লোডশেডিং রেকর্ড ভাঙতে চলেছে- শীঘ্র সঙ্কট কমার সম্ভাবনা নেই by রশিদ মামুন

তীব্র তাপদাহ শুরুর আগেই গ্রীষ্মে বিদ্যুত সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
সরকারী হিসেবেই চাহিদার তুলনায় প্রায় দু'হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কম হওয়ায় গ্রীষ্মে বিদ্যুত সঙ্কট কমার কোন সম্ভাবনা নেই বরং লোডশেডিং অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করতে চলছে। রাজধানীর কিছু এলাকায় আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি স্কিম বসানোতে লোড (চাপ) বৃদ্ধি পেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুত চলে যাচ্ছে। গ্রাহক ভোগান্তি কমাতে বিতরণ লাইন থেকে ফ্রিকোয়েন্সি স্কিমের যন্ত্রাংশ সরিয়ে নেয়ার জন্য মঙ্গলবার পিজিসিবিকে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছে ডিপিডিসি।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে বিদু্যত চাহিদা ৫ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। বেসরকারী হিসেবে চাহিদার পরিমাণ আরও ৯০০ মেগাওয়াট বেশি। পিডিবি বলছে, পিক আওয়ারে তারা সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পারে ৩ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। তবে অক্সেলারি ব্যবহার এবং সঞ্চালনের কারিগরি ৰতি বাদ দিয়ে উপকেন্দ্র প্রান্তে ৩ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। এতে পিডিবির হিসেবেই দেশে বিদ্যুত ঘাটতির পরিমাণ এক হাজার ৮৬৫ মেগাওয়াট। তবে বেসরকারী হিসেবে দেশে দৈনিক লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের উপরে।
পিডিবি বলছে, দেশে তীব্র গ্যাস সঙ্কটের কারণে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কম উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া তিনটি কেন্দ্র সংরৰণে থাকার কারণে আরও ৪৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন কম হচ্ছে। এ দু'কারণে বর্তমানে মোট এক হাজার ২৫০ মেগাওয়াট বিদু্যত কম উৎপাদন হচ্ছে।
রাজধানীর বিদ্যুত সঙ্কট ॥ রাজধানীতে বিদ্যুত সঙ্কটের কারণে জনজীবনে চরম অসস্তি নেমে এসেছে। গত দু'দিনে রাজধানীর পূর্বাঞ্চল, তালতলা, খিলগাঁও ও গোড়ানে ১০ লাইন ট্রিপ করেছে। ডিপিডিসি'র একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, বিতরণ লাইনগুলো ফ্রিকোয়েন্সি স্কিমের অধীনে হওয়ায় লোড (চাপ) বৃদ্ধি পেলে সয়ংক্রিয়ভাবে বিদু্যত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ডিপিডিসি জানতেও পারছে না কখন বিদু্যত চলে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিতরণ লাইন থেকে ফ্রিকোয়েন্সি স্কিমের যন্ত্রাংশ সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে ডিপিডিসি। বিতরণ লাইনগুলো থেকে এসব যন্ত্রাংশ সরিয়ে না নিলে সামনে গ্রাহক ভোগানত্মি আরও বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তিনি। রাজধানীতে গ্রাহকদের ভোগানত্মির জন্য তার প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসিও বেশ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, অতীতে আমরা কোনদিন এত লোডশেডিং করিনি।
এদিকে পিডিবি সূত্র বলছে, মঙ্গলবার হরিপুর লাইন ট্রিপ করায় সকাল থেকে দুপুর পর্যনত্ম রাজধানীর বিদু্যত বিতরণে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে দুপুরের পর ওই লাইন ঠিক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পিডিবি।
রাজধানীর বিদু্যত সরবরাহ নিয়ে পিডিবি এবং সরবরাহ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। পিডিবি বলছে, ঢাকা এলাকার দৈনিক চাহিদা এক হাজার ৭৭০ মেগাওয়াট এর বিপরীতি সরবরাহ করা হচ্ছে এক হাজার ৩৩০ মেগাওয়াট। লোডশেড করা হচ্ছে ৩৪০ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহকারী একটি কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে রাজধানীতে গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ চাহিদা বিদু্যত চাহিদা ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে এ চাহিদা ২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। সে হিসেবে দৈনিক ঢাকা এলাকায় লোডশেড করা হচ্ছে ৮৭০ মেগাওয়াট। গ্রীষ্মের তিব্র তাপদাহ শুরম্ন হলে রাজধানীতে বিদু্যত ঘাটতি হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে।
