কল্পকথার গল্প-মুখর হওয়া সুখের নয়! by আলী হাবিব
রাজনীতিকরা কি সত্য উচ্চারণ করেন? এ নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ আছে। রাজনীতিকরা যে সত্য বলেন বা বলতে পারেন, এ নিয়ে মতানৈক্য থাকবেই। একটা গল্প দিয়েই তবে শুরু করা যাক। পুরনো গল্প। আজকাল সড়ক দুর্ঘটনা তো হরহামেশাই চলছে। সেই সড়ক দুর্ঘটনার একটা গল্প। কোনো এক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা বাস সড়ক থেকে উল্টে পড়ে গেছে। সড়কের পাশের মাঠে কাজ করছিলেন স্থানীয় চাষিরা।
তাঁরা বাসযাত্রীদের ওই মাঠের পাশে সমাহিত করলেন। 'ডাক্তার আসিবার পূর্বেই যেমন রোগী মারা যায়', সে রকম দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেখানে গেল পুলিশ। পুলিশের কর্মকর্তা গিয়ে সেখানে শুধু বাসটি পড়ে থাকতে দেখে চাষিদের জিজ্ঞেস করলেন, 'বাসের যাত্রীরা কোথায়?' এক চাষি জবাব দিলেন, 'সবাইকে সড়কের পাশে সমাহিত করা হয়েছে।' পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চাইলেন, 'সব যাত্রীই কি মারা গেছে?' চাষির জবাব, 'না, সবাই মারা যায়নি। কেউ কেউ বলছিলেন যে তাঁরা জীবিত। কিন্তু বাসের যাত্রী সবাই ছিলেন রাজনীতিবিদ। রাজনীতিবিদদের কথা কে বিশ্বাস করে বলুন! তাঁরা তো আর সত্য কথা বলেন না।'
তাই কি? কী জানি। তবে রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটি কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপন হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, কোমল পানীয় পান করার পর রাজনীতিক সত্য কথাটি বলছেন। এখানে বিজ্ঞাপনচিত্রের ওই চরিত্রটিকে রাজনীতিবিদ না বলে জনপ্রতিনিধি বলাটাই বোধ হয় সংগত। আর এটাও তো সত্য যে রাজনীতিকরাই জনপ্রতিনিধি। যাকগে, রাজনীতিবিদরা কি আসলেই সত্য কথা বলেন না? নাকি সব সত্য সব সময় প্রকাশ করা যায় না। এমনও তো হতে পারে, সত্য বলাটাও সব সময় নিরাপদ নয়। কাজেই নিরাপদ দূরত্বে থাকার উপায় হিসেবেও অনেককে অনেক সময় মিথ্যা বলতে হয়। কিংবা সত্যটা এড়িয়ে চলতে হয়। আবার এটাও তো মানতে হবে, ঢালাও মিথ্যা বললে সেটা কখনো সত্য হয়ে যায় না।
আমাদের দেশের রাজনীতিকরা কি সব সময় সত্য বলেন? নাকি মিথ্যাকে এমনভাবে প্রলেপ দিয়ে উচ্চারণ করেন যে সেটাই সত্য বলে মনে হয়? তবে কিছুদিন ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা যেভাবে কথা বলছিলেন, তাতে জনমনে বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছিল। অনেকেরই এমন মনে হচ্ছিল যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা হয়েও তাঁরা কেমন করে এভাবে সত্য উচ্চারণ করতে পারছেন? কেউ কেউ ভাবছিলেন, 'দিস ইজ কল্ড ডেমোক্রেসি।' সদা সত্য কথা না বললেও সত্যকে আড়াল করার কোনো চেষ্টা যে তাঁরা করছিলেন না, এটা তাঁদের কর্তাবার্তার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, 'উচিত কথায় কুটুম বেজার, গরম ভাতে বেড়াল।' এই সূত্র মেনেই বোধ হয় ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই এই 'উচিত কথা' বলাটা পছন্দ করতে পারেননি। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবরে সে রকম কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, 'দলের অনেক নেতা সরকারের সমালোচনা করে বাইরে কথা বলছেন, তাতে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে। বাইরে কথা না বলে দলে বিভিন্ন ফোরাম রয়েছে, সেখানে কথা বললে দল ও সরকারের জন্য মঙ্গল হবে। ...দলের সাধারণ সম্পাদক এ বিষয়ে প্রস্তাব এনে সব পর্যায়ের নেতাকে দলীয় ফোরামের বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতিতে যাতে সমালোচনা না করা হয়, তার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন।' কিন্তু অন্ধ হলে যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না, তেমনি বাইরে সরকারের সমালোচনা না করলেই যে সমালোচনা বন্ধ থাকবে_এমন কোনো কথা নেই। কারণ মানুষের মনের ওপর চাপ দেওয়ার সুযোগ সরকারের বা কোনো মন্ত্রীবাহাদুরের নেই। ঝড়ের সময় উট পাখি নাকি বালুতে মুখ ঢুকিয়ে রাখে, যাতে ঝড় দেখতে না হয়। দলের নেতারা সমালোচনা বন্ধ করে দিলেই কি সমালোচনা বন্ধ হয়ে যাবে?
যাঁরা কথা বলছিলেন, তাঁরাও জনপ্রতিনিধি। এখন কী করবেন তাঁরা? সরকারের প্রশংসা করে যাবেন? সেটা যদি মিথ্যা হয়, তবু? কিন্তু মিথ্যা তো বেশি দিন টিকে থাকে না। মানুষ আজকাল মিথ্যা ধরে ফেলতে পারে। 'লাই ডিটেক্টর' নামের যন্ত্রটির কথা তো আমরা জানিই। সেই লাই ডিটেক্টরও এখন পুরনো হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা সম্পতি নাকি এমন এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন, যা মানুষের চেহারা ও অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে তার আবেগীয় অবস্থা অর্থাৎ মানুষের সত্য বা মিথ্যা বলার বিষয়টি আরো অনেক কার্যকরভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম।
এখানেই শেষ নয়। এবার বিজ্ঞানীরা প্রকৃত অর্থেই মিথ্যা নির্ণয়ের নতুন আরেক উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। চুম্বক ব্যবহার করে সত্য-মিথ্যার প্রভেদ বোঝার উপায় বের করেছেন তাঁরা।
ওসব চুম্বক, লাই ডিটেক্টর কিংবা অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণের যন্ত্রের কথা ভুলে যাওয়া যাক। সত্য বা মিথ্যা নিয়ে বৃথা সময় নষ্ট করা কেন? তবে একটা সত্য কিন্তু মেনে নিতেই হবে। কী সেটা? ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সমালোচনা পছন্দ করেন না। তাঁরা তোয়াজ-তাছির পছন্দ করেন। আকবরের নবরত্ন সভায় বীরবল কিংবা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গোপাল ভাঁড়ের চাকরি জুটেছিল এ কারণেই। মোসাহেব শব্দটা তো আর এমনিতে জন্ম নেয়নি। মোসাহেবির কদর সব সময় ছিল এবং আছে। তবে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বুদ্ধি খরচ করতে হয়। যদিও রাজনীতিকদের বুদ্ধি নিয়ে একটি মার্কিন কৌতুক বলছে রাজনীতিকদের কোনো বুদ্ধিই নেই। কৌতুকটি বলা যাক। এক অফিস এঙ্িিকউটিভ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব হতাশ। অফিসে তাঁর প্রমোশন হচ্ছে না। অন্য কোথাও যে চলে যাবেন, সেটাও পারছেন না তিনি। কেন? তাঁর আইকিউ নাকি তেমন ধারালো নয়। তিনি গেলেন এক ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টারে। সেখানে গিয়ে তিনি মগজের দাম জানতে চাইলেন। তাঁকে বলা হলো, একজন অ্যাকাউনটেন্টের এক আউন্স মগজ এক হাজার ডলার। এক আউন্স অর্থনীতিবিদের মগজ দুই হাজার ডলার। অন্যদিকে এক আউন্স রাজনীতিবিদের মগজ পঁচাত্তর হাজার ডলার।
আমাদের রাজনীতিবিদদের অত বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই। তাঁরা বুদ্ধিমান। দলের নেতারা মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের সমালোচনা করলে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র চলে যাবে। তাঁরা সমালোচনা করার অস্ত্র পেয়ে যাবেন। কাজেই প্রকাশ্যে বা মিডিয়ার সামনে মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের সমালোচনা না করে সেটা দলীয় ফোরামেই করা উত্তম বলে মনে করা হচ্ছে। দলের নেতাদের তাহলে কাজ কী হবে? কী করবেন তাঁরা? মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টারের একটা গল্প বলা যাক। জিমি কার্টার এ গল্পটা করেছিলেন মার্কিন টেলিভিশনের দুঁুদে উপস্থাপক ডেভিড লেটারম্যানের কাছে। জিমি কার্টার যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন তিনি জাপান সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে পড়তে হয় ভাষাগত সমস্যায়। ব্যবসায়ীদের কোনো সভায় তাঁর বক্তৃতা করার কথা। তিনি আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন একজন দোভাষীর কথা। জিমি কার্টার ভাবলেন তিনি একটি জোক দিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুরু করবেন। তিনি তাঁর জোকটি বললেন। কিন্তু নিজের বলাটাই তাঁর পছন্দ হলো না। তিনি ভাবলেন, আরো ভালোভাবে কৌতুকটা পরিবেশন করা যেত। কিন্তু কী আর করা যাবে? বলেই তো ফেলেছেন। তিনি অপেক্ষা করলেন দোভাষীর ভাষান্তরের অপেক্ষায়। প্রেসিডেন্টকে অবাক করে দিয়ে দোভাষী দ্রুততম সময়ে সেটা বলে দিলেন। দর্শকসারিতে হাসির রোল পড়ে গেল। উপস্থিত সবাই হাততালি দিলেন। প্রেসিডেন্ট অবাক হলেও তাঁর বক্তৃতা শেষ করলেন। পরে তিনি দোভাষীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেমন করে অত সংক্ষেপে কৌতুকটা বলতে পারলেন? দোভাষী বললেন, তিনি বলেছিলেন, 'প্রেসিডেন্ট একটি কৌতুক বলেছেন। সবাই হাসুন।' এটা হচ্ছে তোয়াজের একটা রূপ। অন্য রূপও আছে। রাজা ক্যানিউটের গল্প।
রাজা ক্যানিউটকে তাঁর রাজসভার সবাই খুব তোয়াজ করে চলত। কথায় কথায় তাঁকে বলা হতো, 'আপনার চেয়ে মহান রাজা আর কেউ নেই। এমন কিছু নেই, যা আপনি করতে পারেন না। আপনি সব রাজাদের রাজা।' তবে রাজা ক্যানিউট এসব শুনলেও তাঁর নিজের একটা বিবেচনা বোধ ছিল। একদিন সমুদ্রসৈকতে হাঁটার সময় তিনি তাঁর লোকদের ডেকে বললেন, 'তোমরা যে বলো, আমার চেয়ে ক্ষমতাশালী নেই। সবাই আমার কথা শোনে। এটা কি ঠিক?' উপস্থিত সবাই বলল, 'হ্যাঁ, এটা ঠিক।' তিনি তাঁর সিংহাসন আনতে বললেন। সিংহাসন আনা হলো। তিনি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমি রাজা ক্যানিউট। আমার অনেক ক্ষমতা। সবাই আমার কথা শোনে। হে সমুদ্রের ঢেউ, আমাকে স্পর্শ করবে না।' সমুদ্রের ঢেউ তাঁর পা ছুঁয়ে গেল। তিনি আবার একই হুকুম দিলেন। দেখা গেল, ঢেউ এবার তাঁর হাঁটু ছুঁয়ে গেল। তিনি আবার একই কথা বললেন। এবার সমুদ্রের পানি উঠে গেল তাঁর সিংহাসনে।' তিনি মোসাহেবদের বললেন, দেখো, আমার কথা সবাই শোনে না। এই সমুদ্রের ঢেউ আমার গোলাম নয়।'
কাজেই তোয়াজ-তাছির কিংবা সমালোচনা কোনোটাতেই মুখর হওয়া সুখের নয়। অনেকটাই শাঁখের করাতের মতো। আসতে-যেতে যেকোনো সময় কাটতে পারে। যেমন কেটেছে সমালোচনামুখর নেতাদের। কাল হয়তো কাটবে তোষামোদকারীদের।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
তাই কি? কী জানি। তবে রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটি কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপন হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, কোমল পানীয় পান করার পর রাজনীতিক সত্য কথাটি বলছেন। এখানে বিজ্ঞাপনচিত্রের ওই চরিত্রটিকে রাজনীতিবিদ না বলে জনপ্রতিনিধি বলাটাই বোধ হয় সংগত। আর এটাও তো সত্য যে রাজনীতিকরাই জনপ্রতিনিধি। যাকগে, রাজনীতিবিদরা কি আসলেই সত্য কথা বলেন না? নাকি সব সত্য সব সময় প্রকাশ করা যায় না। এমনও তো হতে পারে, সত্য বলাটাও সব সময় নিরাপদ নয়। কাজেই নিরাপদ দূরত্বে থাকার উপায় হিসেবেও অনেককে অনেক সময় মিথ্যা বলতে হয়। কিংবা সত্যটা এড়িয়ে চলতে হয়। আবার এটাও তো মানতে হবে, ঢালাও মিথ্যা বললে সেটা কখনো সত্য হয়ে যায় না।
আমাদের দেশের রাজনীতিকরা কি সব সময় সত্য বলেন? নাকি মিথ্যাকে এমনভাবে প্রলেপ দিয়ে উচ্চারণ করেন যে সেটাই সত্য বলে মনে হয়? তবে কিছুদিন ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা যেভাবে কথা বলছিলেন, তাতে জনমনে বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছিল। অনেকেরই এমন মনে হচ্ছিল যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা হয়েও তাঁরা কেমন করে এভাবে সত্য উচ্চারণ করতে পারছেন? কেউ কেউ ভাবছিলেন, 'দিস ইজ কল্ড ডেমোক্রেসি।' সদা সত্য কথা না বললেও সত্যকে আড়াল করার কোনো চেষ্টা যে তাঁরা করছিলেন না, এটা তাঁদের কর্তাবার্তার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, 'উচিত কথায় কুটুম বেজার, গরম ভাতে বেড়াল।' এই সূত্র মেনেই বোধ হয় ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই এই 'উচিত কথা' বলাটা পছন্দ করতে পারেননি। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবরে সে রকম কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, 'দলের অনেক নেতা সরকারের সমালোচনা করে বাইরে কথা বলছেন, তাতে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে। বাইরে কথা না বলে দলে বিভিন্ন ফোরাম রয়েছে, সেখানে কথা বললে দল ও সরকারের জন্য মঙ্গল হবে। ...দলের সাধারণ সম্পাদক এ বিষয়ে প্রস্তাব এনে সব পর্যায়ের নেতাকে দলীয় ফোরামের বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতিতে যাতে সমালোচনা না করা হয়, তার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন।' কিন্তু অন্ধ হলে যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না, তেমনি বাইরে সরকারের সমালোচনা না করলেই যে সমালোচনা বন্ধ থাকবে_এমন কোনো কথা নেই। কারণ মানুষের মনের ওপর চাপ দেওয়ার সুযোগ সরকারের বা কোনো মন্ত্রীবাহাদুরের নেই। ঝড়ের সময় উট পাখি নাকি বালুতে মুখ ঢুকিয়ে রাখে, যাতে ঝড় দেখতে না হয়। দলের নেতারা সমালোচনা বন্ধ করে দিলেই কি সমালোচনা বন্ধ হয়ে যাবে?
