চরাচর-রাখালরাজার টুঙ্গিপাড়া by ফখরে আলম
ছোট্ট গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। সবুজ ছায়াঘেরা এই ছোট গ্রামে একজন বড় মানুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাংলার রাখালরাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ কারণে ছোট গ্রাম দেশের সবচেয়ে বড় গ্রামের মর্যাদা লাভ করেছে। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ এ গ্রামে আসেন। বড় মানুষের সমাধির পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
টুঙ্গিপাড়ার মাটি স্পর্শ করেন। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর নাড়িপোঁতা মাটি কাগজে মুড়ে বাড়ি নিয়ে যান। গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের ঐতিহাসিক গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। তালবীথি আর সবুজ ধানক্ষেত গ্রামকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। রোদের আলোয় টুঙ্গিপাড়া রুপোর মতো জ্বলে ওঠে। টিনের ঘরগুলো রোদ্দুরে রুপোর মতোই চিক চিক করে। গ্রামের ভেতর দিয়ে মাকড়সার জালের মতো সব পথ এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আবার এক হয়েছে। ছোট্ট এই গ্রামে কয়েক শ মানুষ বসবাস করে। গ্রামটি পাটগাতি ইউনিয়নের অধীন। কিন্তু এ গ্রামের নামেই উপজেলা সদরের নাম হয়েছে টুঙ্গিপাড়া। ১২৭ বর্গকিলোমিটারের আয়তনের এই উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। টিনের চৌয়ারি ঘরে বাবা শেখ লুৎফুর রহমান সন্তানের জন্মগ্রহণের সংবাদ শুনে আজান দিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ার আলো-হাওয়া-কাদামাটিতে হেসে-খেলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শৈশব-কৈশোর উত্তীর্ণ করেছেন। টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। টুঙ্গিপাড়ার মানুষ মহানায়কের জন্মতীর্থের কারণে গর্ববোধ করেন। আবার ওই মহানায়ককে তাঁর জন্মভূমিতে সমাহিত করার জন্যও তাঁদের অহংকারের শেষ নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশী, ছেলেবেলার খেলার সাথিরা তাঁদের প্রিয় মিয়া ভাইকে জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় মা-বাবার কবরের পাশে সমাহিত করেন। ছায়াঘেরা, স্মৃতিঘেরা সেই প্রিয় গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমিয়ে আছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাধিসৌধের উদ্বোধন করেন। ৩৮.৩০ একর আয়তনের এই সমাধিসৌধের নির্মাণে খরচ হয় ১৭ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। সমাধি কমপ্লেঙ্রে মধ্যে রয়েছে পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনী হল, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ব্লক, মসজিদ, উন্মুক্ত মঞ্চ, স্যুভেনির শপ ও তথ্যকেন্দ্র। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার সার্ভিসেস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড সমাধিসৌধের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে_প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেড, আবদুল মোনেম লিমিটেড, শখ নার্সারি, মেসার্স ইলিয়াস হোসেন, ইমামবাড়ি ট্রেডার্স লিমিটেড, প্রকৌশলী নির্মাণ বিশারদ ও ডিসেন্ট কনস্ট্রাকশন। সিরামিক ইট, সাদা-কালো টাইলস দিয়ে নির্মিত নয়নাভিরাম সমাধিসৌধের স্থাপত্যশৈলীতে ফুটে উঠেছে বিউগলের সুর ও বেদনার চিত্র। সমাধিসৌধের দুই পাশের উদ্যান ছাড়িয়ে হাজার গজ এগোনোর পর বঙ্গবন্ধুর কবর। পাশে তাঁর মা-বাবার কবর। এই তিন কবর ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে মূল সমাধিসৌধ। সাদা পাথরে নির্মিত গোলাকার একগম্বুজবিশিষ্ট সমাধিসৌধের চারপাশের দেয়ালে জাফরি কাটা। এই জাফরি দিয়ে সূর্যের আলো আসে। সেই আলোয় উদ্ভাসিত হয় বঙ্গবন্ধুর কবর। সূর্যের কিরণমাখা সেই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশের মানুষ।
ফখরে আলম
ফখরে আলম
No comments