একটি বিদু্যত বিতরণ কোম্পানির এক জন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের মানসিকতার কারণে তথ্যে গোজামিল দেয়া হয়। যখন যারা ৰমতায় থাকে তারা দেখাতে চায় বিদু্যতখাতে খুব ভাল করছে এ কারণে চাহিদা কমিয়ে দেখানো হয়। তিনি বলেন, তথ্য নিয়ে লুকোচুরির কারণে আমরা আরও পিছিয়ে পড়ছি।
রাজধানীর শাহজাহানপুরের বাসিন্দা দিবা নার্গিস জানান, দিনে রাতে কখনই ঠিকমত বিদু্যত থাকে না। বিদু্যতের অভাবে বাসায় পানিও তোলা যায় না। একদিকে তীব্র গরম আর অন্যদিকে বিদু্যত না থাকায় ভোগানত্মি চরম আকার ধারণ করছে।
ভাল নেই রাজধানীর বাইরের মানুষ ॥ রাজধানী ছাড়িয়ে বিদ্যুত সঙ্কট সারাদেশেই চরম আকার ধারণ করেছে। পিডিবির হিসেবেই চট্টগ্রাম ১৩২ মেগাওয়াট, খুলনায় ১২৩ মেগাওয়াট, রাজশাহীতে ১১৩ মেগাওয়াট, কুমিল্লা এলাকায় ১০৩ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহে ৭১ মেগাওয়াট, রংপুরে ৬৭ মেগাওয়াট এবং বরিশাল এলাকায় ১৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হচ্ছে। তবে বেসরকারী হিসেবে চাহিদার পরিমাণ আরও বেশি হওয়ায় লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। সেচ মৌসুমে বাড়তি আরও ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় নগর এলাকায় বিদু্রত সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। সরকার কৃষিকে প্রাধান্য দেয়ায় সর্বৰণিক বিদ্যুত সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে।
শীঘ্র সঙ্কট কমছে না ॥ শীঘ্র লোডশেডিং মুক্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। আগামী এক দু'বছরেও সঙ্কট থেকে খুব বেশি উত্তরণ সম্ভব নয়। নানা পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবায়নাধীন গতিই মূল কারণ বলে মনে করছে সংশিস্নষ্টরা। পিডিবি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে চুক্তি করেছে গ্রীষ্মের শেষের দিকে তা উৎপাদনে আসতে পারে। তবে এত চাহিদার তুলনায় বিশাল ঘাটতি থেকে যাওয়ায় সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব হবে না। বিগত সাত বছরে দেশে নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে না আসায় এখন সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে দাবি করছে সরকার। বর্তমান সরকার যে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে আগামী ৩ বছরের মধ্যে সে কোম্পানিগুলোও উৎপাদনে আসতে পারছে না। পিডিবি সূত্র বলছে, গ্রীষ্মের শেষের দিকে খুলনার ৬০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা ৫৫ মেগাওয়াট, ফেঞ্চুগঞ্জ ৯০ মেগাওয়াট, যান্ত্রিক ত্রম্নটির কারণে বন্ধ থাকা এনএসপিসির ১০০ মেগাওয়াট বিদু্যত কেন্দ্র চালু হবে। এছাড়া আগামী ৩ মাসের মধ্যে বন্ধ থাকা আরও কয়েকটি কেন্দ্র চালু হবে। এগুলো হচ্ছে সিদ্ধিরগঞ্জ ১২০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট, আগুগঞ্জ ৬২ মেগাওয়াট, ফেঞ্চুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদনে আসবে।
গ্যাসই বড় সঙ্কট ॥ দেশের বিদু্যত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৮০ শতাংশই গ্যাসচালিত। সসত্মা জ্বালানির কারণে অতিরিক্ত গ্যাসনির্ভরতাই আজকের সঙ্কটের জন্য অনেকখানি দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। দেশের বিদু্যত কেন্দ্রগুলো ডুয়েল ফুয়েলে (দ্বৈত জ্বালানি) রূপানত্মর করা গেলে সঙ্কট কমে আসত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে গ্যাস সঙ্কটের কারণে সম্পূর্ণ চালু বিদু্যত কেন্দ্র ৮০০ মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন করতে পারছে না। পিডিবি সূত্র মতে তাদের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৯০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু এর বিপরীতে তাদের সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ৭০ কোটি ঘনফুট। সম্প্রতি সরকারের উপর মহলের সঙ্গে পিডিবির দেন দরবারের ৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পিডিবি বলেছে এতে তাদের উৎপাদন ৩০০ মেগাওয়াট বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এরপরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.