হাসিনার পলায়ন ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে নাটকীয় ছায়া -পিটিআই’র রিপোর্ট

দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। এ বছর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্যদিয়ে এক অস্থিরতার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। এই ঘটনা ভারতের সঙ্গে দেশটির প্রচলিত শক্তিশালী সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলেছে। বাংলাদেশ এখন ভারতের কাছে তাকে ফেরত চাইছে। এর ফলে এই সম্পর্ক আরও উত্তেজনাকর হতে পারে। সরকারি চাকরিতে ছাত্রদের নেতৃত্বে কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে কয়েক সপ্তাহের প্রতিবাদ বিক্ষোভে ক্ষমতাচ্যুত হন ৭৭ বছর বয়সী শেখ হাসিনা। ছাত্রদের বিক্ষোভ দেশ জুড়ে আন্দোলনে রূপ নেয়। তাতেই ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা শাসকগোষ্ঠীর ইতি ঘটে। অনলাইন পিটিআইয়ের খবরে এ কথা বলা হয়েছে।  

আগস্টে রাজনৈতিক নিষ্পেষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভে অংশ নেন লাখো মানুষ। বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী। সে সময়ে তাড়াহুড়ো করে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এ ঘটনা ঘটে তিনি চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র কয়েক মাস পরে। সরকারবিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভে বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মধ্যে সংঘর্ষকালে কমপক্ষে ১৫০০ মানুষ নিহত হন। এর মধ্যে আছেন ছাত্ররাও।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ৮৪ বছর বয়সী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের বিরোধ ছিল দীর্ঘদিনের। প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের প্রিয় ব্যক্তি তিনি। তাকে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। কিন্তু ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ৮ই আগস্ট ক্ষমতায় আসার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে। কয়েক মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করা হয়। এর মধ্যে আছেন হিন্দুরাও। এর মধ্যে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেপ্তার করার পর ভারতের উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। এ মাসের শুরুর দিকে ঢাকা সফরে এসে এই বার্তা জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর ভারতীয় প্রথম কোনো উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বাংলাদেশ সফরে আসেন। এ বিষয়ে থিংক ট্যাংক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজেস ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রধান এবং সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফর একটি বার্তা দিয়েছে। তা হলো, বাস্তব পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায় নয়াদিল্লি। তিনি শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরও উদ্ধৃতি দেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন শেখ হাসিনা। বলেছেন, তারা গণহত্যা করেছে। সংখালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

জবাবে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নোট ভারবাল বা কূটনৈতিক বার্তা দিয়েছে নয়াদিল্লিকে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের মন্ত্রীদের, উপদেষ্টাদের, সেনা ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল। অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করেছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে  জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে কমপক্ষে ৩৫০০ নাগরিককে। হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ কমপক্ষে ২০০ মামলা করা হয়েছে।

এখন ছাত্রনেতারা এক সময়ের শক্তিধর আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট আখ্যায়িত করে আগামী নির্বাচন থেকে তাদেরকে দূরে রাখতে চান। এমন অবস্থায় নিজেদের ভাগ্য ঝুলে আছে আওয়ামী লীগের। বিশ্লেষকরা বলেন, এটা হলে শুধু বড় দুটি দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং ডানপন্থি জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে তার প্রভাব পড়বে।
হুমায়ুন কবির এর আগে ভারতে ডেপুটি হাইকমিশনার এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, আগামী নির্বাচনের দৃশ্যপট কি হবে তা আন্দাজ করা খুব কঠিন। বিশেষ করে বড় দলগুলোর অংশগ্রহণের বিষয়ে।
আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মী জেলখানায় অথবা পালিয়ে আছেন। এ অবস্থায় তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে চালিয়ে নেবেন তা এখনো অনিশ্চিত। ওদিকে দেশের মুদ্রা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি মুছে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ। এর পরিবর্তে তাতে স্থান পাবে ধর্মীয় স্থাপনা, বাংলাদেশের রীতিনীতি এবং জুলাই গণআন্দোলনের ছবি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনায় ২০ টাকা, ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা এবং ১০০০ টাকার নোট ছাপা হচ্ছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে যে জাতীয় ছুটি পালন করা হতো তাও বাতিল করেছে। তবে তারা এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি। বিজয় দিবসের ভাষণে প্রফেসর ড. ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে হতে পারে নির্বাচন।

রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং ন্যাশনাল ইলেকশন অবজারভার পরিষদের প্রেসিডেন্ট নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, এতে মনে হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার সম্পন্ন করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার তার মেয়াদ দীর্ঘায়িত করছে বলেই মনে হচ্ছে।
অর্থনৈতিক মসৃণ প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নের একটি রোল মডেল বলে অনেক বছর ধরে দাবি করে আসছিল আওয়ামী লীগ শাসকগোষ্ঠী। কোভিড মহামারির আগে এক দশকে এখানে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বছরে শতকরা ৭ ভাগ হয়েছে। তবে তাদের এই বয়ানকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে রাষ্ট্র নিয়োজিত কমিটির শ্বেতপত্র। কমিটি বলেছে, তাদের উন্নয়নের গল্প ছিল বানানো। জাতীয় প্রবৃদ্ধির যে ফিগার দেয়া হয়েছে তাও বানোয়াট। ওদিকে ডিসেম্বরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বাংলাদেশের জন্য তার প্রবৃদ্ধি কম ধরেছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, গ্রামে বসবাসকারী গরিব নন (নন-পুওর) মানুষদের অর্ধেকই আবার দারিদ্র্যে নিপতিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। ক্ষমতাচ্যুত শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, প্রত্যাহার অথবা একপেশে করে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যুরোক্রেসি, পুলিশ প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় অন্য প্রতিষ্ঠানে বড় রকমের রদবদল করেছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ফেরানো এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার বড় কাজের মুখোমুখি হবে এই সরকার।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.