উক্তি নব্বইয়ের দশকের যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের শাসনকালের একটি ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই প্রধানমন্ত্রীর নীতি সম্পর্কিত ইউনিটের সাবেক প্রধান (ঐবধফ ড়ভ চড়ষরপু টহরঃ) স্যার জন হসকিনস এমনই একটি প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর মতে, জনপ্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে শতকরা ২০ ভাগের ঊধর্ে্ব নয়। এমন সব পদে অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। যুক্তি একই। অরাজনৈতিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন মতাদর্শের দলীয় সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। এ ধরনের কর্মকর্তাদের কোনো 'কমিটমেন্ট' নেই। তাঁদের অরাজনৈতিক মতাদর্শ ক্ষমতাসীন দলের উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করে। যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্যার ডগলাস ওয়েস এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। লৌহ মানবী হিসেবে খ্যাত মার্গারেট থ্যাচার শেষ পর্যন্ত এ ধারণাকে বাস্তবায়ন করেননি। এর সুফল সংরক্ষণশীল দলই (ঈড়হংবৎাধঃরাব চধৎঃু) ভোগ করেছিল। এই দলের নেতা হিসেবে থ্যাচার একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনার পরও পুনরায় তাঁর দলই ক্ষমতায় আসে। জন মেজর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তখন কাজ করেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও একই ধারা দৃশ্যমান। মূলকথা হলো, দলীয় প্রশাসনযন্ত্র নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের সক্ষমতাই সাফল্য অর্জনে সহায়ক শক্তির প্রধান উৎস।
বহুদলীয় এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রথায় বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্রের অবস্থান নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। এ প্রথার মধ্যেই বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্র অবস্থান করে। এক দল ক্ষমতায় আসার পর অন্য দল ক্ষমতায় আসে। আমলাতন্ত্র সব ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই কাজ করে। কারণ আমলাদের প্রাথমিক নিয়োগের পর যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেই প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দলমত নির্বিশেষে নিরপেক্ষতার সঙ্গে ক্ষমতাসীন সব দলের জন্যই কাজ করতে হবে। এ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় তখনই, যখন রাজনৈতিক প্রশাসন আইন-কানুন ও বিধি উপেক্ষা করে এমন সব সিদ্ধান্ত দেয়, যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ওই সময়ই রাজনৈতিক প্রশাসন আমলাদের বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আলোচ্য বিষয়ে আরো উল্লেখ করা যায়, উচ্চ বা গুরুত্বপূর্ণ পদে ক্ষমতাসীন সরকারই নিজ ধারণা অনুযায়ী আমলাদের নিয়োগ করে। তারা এটা খোঁজ-খবর নিয়েই করে। এ ছাড়া পদোন্নতির ব্যাপারেও আমলাদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই তাঁদের পদোন্নতি দেয়। এর পরও কেন বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্র প্রয়োজন, তা বোধগম্য নয়। বর্তমানে যে বিষয়টি দৃশ্যমান, তা হলো, সব মন্ত্রণালয়ই দক্ষভাবে কাজ করে না। দুই বা তিনটি মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য মন্ত্রণালয়ের কাজে গতিশীলতা নেই। এ বিষয়টি সবাই বিশ্বাস করেন। এর অর্থ এই নয়, নগণ্য সংখ্যক গতিশীল মন্ত্রণালয়ে বিশ্বস্ত আমলা কাজ করছেন। ওই সব মন্ত্রণালয়ে আমলাতন্ত্র এবং ক্ষমতাসীন মন্ত্রীরা বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন। এ জন্য প্রয়োজন বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্র নয়, বরং দক্ষ আমলাতন্ত্র এবং দক্ষ মন্ত্রী।
১৯৯১-পরবর্তীকাল থেকেই ক্ষমতাসীন সরকার পরিবর্তন হলে শুরু হয় ব্যাপক হারে বদলি। বিশ্বস্ত আমলা নিয়োগের জন্য এ পদ্ধতিতে সব ক্ষমতাসীন দলই কম-বেশি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। মিডিয়ায় এ নিয়ে বহু লেখালেখি হলেও এই প্রবণতা বন্ধ হয়নি। এর ফলে সব সরকারই বিশ্বস্ত আমলাতন্ত্রের স্থলে বশংবদ আমলার সেবা গ্রহণ করেছে। ফলে দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে। তবে এ ধরনের মন্তব্য ঢালাওভাবে করা সঠিক নয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে নগণ্য সংখ্যক আমলা সব সরকারের জন্যও যে কাজ করেছে, এমন নজিরও রয়েছে। যে কথাটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তা হলো, ঘন ঘন বদলি, পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত এবং ওএসডি হওয়ায় আমলারা একাগ্রচিত্তে কাজ করতে ব্যর্থ।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.