যাঁরা কথা বলছিলেন, তাঁরাও জনপ্রতিনিধি। এখন কী করবেন তাঁরা? সরকারের প্রশংসা করে যাবেন? সেটা যদি মিথ্যা হয়, তবু? কিন্তু মিথ্যা তো বেশি দিন টিকে থাকে না। মানুষ আজকাল মিথ্যা ধরে ফেলতে পারে। 'লাই ডিটেক্টর' নামের যন্ত্রটির কথা তো আমরা জানিই। সেই লাই ডিটেক্টরও এখন পুরনো হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা সম্পতি নাকি এমন এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন, যা মানুষের চেহারা ও অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে তার আবেগীয় অবস্থা অর্থাৎ মানুষের সত্য বা মিথ্যা বলার বিষয়টি আরো অনেক কার্যকরভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম।
এখানেই শেষ নয়। এবার বিজ্ঞানীরা প্রকৃত অর্থেই মিথ্যা নির্ণয়ের নতুন আরেক উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। চুম্বক ব্যবহার করে সত্য-মিথ্যার প্রভেদ বোঝার উপায় বের করেছেন তাঁরা।
ওসব চুম্বক, লাই ডিটেক্টর কিংবা অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণের যন্ত্রের কথা ভুলে যাওয়া যাক। সত্য বা মিথ্যা নিয়ে বৃথা সময় নষ্ট করা কেন? তবে একটা সত্য কিন্তু মেনে নিতেই হবে। কী সেটা? ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সমালোচনা পছন্দ করেন না। তাঁরা তোয়াজ-তাছির পছন্দ করেন। আকবরের নবরত্ন সভায় বীরবল কিংবা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গোপাল ভাঁড়ের চাকরি জুটেছিল এ কারণেই। মোসাহেব শব্দটা তো আর এমনিতে জন্ম নেয়নি। মোসাহেবির কদর সব সময় ছিল এবং আছে। তবে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বুদ্ধি খরচ করতে হয়। যদিও রাজনীতিকদের বুদ্ধি নিয়ে একটি মার্কিন কৌতুক বলছে রাজনীতিকদের কোনো বুদ্ধিই নেই। কৌতুকটি বলা যাক। এক অফিস এঙ্িিকউটিভ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব হতাশ। অফিসে তাঁর প্রমোশন হচ্ছে না। অন্য কোথাও যে চলে যাবেন, সেটাও পারছেন না তিনি। কেন? তাঁর আইকিউ নাকি তেমন ধারালো নয়। তিনি গেলেন এক ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টারে। সেখানে গিয়ে তিনি মগজের দাম জানতে চাইলেন। তাঁকে বলা হলো, একজন অ্যাকাউনটেন্টের এক আউন্স মগজ এক হাজার ডলার। এক আউন্স অর্থনীতিবিদের মগজ দুই হাজার ডলার। অন্যদিকে এক আউন্স রাজনীতিবিদের মগজ পঁচাত্তর হাজার ডলার।
আমাদের রাজনীতিবিদদের অত বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই। তাঁরা বুদ্ধিমান। দলের নেতারা মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের সমালোচনা করলে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র চলে যাবে। তাঁরা সমালোচনা করার অস্ত্র পেয়ে যাবেন। কাজেই প্রকাশ্যে বা মিডিয়ার সামনে মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের সমালোচনা না করে সেটা দলীয় ফোরামেই