আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৩৯)-মায়ের ছোঁয়া গন্ধ আছে মা কোথাও নেই by আলী যাকের
ফিরে যাই সেই ১৯৬৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুরে। ধূপখোলা মাঠের পশ্চিমে আমবাগানের মাঝখানে আমার একটি প্রিয় গাছের ডালে বসে আমি পা দোলাচ্ছি আর নানাবিধ চিন্তা আমার মনে খেলা করছে। ভাবছি অত্যাসন্ন সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার কথা। ইংরেজি সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক ইংরেজি_তিনটি বিষয়ে পাঁচটি পেপার একসঙ্গে দিতে হবে।
ভালো করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পাস করলেই হলো। অনার্স পরীক্ষায় নির্ণয় করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমার যোগ্যতা। কিন্তু আমার ঐচ্ছিক বিষয়গুলোর মধ্যে ইংরেজি সাহিত্য যে রয়েছে! ওই দুটি পেপারে আমাকে যে ভালো করতেই হবে। নিদেনপক্ষে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর সাজ্জাদ হোসেনের কাছে প্রমাণ করতে হবে, বিষয়টিতে আমি তত খারাপ নই। ওই বয়সে কত বালখিল্য জেদ মানুষের মনের ভেতরে খেলা করে! তবে বিশেষ সময়ের সব চিন্তাই সেই বিশেষ সময়ের জন্য অবশ্যই অবধারিত সত্য হিসেবে মূল্যায়িত হতে পারে। আরো ভাবছি, মা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। দিদির চিঠিতে যেমন পড়লাম, কিন্তু আমার মনটা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠছে না কেন? তবুও মা ফিরছেন। দিদি কিছু কাজকর্মের ফর্দ লিখে পাঠিয়েছেন তাঁর পোস্টকার্ডে। সেগুলো অবিলম্বে করা দরকার। অতএব গাছের ওপর থেকে লাফ দিয়ে নামলাম এবং অনেকটা শ্লথভাবে বাড়ির পথে রওনা হলাম। দুপুর তখন দেড়টা। একেবারে মাথার ওপর গনগনে সূর্য। পথে দীননাথ সেন রোডের মুখে ঠাকুরের দোকানে তখন ঠাকুর তাঁর বৈকালিক শিঙ্গাড়ার আয়োজন নিয়ে বসেছেন। আমাকে দেখে বললেন, 'এক পেয়ালা চা খাবি?' এমন স্নেহমাখা আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা শক্ত। আমি তাঁর দোকানের সামনে ঝাঁপের ছায়ায় রাখা বেঞ্চির ওপরে বসে বললাম, 'দাও'। চায়ে এক চুমুক দিয়েছি, ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, 'মা আইব?' লক্ষণীয়, প্রশ্নটা করা যেত 'মা কবে আসবেন'_এই বাক্যে কিন্তু প্রশ্নটা ঠাকুর আমায় করলেন 'মা আসবেন?' আমি বললাম, 'হ্যাঁ, শিগগিরই।' তারপর দাম চুকাতে গেলে ঠাকুর বললেন, 'লাগব না।' আমি আবার বাড়ির পথে শ্লথ পদক্ষেপে রওনা হলাম। মিনিট তিন-চারেক হাঁটার পর রাস্তার একটা ছোট বাঁক পেরোলেই আমাদের বাড়ির গেট দেখা যায়। সোজা তাকিয়ে দেখি, আমার বড় মামার সবুজ অস্টিন গাড়িটা আমাদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কেন জানি না বুকটা ধক্ করে উঠল। অথচ স্বাভাবিক হতো এই ভাবা যে মায়ের ফিরে আসার কথা তিনি নিশ্চয়ই জেনেছেন এবং সব বন্দোবস্ত ঠিকঠাক আছে কি না সে বিষয়ে খবরাখবর নেওয়ার জন্য আমাদের বাড়িতে এসেছেন। তাহলে? আমি বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে আমাদের বসার ঘরে বড় মামা এবং মামিকে দেখতে পেলাম ম্লান মুখে বসে আছেন। আমি আজও জানি না, কেন আমার প্রথম বাক্যটি ছিল, 'কখন মারা গেছে?' মামা আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বোধ হয় আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, 'আজ সকালে।' তিনি টেলিফোনে খবর পেয়েছেন। কলকাতা থেকে আমার মেজমামা ফোন করে তাঁকে জানিয়েছেন। আমি ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়লাম। আজ মনে হয়, মামা ও মামির একসঙ্গে কেবল আমাকে সংবাদটি দেওয়ার জন্য আসার কোনো দরকার ছিল না। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন আমি শোকে উন্মত্ত হয়ে উঠব। হয়তো আমাকে সামলানোর জন্য তাঁদের উভয়ের উপস্থিতির প্রয়োজন আছে। অবাক কাণ্ড, আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি ঝরল না। আমি অবিলম্বে করণীয় সব কিছু তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি কাগজে লিখে ফেললাম। বড় মামার ইচ্ছে চাষাঢ়ায় তাদের বাড়ির উল্টোদিকের কবরস্থানে মায়ের কবর দেওয়ার। এ বিষয়ে আমাদের ভাইবোনদের কারোরই আপত্তি থাকার কারণ ছিল না। এর পরের দুই দিন যেন ঝড় বয়ে গেল আমার মাথার ওপর দিয়ে। ভাইয়া, আমার বড়ভাই খবর পেয়ে এলেন যশোর থেকে। এমন উদ্ভ্রান্ত তাঁকে আমি দেখিনি কখনো। আমার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান আজ মাতৃহারা। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করিনি, কিন্তু তাঁকে দেখে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো প্রথমবারের মতো অশ্রু ঝরতে লাগল আমার। মনে পড়ছিল যশোর স্টেশনে মাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সেই স্যালুট দেওয়ার কথা। মনে পড়ছিল মায়ের স্নেহভরা চোখ। বুকের ভেতর কোথায় যেন খাঁখাঁ করে উঠল। সব বন্দোবস্ত হয়ে গেলে একটা ট্রাকে করে মাকে নিয়ে যখন চাষাঢ়ায় গোরস্তানের দিকে যাচ্ছিলাম তখন কিছুতেই কান্না রুখতে পারলাম না। ট্রাকের মধ্যে অনেকেই আমায় সান্ত্বনা দিচ্ছিল। আমার সেটা অসহ্য লাগছিল। আমি এটা লক্ষ করেছি যে আমি যখন চরম শোকে নিমজ্জিত তখন যেকোনো কথাই বিরক্তির সৃষ্টি করে। একেবারে চুপচাপ থাকাটাই বোধ হয় শ্রেয়। সেই কারণে আমার কোনো কাছের মানুষের শোকের সময় আমি কথা বলা থেকে বিরত থাকি। এর পরের দিনগুলো আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠল আমার জন্য। বাড়ির সবখানেই মায়ের ছোঁয়া, গন্ধ আছে, কিন্তু মা কোথাও নেই। এই সময় আমার গেণ্ডারিয়ার সব বন্ধু প্রায় সার্বক্ষণিক সাহচর্য দিয়েছে আমাকে। আস্তে আস্তে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের ভিড় কমে এল। আমরা মা-হীন এক অনভ্যস্ত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments