ঐতিহ্য হারাচ্ছে বেনারসি by আলাউদ্দিন আরিফ
মিরপুরের বেনারসি খ্যাতি অর্জন করেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ‘দেবদাস’ সিনেমার জন্যও মিরপুর থেকে নেয়া হয়েছিল বেনারসি শাড়ি। মিরপুরের বিহারি ক্যাম্প (আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্প), বস্তির ছোট ছোট খুপড়ি ঘর বা ব্যক্তিমালাকানাধীন ছোট তাঁতগুলোতে তৈরি হচ্ছে বিশ্বখ্যাত বেনারসি শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবি। বেনারসি শাড়ি অনেকের কাছে কাতান শাড়ি নামেও পরিচিত।
কিন্তু হস্তচালিত তাঁতে উত্পাদিত ঐতিহ্যবাহী বেনারসি এখন মার খাচ্ছে বিদ্যুত্চালিত তাঁতে তৈরি চকচকে শাড়ির কাছে। খোদ মিরপুরের বেনারসি পল্লীর দোকানগুলোতেও এখন ভারতীয় নিম্নমানের শাড়ির আধিক্য দেখা যাচ্ছে। সেখানে শাড়ি কিনে প্রতারিত হচ্ছেন অনেক ক্রেতা। তাছাড়া বেনারসির বাহারি রূপ দেখে জানার উপায় থাকে না এগুলো তৈরির নেপথ্য কারিগরদের দুঃখগাথা। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে তারা রাত-দিন পরিশ্রম করেন। বেনারসির ইতিহাস-ঐতিহ্য, শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা—এসব নিয়ে চারিদিকে দেখ চাহির আজকের আয়োজন। বেনারসি পল্লী ঘুরে এসে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আমার দেশ-এর সিনিয়র রিপোর্টার আলাউদ্দিন আরিফ
কারুকার্যখচিত শাড়ি কিংবা লেহেঙ্গা নববধূকে করে তোলে আকর্ষণীয়। বধূবেশী রমণীটিকে দেখার পাশাপাশি আগন্তুকরা দেখে নেন তার শাড়িটিও। আর সেটি যদি হয় মিরপুরের বেনারসি, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। যেন সোনায় সোহাগা। হ্যাঁ, বলছিলাম ঢাকার মিরপুরের বেনারসি শাড়ির কথা। এরই মধ্যে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বেনারসি খ্যাতি অর্জন করেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ‘দেবদাস’ সিনেমার জন্যও মিরপুর থেকে নেয়া হয় বেনারসি শাড়ি। মিরপুরের বিহারি ক্যাম্প (আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্প), বস্তির ছোট ছোট খুপড়ি ঘর বা ব্যক্তিমালাকানাধীন ছোট তাঁতগুলোতে তৈরি হচ্ছে বিশ্বখ্যাত বেনারসি শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবি। বেনারসি শাড়ি অনেকের কাছে কাতান শাড়ি নামেও পরিচিত। ফুলকলি কাতান, দুলহান কাতান, মিরপুরি রেশমি কাতান, মিলেনিয়াম কাতান, বেনারসি কসমস, অরগেন্ডি কাতান, রিমঝিম কাতান, প্রিন্স কাতান, টিস্যু কাতান, মিরপুরি গিনিগোল্ড কাতান, জর্জেট গিনি গোল্ড কাতান, চুনরি কাতান, অপেরা, ফিগা কত যে বাহারি নাম। দামের বহরও বেশ চওড়া। দাম আড়াই-তিন হাজার টাকা থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব শাড়ি বিশ্বের অল্প কয়েকটি জায়গাতেই তৈরি হয়। সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের মিরপুর, ভারতের বেনারস, বিহার, উত্তরপ্রদেশ। এছাড়া পাকিস্তানে সীমিত পরিসরে কিছু বেনারসি শাড়ি তৈরি হয়।
বেনারসির বাহারি রূপ দেখে বোঝার উপায় থাকে না এগুলো তৈরির নেপথ্য কারিগরদের দুঃখ গাথা। নিদারুণ কষ্ট স্বীকার করে শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে বেনারসি শ্রমিকরা রাত-দিন পরিশ্রম করেন। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে যে বেতন পান সেটাও খুবই সামান্য। তাদের নেই কোনো বেতন কাঠামো, নেই ন্যায্য পারিশ্রমিক। ফলে দিন দিন মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে তাঁতের সংখ্যা কমছে। তাদের মজুরি গার্মেন্ট শ্রমিকদের চেয়েও অনেক কম। ফলে শ্রমিকরাও বেনারসি তৈরির পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। সরকারিভাবে বেনারসি পল্লীর উন্নয়নে বেশক’টি প্রকল্প নেয়া হলেও সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারের অবহেলা, বড় ধরনের বিনিয়োগ না হওয়া, দুর্বল অবকাঠামো, চকচকে নিম্নমানের ভারতীয় শাড়ির দাপট, সুতার অনিয়ন্ত্রিত দাম, নকল ও ভেজাল রং এবং রাসায়নিক দ্রব্য, নকশা ও বুনন সম্পর্কে আধুনিক কারিগরি উত্কর্ষতার অভাব, কাঁচামালের দাম দিন দিন বেড়ে যাওয়া, বিদেশি শাড়ির ব্যাপক আমদানি, তাঁতিদের আর্থিক সঙ্কট, বাজারজাতকরণের সমস্যা প্রভৃতি কারণে বেনারসি হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য। পাওয়ার লুমে তৈরি চাকচিক্যময় শাড়ি বেনারসির তুলনায় অনেক কম দামে পাওয়ার কারণে মানুষ এখন আসল বেনারসির বিকল্প শাড়ির দিকে আগ্রহী হচ্ছে। খোদ বেনারসি পল্লীতেও পাওয়ার লুমে তৈরি ভারতীয় নিম্নমানের শাড়িতে সয়লাব হয়ে আছে। বিক্রেতারাও এসব শাড়ি মিরপুরের বেনারসি শাড়ি বলে বিক্রি করে গ্রাহকদের ঠকিয়ে আসছে। অনেকে তুলনামূলক কম দামে পেয়ে নিম্নমানের ভারতীয় শাড়ি আসল বেনারসি মনে করে কিনে নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ না হলে বেনারসি তার ঐতিহ্য ও মানুষের আস্থা হারাবে। কারণ পাওয়ার লুমের শাড়ি বৈধ-অবৈধ পথে, বিনাশুল্কে চোরাইপথে আসায় দাম কম পড়ছে। ফলে দাম ও চাকচিক্যের প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে বেনারসি। তার ওপর সরকার প্রতি বছরই বেনারসির কাঁচামাল সুতা বা সিল্কের ওপর নতুন নতুন কর ও ভ্যাট আরোপ করে যাচ্ছে। ফলে মার খেতে বসেছে এই বেনারসি শিল্প।
বেনারসি শাড়ি সংশ্লিষ্টরা জানান, ঐতিহ্যবাহী বেনারসি শিল্পের স্বর্ণালি দিন ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। আর তা না হলে হয়তো মসলিনের মতো বেনারসিও হারিয়ে যাবে আর ঠাঁই নেবে পাঠ্যপুস্তক কিংবা জাদুঘরের উপকরণ হিসেবে।
মিরপুরে বেনারসি পল্লী গড়ে ওঠার নেপথ্যে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ভারতের বেনারস থেকে প্রায় ৩৭০টি মুসলিম পরিবার তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। তাদের বেশিরভাগই ছিল পেশায় তাঁতি। শুরুতে এরা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস শুরু করে। তবে তাদের বড় অংশ বসতি গড়ে তোলে ঢাকার মিরপুর এলাকায়। জীবিকা হিসেবে তারা তাঁতে কাপড় বোনার পেশা বেছে নেয়। তাদের হাত ধরে মিরপুরে গড়ে উঠে ছোট ছোট বেশকিছু তাঁত। এখানে তৈরি হতে থাকে ফ্যাশনেবল ও আকর্ষণীয় সব বেনারসি শাড়ি, যার কদর বাড়তে থাকে ফ্যাশনসচেতন নারীদের কাছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাকিস্তানিদের বড় একটি অংশ আটকা পড়ে। যুদ্ধের সময় তাদের সহায় সম্পত্তি সবকিছু বেদখল হয়ে যায়। মিরপুরে রিফিউজি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে রিফিউজি ক্যাম্পের লোকজনও বেঁচে থাকার তাগিদে বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে। তাদের দেখাদেখি কিছু বাংলাদেশী মানুষও ভালো আয়-রোজগারের আশায় বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে। বেনারসি শাড়ির কারিগররা প্রায় সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলেন উর্দু, হিন্দি ও বাংলার মিশ্রিত একটি ভাষায়। সেখানে উর্দুর প্রাধান্যই বেশি। বর্তমানে এক লাখের বেশি মানুষ বেনারসি শাড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত। বেঁচে থাকার তাগিদে শ্রমিকদের চেষ্টায় দিন দিন বেনারসির সুনাম-সুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। বেনারসি এক সময় শিল্পে পরিণত হয়। মিরপুর ১০ থেকে ১১ নম্বর হয়ে কালসি, বাউনিয়া বেড়িবাঁধ পর্যন্ত পুরো এলাকায় বেনারসিকেন্দ্রিক চলতে থাকে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই এলাকাটি পরিচিতি পায় বেনারসি পল্লী হিসেবে।
বেনারসি শিল্পে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারুকাজ, রং, সুতার ব্যবহার, বুনন, সমন্বয়, নকশা সব মিলিয়ে বেনারসির অন্যরকম এক আবেদন আগেও ছিল, এখনও আছে। ধনী-গরিব সব নারীরই পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে বেনারসি। যাদের সামর্থ্য নেই তাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে অন্তত বিয়ের অনুষ্ঠানটা হবে বেনারসি দিয়ে। যে কারণে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারগুলোতে বেনারসি ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান কল্পনাও করা যেত না। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বেনারসির বাণিজ্যিক নাম বিস্তৃত হতে থাকে। নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত ঢাকাই বেনারসির খ্যাতি ছড়াতে থাকে। বাজারে তৈরি হয় ব্যাপক চাহিদা।
এদিকে বেনারসি পল্লী ঘুরে জানা গেছে, এখানকার তাঁতিদের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে এই শিল্পের জন্য নিজস্ব জমি না থাকা। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ভাসানটেকে বেনারসি তাঁতিদের পুনর্বাসনের ঘোষণা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেনারসি তাঁতিরা ভাসানটেকে জমি পেতে তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা করে জমা দেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরপর এই প্রকল্পের আর কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ তাঁত উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জানান, ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে ২৪৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘বেনারসি পল্লী মিরপুর’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সংশোধিত বিনিয়োগ ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৯৪৭ লাখ টাকা। ২০০২ সালের জুন মাসে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে জমির মূল্য পরিশোধ ও অন্যান্য খরচ বাবত প্রকল্পের ১৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। প্রকল্পের জমিতে বস্তি উচ্ছেদ সংক্রান্ত হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় বেনারসি পল্লীর ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। বেনারসির কারিগরদেরও পুনর্বাসন করা যায়নি। বেনারসি শিল্পকে ঘিরে দিন দিন সমস্যা বাড়তে থাকায় শ্রমিকরা বেনারসি তৈরি ছেড়ে দিচ্ছেন। ফলে দিন দিন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ছে বেনারসি শিল্প। ২০০০ সালে যেখানে কারিগর ছিলেন ১২ হাজার, সেখানে এখন এ সংখ্যা ৮ হাজারের কম।
বেনারসি পল্লীতে জেরিন সিল্ক কারখানার ম্যানেজার শামীম আহমেদ জানান, কয়েকটি ধাপে বেনারসি শাড়ি তৈরি করতে হয়। বেনারসি তৈরির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সিল্ক সুতা। এগুলো আমদানি হয় মূলত চীন থেকে। এরপর তৈরি হয় শাড়ির নকশা। সাদা কাগজে প্রথমে শাড়ির গ্রাফ এঁকে সেগুলোতে পেশাদার ডিজাইনাররা মনের মাধুরি মিশিয়ে ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা ও মানুষের চাহিদার সঙ্গে গ্রাফ তৈরি করেন। কাগজে তৈরি ওই গ্রাফ শক্ত কাগজের বোর্ডে পাঞ্চিং করা হয়। গ্রাফে বর্ণিত রং অনুসারে সুতার রং করা হয়। রঙিন সুতা এবং পাঞ্চিং করা বোর্ড তাঁতে তোলা হয়। তাঁতীদের ভাষায় এটি হলো ‘জাকট’ করা। জাকট শেষে ধীরে ধীরে শুরু হয় বুননের কাজ। একটি শাড়ি বুনতে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ দিন। নকশার ওপর নির্ভর করে কখনও কখনও ৮ দিন পর্যন্ত সময় লাগে একেকটি শাড়ি বোনার কাজ শেষ হতে। মিল ফিনিশিং শেষে সেগুলোতে জরি, চুমকি বসানোসহ নানান ধরনের হাতের কাজ করা হয়। সব মিলিয়ে একটি শাড়ির কাজ করতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় প্রয়োজন হয় বলে তাঁতিরা জানিয়েছেন।
জেরিন সিল্ক কারখানার ম্যানেজার জানান, বেনারসি শ্রমিকদের বেতন খুবই কম। সুতা, রং ও জরিসহ কাঁচামালের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। নিম্নমানের নকল সুতা দিয়ে এবং মেশিনে বোনা কাপড়ের সঙ্গে তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ওইসব কাপড় দেখতে চকচকে ও দাম কম হওয়ায় ক্রেতারা সেগুলোর দিকেই হামলে পড়ছে।
বেনারসি তাঁতের শ্রমিক মোঃ সাদেক জানান, মাসে তারা সর্বনিম্ন ৪ ও সর্বোচ্চ ৬টি কাপড় বুনতে পারেন। তাদের মজুরি হয় শাড়ি হিসেবে। হাতে বোনা প্রতিটি শাড়ির জন্য তারা মজুরি নেন এক হাজার থেকে এগারশ’ টাকা পর্যন্ত। বেনারসি তাঁতের শ্রমিক জুম্মন আলী জানান, ৩০ বছর ধরে হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বুনছেন তিনি। মাসে ৪ থেকে ৬টি শাড়ি বানাতে পারেন তিনি। এর বেশি আর শরীরে কুলোয় না। নকশার ওপর নির্ভর করে প্রতিটি শাড়ির জন্য ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান তারা। জুম্মন আরও বলেন, আগে একেকটি কাতান শাড়ির মজুরি ছিল ১৬০০ টাকা। এখন বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, কিন্তু তাদের মজুরি কমেছে। ফলে দিনরাত পরিশ্রম করেও নিদারুণ কষ্টেই কাটে তাদের জীবন।
জেরিন সিল্ক কারখানার পাশে আরেকটি কারখানায় ১৮টি তাঁত। সেখানকার তাঁতি জামিল জানান, ডিজাইনের ওপর নির্ভর করে তারা প্রতিটি শাড়িতে সর্বনিম্ন ৮০০ ও সর্বোচ্চ ১৮০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। সাধারণ মধ্যম মানের শাড়ি বুননে মজুরি নেন ১১শ’ থেকে ১২শ’ টাকা।
জেরিন সিল্কে সুতা কাটার কাজ করেন ৫৫ বছর বয়সী লুত্ফা বেগম। তিনি জানালেন, মাসে তার মজুরি ২৮০০ টাকা। স্বামী নেই। এক ছেলেকে নিয়ে লুত্ফার সংসার। ২৮শ’ টাকা ও ছেলের গার্মেন্টের চাকরির আয় দিয়ে সংসার চালাতে হয় লুত্ফাকে। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। মাঝখানে দুপুরে এক-দেড় ঘণ্টার বিরতি পান। কারখানার ১৩টি তাঁতের জন্য একাই সুতা কাটার কাজ করেন তিনি। তাদের কোনো ওভারটাইম নেই। বাড়তি কোনো মজুরি নেই। যে ঘরে ভাড়া থাকেন সেটার ভাড়া ১৬শ’ টাকা। আগামী মাসে ভাড়া বাড়বে ৪০০ টাকা। কীভাবে এই বাড়তি টাকার জোগান হবে তাই নিয়ে চিন্তিত লুত্ফা।
বেনারসি পল্লীর ছোট ছোট ডাইং কারখানাগুলোতেই বেনারসির রং করা হয়। তেমনি একটি কারখানা সাথী রং ঘর। মালিক মোহাম্মদ গানি মিয়া। সেখানকার শ্রমিক নাছির ও মিজান জানায়, প্রতি পিস শাড়ির সুতা রং করার জন্য তাদের মজুরি ৫০ টাকা। ৫ জন শ্রমিকের একটি দল দৈনিক প্রায় ১০০ পিস শাড়ির সুতা রং করতে পারেন। তারা আরও জানায়, মাঝেমধ্যে নকল ও ভেজাল রঙের কারণে সুতা নষ্ট হয়। রং উঠে যায়। ফলে তাদের কারখানারও বদনাম হয়।
বেনারসি শিল্পে জড়িত বিপুল সংখ্যক শিশু শ্রমিক। বিশেষ করে চুমকি বসানো, জরির কাজ করা, সুতাকাটাসহ অনেক কাজই করে শিশুরা। এমনকি ডাইংয়ের কাজও করে তারা। বেনারসি পল্লীতে ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের ছোট্ট একটি ঘরে কাজ করছিল ৯ বছরের শিশু ছামির। সে জানায়, দুই বছর থেকে সে চুমকি ও জরি বসানোর কাজ করছে। বেতন পায় সপ্তাহে ৫০০ টাকা করে। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার পর মা-বাবা তাকে কাজে দিয়েছে। ছামির জানায়, তার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছে। তার বাবা বলেছে, ভালো করে কাজ করলে তাকে আগামী বছর স্কুলে ভর্তি করে দেবে। সেই স্বপ্ন চোখে নিয়ে রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছে শিশু শ্রমিক ছামির। তাহেরা জরি হাউসের মালিক মাহমুদ আল কাদেরি। ওই সময় তিনি কারখানায় ছিলেন না। জানান, তার কারখানায় ৭ জন শ্রমিক কাজ করে। যাদের অধিকাংশেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। পাশেই আরেকটি খুপড়িতে দেখা গেছে রোকেয়া নামের ৯-১০ বছরের একটি মেয়েশিশু চুমকি বসানোর কাজ করছে বেনারসিতে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিশুদের হাতে চুমকি ও জরি বসানোর কাজ অত্যন্ত নিখুঁত হয়। তাই এসব কারখানার মালিকরা শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেয় বেশি।
মিরপুর বেনারসি পল্লী কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সৈয়দ রিয়াজ উদ্দিন জানান, বেনারসি শ্রমিকরা রাত-দিন পরিশ্রম করে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। উন্নতমানের শাড়ি তৈরি করে বিদেশ থেকে শাড়ির আমদানি কমিয়ে টাকা সাশ্রয় করছে। অথচ এসব শ্রমিকের কোনো বেতন কাঠামো নেই, কোনো ওভারটাইম নেই। তাদের মজুরি গার্মেন্ট শ্রমিকদের চাইতেও অনেক কম।
এদিকে বেনারসি পল্লীর দোকানগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, নানা ডিজাইনের বাহারি শাড়িতে শোরুমগুলো ঠাসা। পাইকারি ও খুচরা বিক্রিও বেশ ভালো। দেশি-বিদেশি ক্রেতার পাশাপাশি পাইকাররাও যাচ্ছে সেখানে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ মৌসুমে তাদের ভিড় বেশি থাকে। এখন ভিড় খুবই কম। তাছাড়া উত্পাদন খরচ বেশি হওয়ায় শাড়ির দাম একটু বেড়েছে। গুণগত মানের ভিন্নতার কারণে দামেও রয়েছে ভিন্নতা। দেশীয় শাড়ির পাশাপাশি বিদেশি শাড়িও দোকানগুলোতে রয়েছে। ভারতীয়-পাকিস্তানি শাড়ি, লেহেঙ্গা ও থ্রি-পিসও রয়েছে দোকানগুলোতে।
রমণী শাড়ি কুঠিরের বিক্রেতা জানান, বর্তমানে উত্পাদনের চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। প্রতি বছরই কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকায় উত্পাদন খরচ বাড়ছে। গত এক বছরে প্রতি পিস কাতান শাড়িতে গড়ে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা উত্পাদন খরচ বেড়েছে। রেশমি শাড়িতে আগে খরচ হতো ৩ হাজার টাকা, এখন তাতে ৬ হাজার টাকা খরচ পড়ছে। এ কারণে বর্তমানে শাড়ি একটু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মোহাম্মদী সিল্ক হাউসের শাড়ি বিক্রেতা বলেন, এখন শীতকাল। এসময় সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বেশি হওয়ায় শাড়ি বিক্রি ভালো।
কারুকার্যখচিত শাড়ি কিংবা লেহেঙ্গা নববধূকে করে তোলে আকর্ষণীয়। বধূবেশী রমণীটিকে দেখার পাশাপাশি আগন্তুকরা দেখে নেন তার শাড়িটিও। আর সেটি যদি হয় মিরপুরের বেনারসি, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। যেন সোনায় সোহাগা। হ্যাঁ, বলছিলাম ঢাকার মিরপুরের বেনারসি শাড়ির কথা। এরই মধ্যে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বেনারসি খ্যাতি অর্জন করেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ‘দেবদাস’ সিনেমার জন্যও মিরপুর থেকে নেয়া হয় বেনারসি শাড়ি। মিরপুরের বিহারি ক্যাম্প (আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্প), বস্তির ছোট ছোট খুপড়ি ঘর বা ব্যক্তিমালাকানাধীন ছোট তাঁতগুলোতে তৈরি হচ্ছে বিশ্বখ্যাত বেনারসি শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবি। বেনারসি শাড়ি অনেকের কাছে কাতান শাড়ি নামেও পরিচিত। ফুলকলি কাতান, দুলহান কাতান, মিরপুরি রেশমি কাতান, মিলেনিয়াম কাতান, বেনারসি কসমস, অরগেন্ডি কাতান, রিমঝিম কাতান, প্রিন্স কাতান, টিস্যু কাতান, মিরপুরি গিনিগোল্ড কাতান, জর্জেট গিনি গোল্ড কাতান, চুনরি কাতান, অপেরা, ফিগা কত যে বাহারি নাম। দামের বহরও বেশ চওড়া। দাম আড়াই-তিন হাজার টাকা থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব শাড়ি বিশ্বের অল্প কয়েকটি জায়গাতেই তৈরি হয়। সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের মিরপুর, ভারতের বেনারস, বিহার, উত্তরপ্রদেশ। এছাড়া পাকিস্তানে সীমিত পরিসরে কিছু বেনারসি শাড়ি তৈরি হয়।
বেনারসির বাহারি রূপ দেখে বোঝার উপায় থাকে না এগুলো তৈরির নেপথ্য কারিগরদের দুঃখ গাথা। নিদারুণ কষ্ট স্বীকার করে শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে বেনারসি শ্রমিকরা রাত-দিন পরিশ্রম করেন। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে যে বেতন পান সেটাও খুবই সামান্য। তাদের নেই কোনো বেতন কাঠামো, নেই ন্যায্য পারিশ্রমিক। ফলে দিন দিন মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে তাঁতের সংখ্যা কমছে। তাদের মজুরি গার্মেন্ট শ্রমিকদের চেয়েও অনেক কম। ফলে শ্রমিকরাও বেনারসি তৈরির পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। সরকারিভাবে বেনারসি পল্লীর উন্নয়নে বেশক’টি প্রকল্প নেয়া হলেও সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারের অবহেলা, বড় ধরনের বিনিয়োগ না হওয়া, দুর্বল অবকাঠামো, চকচকে নিম্নমানের ভারতীয় শাড়ির দাপট, সুতার অনিয়ন্ত্রিত দাম, নকল ও ভেজাল রং এবং রাসায়নিক দ্রব্য, নকশা ও বুনন সম্পর্কে আধুনিক কারিগরি উত্কর্ষতার অভাব, কাঁচামালের দাম দিন দিন বেড়ে যাওয়া, বিদেশি শাড়ির ব্যাপক আমদানি, তাঁতিদের আর্থিক সঙ্কট, বাজারজাতকরণের সমস্যা প্রভৃতি কারণে বেনারসি হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য। পাওয়ার লুমে তৈরি চাকচিক্যময় শাড়ি বেনারসির তুলনায় অনেক কম দামে পাওয়ার কারণে মানুষ এখন আসল বেনারসির বিকল্প শাড়ির দিকে আগ্রহী হচ্ছে। খোদ বেনারসি পল্লীতেও পাওয়ার লুমে তৈরি ভারতীয় নিম্নমানের শাড়িতে সয়লাব হয়ে আছে। বিক্রেতারাও এসব শাড়ি মিরপুরের বেনারসি শাড়ি বলে বিক্রি করে গ্রাহকদের ঠকিয়ে আসছে। অনেকে তুলনামূলক কম দামে পেয়ে নিম্নমানের ভারতীয় শাড়ি আসল বেনারসি মনে করে কিনে নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ না হলে বেনারসি তার ঐতিহ্য ও মানুষের আস্থা হারাবে। কারণ পাওয়ার লুমের শাড়ি বৈধ-অবৈধ পথে, বিনাশুল্কে চোরাইপথে আসায় দাম কম পড়ছে। ফলে দাম ও চাকচিক্যের প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে বেনারসি। তার ওপর সরকার প্রতি বছরই বেনারসির কাঁচামাল সুতা বা সিল্কের ওপর নতুন নতুন কর ও ভ্যাট আরোপ করে যাচ্ছে। ফলে মার খেতে বসেছে এই বেনারসি শিল্প।
বেনারসি শাড়ি সংশ্লিষ্টরা জানান, ঐতিহ্যবাহী বেনারসি শিল্পের স্বর্ণালি দিন ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। আর তা না হলে হয়তো মসলিনের মতো বেনারসিও হারিয়ে যাবে আর ঠাঁই নেবে পাঠ্যপুস্তক কিংবা জাদুঘরের উপকরণ হিসেবে।
মিরপুরে বেনারসি পল্লী গড়ে ওঠার নেপথ্যে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ভারতের বেনারস থেকে প্রায় ৩৭০টি মুসলিম পরিবার তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। তাদের বেশিরভাগই ছিল পেশায় তাঁতি। শুরুতে এরা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস শুরু করে। তবে তাদের বড় অংশ বসতি গড়ে তোলে ঢাকার মিরপুর এলাকায়। জীবিকা হিসেবে তারা তাঁতে কাপড় বোনার পেশা বেছে নেয়। তাদের হাত ধরে মিরপুরে গড়ে উঠে ছোট ছোট বেশকিছু তাঁত। এখানে তৈরি হতে থাকে ফ্যাশনেবল ও আকর্ষণীয় সব বেনারসি শাড়ি, যার কদর বাড়তে থাকে ফ্যাশনসচেতন নারীদের কাছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাকিস্তানিদের বড় একটি অংশ আটকা পড়ে। যুদ্ধের সময় তাদের সহায় সম্পত্তি সবকিছু বেদখল হয়ে যায়। মিরপুরে রিফিউজি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে রিফিউজি ক্যাম্পের লোকজনও বেঁচে থাকার তাগিদে বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে। তাদের দেখাদেখি কিছু বাংলাদেশী মানুষও ভালো আয়-রোজগারের আশায় বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে। বেনারসি শাড়ির কারিগররা প্রায় সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলেন উর্দু, হিন্দি ও বাংলার মিশ্রিত একটি ভাষায়। সেখানে উর্দুর প্রাধান্যই বেশি। বর্তমানে এক লাখের বেশি মানুষ বেনারসি শাড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত। বেঁচে থাকার তাগিদে শ্রমিকদের চেষ্টায় দিন দিন বেনারসির সুনাম-সুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। বেনারসি এক সময় শিল্পে পরিণত হয়। মিরপুর ১০ থেকে ১১ নম্বর হয়ে কালসি, বাউনিয়া বেড়িবাঁধ পর্যন্ত পুরো এলাকায় বেনারসিকেন্দ্রিক চলতে থাকে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই এলাকাটি পরিচিতি পায় বেনারসি পল্লী হিসেবে।
বেনারসি শিল্পে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারুকাজ, রং, সুতার ব্যবহার, বুনন, সমন্বয়, নকশা সব মিলিয়ে বেনারসির অন্যরকম এক আবেদন আগেও ছিল, এখনও আছে। ধনী-গরিব সব নারীরই পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে বেনারসি। যাদের সামর্থ্য নেই তাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে অন্তত বিয়ের অনুষ্ঠানটা হবে বেনারসি দিয়ে। যে কারণে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারগুলোতে বেনারসি ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান কল্পনাও করা যেত না। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বেনারসির বাণিজ্যিক নাম বিস্তৃত হতে থাকে। নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত ঢাকাই বেনারসির খ্যাতি ছড়াতে থাকে। বাজারে তৈরি হয় ব্যাপক চাহিদা।
এদিকে বেনারসি পল্লী ঘুরে জানা গেছে, এখানকার তাঁতিদের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে এই শিল্পের জন্য নিজস্ব জমি না থাকা। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ভাসানটেকে বেনারসি তাঁতিদের পুনর্বাসনের ঘোষণা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেনারসি তাঁতিরা ভাসানটেকে জমি পেতে তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা করে জমা দেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরপর এই প্রকল্পের আর কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ তাঁত উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জানান, ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে ২৪৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘বেনারসি পল্লী মিরপুর’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সংশোধিত বিনিয়োগ ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৯৪৭ লাখ টাকা। ২০০২ সালের জুন মাসে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে জমির মূল্য পরিশোধ ও অন্যান্য খরচ বাবত প্রকল্পের ১৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। প্রকল্পের জমিতে বস্তি উচ্ছেদ সংক্রান্ত হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় বেনারসি পল্লীর ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। বেনারসির কারিগরদেরও পুনর্বাসন করা যায়নি। বেনারসি শিল্পকে ঘিরে দিন দিন সমস্যা বাড়তে থাকায় শ্রমিকরা বেনারসি তৈরি ছেড়ে দিচ্ছেন। ফলে দিন দিন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ছে বেনারসি শিল্প। ২০০০ সালে যেখানে কারিগর ছিলেন ১২ হাজার, সেখানে এখন এ সংখ্যা ৮ হাজারের কম।
বেনারসি পল্লীতে জেরিন সিল্ক কারখানার ম্যানেজার শামীম আহমেদ জানান, কয়েকটি ধাপে বেনারসি শাড়ি তৈরি করতে হয়। বেনারসি তৈরির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সিল্ক সুতা। এগুলো আমদানি হয় মূলত চীন থেকে। এরপর তৈরি হয় শাড়ির নকশা। সাদা কাগজে প্রথমে শাড়ির গ্রাফ এঁকে সেগুলোতে পেশাদার ডিজাইনাররা মনের মাধুরি মিশিয়ে ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা ও মানুষের চাহিদার সঙ্গে গ্রাফ তৈরি করেন। কাগজে তৈরি ওই গ্রাফ শক্ত কাগজের বোর্ডে পাঞ্চিং করা হয়। গ্রাফে বর্ণিত রং অনুসারে সুতার রং করা হয়। রঙিন সুতা এবং পাঞ্চিং করা বোর্ড তাঁতে তোলা হয়। তাঁতীদের ভাষায় এটি হলো ‘জাকট’ করা। জাকট শেষে ধীরে ধীরে শুরু হয় বুননের কাজ। একটি শাড়ি বুনতে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ দিন। নকশার ওপর নির্ভর করে কখনও কখনও ৮ দিন পর্যন্ত সময় লাগে একেকটি শাড়ি বোনার কাজ শেষ হতে। মিল ফিনিশিং শেষে সেগুলোতে জরি, চুমকি বসানোসহ নানান ধরনের হাতের কাজ করা হয়। সব মিলিয়ে একটি শাড়ির কাজ করতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় প্রয়োজন হয় বলে তাঁতিরা জানিয়েছেন।
জেরিন সিল্ক কারখানার ম্যানেজার জানান, বেনারসি শ্রমিকদের বেতন খুবই কম। সুতা, রং ও জরিসহ কাঁচামালের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। নিম্নমানের নকল সুতা দিয়ে এবং মেশিনে বোনা কাপড়ের সঙ্গে তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ওইসব কাপড় দেখতে চকচকে ও দাম কম হওয়ায় ক্রেতারা সেগুলোর দিকেই হামলে পড়ছে।
বেনারসি তাঁতের শ্রমিক মোঃ সাদেক জানান, মাসে তারা সর্বনিম্ন ৪ ও সর্বোচ্চ ৬টি কাপড় বুনতে পারেন। তাদের মজুরি হয় শাড়ি হিসেবে। হাতে বোনা প্রতিটি শাড়ির জন্য তারা মজুরি নেন এক হাজার থেকে এগারশ’ টাকা পর্যন্ত। বেনারসি তাঁতের শ্রমিক জুম্মন আলী জানান, ৩০ বছর ধরে হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বুনছেন তিনি। মাসে ৪ থেকে ৬টি শাড়ি বানাতে পারেন তিনি। এর বেশি আর শরীরে কুলোয় না। নকশার ওপর নির্ভর করে প্রতিটি শাড়ির জন্য ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান তারা। জুম্মন আরও বলেন, আগে একেকটি কাতান শাড়ির মজুরি ছিল ১৬০০ টাকা। এখন বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, কিন্তু তাদের মজুরি কমেছে। ফলে দিনরাত পরিশ্রম করেও নিদারুণ কষ্টেই কাটে তাদের জীবন।
জেরিন সিল্ক কারখানার পাশে আরেকটি কারখানায় ১৮টি তাঁত। সেখানকার তাঁতি জামিল জানান, ডিজাইনের ওপর নির্ভর করে তারা প্রতিটি শাড়িতে সর্বনিম্ন ৮০০ ও সর্বোচ্চ ১৮০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। সাধারণ মধ্যম মানের শাড়ি বুননে মজুরি নেন ১১শ’ থেকে ১২শ’ টাকা।
জেরিন সিল্কে সুতা কাটার কাজ করেন ৫৫ বছর বয়সী লুত্ফা বেগম। তিনি জানালেন, মাসে তার মজুরি ২৮০০ টাকা। স্বামী নেই। এক ছেলেকে নিয়ে লুত্ফার সংসার। ২৮শ’ টাকা ও ছেলের গার্মেন্টের চাকরির আয় দিয়ে সংসার চালাতে হয় লুত্ফাকে। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। মাঝখানে দুপুরে এক-দেড় ঘণ্টার বিরতি পান। কারখানার ১৩টি তাঁতের জন্য একাই সুতা কাটার কাজ করেন তিনি। তাদের কোনো ওভারটাইম নেই। বাড়তি কোনো মজুরি নেই। যে ঘরে ভাড়া থাকেন সেটার ভাড়া ১৬শ’ টাকা। আগামী মাসে ভাড়া বাড়বে ৪০০ টাকা। কীভাবে এই বাড়তি টাকার জোগান হবে তাই নিয়ে চিন্তিত লুত্ফা।
বেনারসি পল্লীর ছোট ছোট ডাইং কারখানাগুলোতেই বেনারসির রং করা হয়। তেমনি একটি কারখানা সাথী রং ঘর। মালিক মোহাম্মদ গানি মিয়া। সেখানকার শ্রমিক নাছির ও মিজান জানায়, প্রতি পিস শাড়ির সুতা রং করার জন্য তাদের মজুরি ৫০ টাকা। ৫ জন শ্রমিকের একটি দল দৈনিক প্রায় ১০০ পিস শাড়ির সুতা রং করতে পারেন। তারা আরও জানায়, মাঝেমধ্যে নকল ও ভেজাল রঙের কারণে সুতা নষ্ট হয়। রং উঠে যায়। ফলে তাদের কারখানারও বদনাম হয়।
বেনারসি শিল্পে জড়িত বিপুল সংখ্যক শিশু শ্রমিক। বিশেষ করে চুমকি বসানো, জরির কাজ করা, সুতাকাটাসহ অনেক কাজই করে শিশুরা। এমনকি ডাইংয়ের কাজও করে তারা। বেনারসি পল্লীতে ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের ছোট্ট একটি ঘরে কাজ করছিল ৯ বছরের শিশু ছামির। সে জানায়, দুই বছর থেকে সে চুমকি ও জরি বসানোর কাজ করছে। বেতন পায় সপ্তাহে ৫০০ টাকা করে। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার পর মা-বাবা তাকে কাজে দিয়েছে। ছামির জানায়, তার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছে। তার বাবা বলেছে, ভালো করে কাজ করলে তাকে আগামী বছর স্কুলে ভর্তি করে দেবে। সেই স্বপ্ন চোখে নিয়ে রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছে শিশু শ্রমিক ছামির। তাহেরা জরি হাউসের মালিক মাহমুদ আল কাদেরি। ওই সময় তিনি কারখানায় ছিলেন না। জানান, তার কারখানায় ৭ জন শ্রমিক কাজ করে। যাদের অধিকাংশেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। পাশেই আরেকটি খুপড়িতে দেখা গেছে রোকেয়া নামের ৯-১০ বছরের একটি মেয়েশিশু চুমকি বসানোর কাজ করছে বেনারসিতে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিশুদের হাতে চুমকি ও জরি বসানোর কাজ অত্যন্ত নিখুঁত হয়। তাই এসব কারখানার মালিকরা শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেয় বেশি।
মিরপুর বেনারসি পল্লী কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সৈয়দ রিয়াজ উদ্দিন জানান, বেনারসি শ্রমিকরা রাত-দিন পরিশ্রম করে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। উন্নতমানের শাড়ি তৈরি করে বিদেশ থেকে শাড়ির আমদানি কমিয়ে টাকা সাশ্রয় করছে। অথচ এসব শ্রমিকের কোনো বেতন কাঠামো নেই, কোনো ওভারটাইম নেই। তাদের মজুরি গার্মেন্ট শ্রমিকদের চাইতেও অনেক কম।
এদিকে বেনারসি পল্লীর দোকানগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, নানা ডিজাইনের বাহারি শাড়িতে শোরুমগুলো ঠাসা। পাইকারি ও খুচরা বিক্রিও বেশ ভালো। দেশি-বিদেশি ক্রেতার পাশাপাশি পাইকাররাও যাচ্ছে সেখানে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ মৌসুমে তাদের ভিড় বেশি থাকে। এখন ভিড় খুবই কম। তাছাড়া উত্পাদন খরচ বেশি হওয়ায় শাড়ির দাম একটু বেড়েছে। গুণগত মানের ভিন্নতার কারণে দামেও রয়েছে ভিন্নতা। দেশীয় শাড়ির পাশাপাশি বিদেশি শাড়িও দোকানগুলোতে রয়েছে। ভারতীয়-পাকিস্তানি শাড়ি, লেহেঙ্গা ও থ্রি-পিসও রয়েছে দোকানগুলোতে।
রমণী শাড়ি কুঠিরের বিক্রেতা জানান, বর্তমানে উত্পাদনের চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। প্রতি বছরই কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকায় উত্পাদন খরচ বাড়ছে। গত এক বছরে প্রতি পিস কাতান শাড়িতে গড়ে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা উত্পাদন খরচ বেড়েছে। রেশমি শাড়িতে আগে খরচ হতো ৩ হাজার টাকা, এখন তাতে ৬ হাজার টাকা খরচ পড়ছে। এ কারণে বর্তমানে শাড়ি একটু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মোহাম্মদী সিল্ক হাউসের শাড়ি বিক্রেতা বলেন, এখন শীতকাল। এসময় সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বেশি হওয়ায় শাড়ি বিক্রি ভালো।
No comments