করা উত্তম বলে মনে করা হচ্ছে। দলের নেতাদের তাহলে কাজ কী হবে? কী করবেন তাঁরা? মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টারের একটা গল্প বলা যাক। জিমি কার্টার এ গল্পটা করেছিলেন মার্কিন টেলিভিশনের দুঁুদে উপস্থাপক ডেভিড লেটারম্যানের কাছে। জিমি কার্টার যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন তিনি জাপান সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে পড়তে হয় ভাষাগত সমস্যায়। ব্যবসায়ীদের কোনো সভায় তাঁর বক্তৃতা করার কথা। তিনি আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন একজন দোভাষীর কথা। জিমি কার্টার ভাবলেন তিনি একটি জোক দিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুরু করবেন। তিনি তাঁর জোকটি বললেন। কিন্তু নিজের বলাটাই তাঁর পছন্দ হলো না। তিনি ভাবলেন, আরো ভালোভাবে কৌতুকটা পরিবেশন করা যেত। কিন্তু কী আর করা যাবে? বলেই তো ফেলেছেন। তিনি অপেক্ষা করলেন দোভাষীর ভাষান্তরের অপেক্ষায়। প্রেসিডেন্টকে অবাক করে দিয়ে দোভাষী দ্রুততম সময়ে সেটা বলে দিলেন। দর্শকসারিতে হাসির রোল পড়ে গেল। উপস্থিত সবাই হাততালি দিলেন। প্রেসিডেন্ট অবাক হলেও তাঁর বক্তৃতা শেষ করলেন। পরে তিনি দোভাষীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেমন করে অত সংক্ষেপে কৌতুকটা বলতে পারলেন? দোভাষী বললেন, তিনি বলেছিলেন, 'প্রেসিডেন্ট একটি কৌতুক বলেছেন। সবাই হাসুন।' এটা হচ্ছে তোয়াজের একটা রূপ। অন্য রূপও আছে। রাজা ক্যানিউটের গল্প।
রাজা ক্যানিউটকে তাঁর রাজসভার সবাই খুব তোয়াজ করে চলত। কথায় কথায় তাঁকে বলা হতো, 'আপনার চেয়ে মহান রাজা আর কেউ নেই। এমন কিছু নেই, যা আপনি করতে পারেন না। আপনি সব রাজাদের রাজা।' তবে রাজা ক্যানিউট এসব শুনলেও তাঁর নিজের একটা বিবেচনা বোধ ছিল। একদিন সমুদ্রসৈকতে হাঁটার সময় তিনি তাঁর লোকদের ডেকে বললেন, 'তোমরা যে বলো, আমার চেয়ে ক্ষমতাশালী নেই। সবাই আমার কথা শোনে। এটা কি ঠিক?' উপস্থিত সবাই বলল, 'হ্যাঁ, এটা ঠিক।' তিনি তাঁর সিংহাসন আনতে বললেন। সিংহাসন আনা হলো। তিনি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমি রাজা ক্যানিউট। আমার অনেক ক্ষমতা। সবাই আমার কথা শোনে। হে সমুদ্রের ঢেউ, আমাকে স্পর্শ করবে না।' সমুদ্রের ঢেউ তাঁর পা ছুঁয়ে গেল। তিনি আবার একই হুকুম দিলেন। দেখা গেল, ঢেউ এবার তাঁর হাঁটু ছুঁয়ে গেল। তিনি আবার একই কথা বললেন। এবার সমুদ্রের পানি উঠে গেল তাঁর সিংহাসনে।' তিনি মোসাহেবদের বললেন, দেখো, আমার কথা সবাই শোনে না। এই সমুদ্রের ঢেউ আমার গোলাম নয়।'
কাজেই তোয়াজ-তাছির কিংবা সমালোচনা কোনোটাতেই মুখর হওয়া সুখের নয়। অনেকটাই শাঁখের করাতের মতো। আসতে-যেতে যেকোনো সময় কাটতে পারে। যেমন কেটেছে সমালোচনামুখর নেতাদের। কাল হয়তো কাটবে তোষামোদকারীদের।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments