কুয়াশায় ঢাকা শিশিরভেজা মাঠ, হলুদাভ শস্যক্ষেত চোখ জুড়ানো দৃশ্য- নীলফামারীর গ্রামে শর্ষের চাষ by তাহমিন হক ববি
গ্রামাঞ্চলের দৃশ্যপট বদলে গেছে। সকাল-সন্ধ্যায় ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন আবহমানকাল থেকে এ বাংলায় ঋতুতে ঋতুতে প্রকৃতির রূপবদলের যে অপার বৈচিত্র্য সবুজ শ্যামল প্রকৃতির ষড়ঋতুর এই দেশে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির রূপও বদলে যায়।
বদলেছে ফসলের ধরন। শীত এখানে ফুল-ফল, ফসলের ঘ্রাণ নিয়ে তার সৌন্দর্য ও উৎসব পরিপূর্ণ জীবনের পসরা সাজায়। কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে সুয্যি মামা আলো ছড়াতে থাকে। ভারি উপভোগ্য দৃশ্য! উত্তরের হিমশীতল হাওয়া বইতে থাকে ধীরে ধীরে। গাছগাছালি থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়ে শিশির। যত সময় যায় ততই বাড়তে থাকে শীতের তীব্রতা। এ সময়ে চোখে ভেসে ওঠে মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে দৃষ্টির শেষ প্রান্ত অবধি দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা সরিষা ক্ষেত। দূরে শিশিবিন্দু কুয়াশার ম্লান আঁচলে চোখে পড়ে গ্রামের কোন বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান শেষে ভোরে ছইঘেরা গরুর গাড়ির ভেতর নববধূ নিয়ে ঘরে ফিরছে বর। আর সামনের দিকটায় কাঁচা হলুদ ফুলগুলো ঝলমল করছে। তাদের ওপরে গুনগুন করছে মৌমাছির ঝাঁক। মৃদু ঝাঁঝালো সৌরভে মধুগন্ধি হয়ে ওঠে বাতাস। সবুজ গ্রামবাংলার প্রকৃতিজুড়ে যে শীত নামে, তার চেয়ে রূপসী আর কেউ নয়। সরিষার ফুলে ফুলে মৌমাছিরাও মধু সংগ্রহে নেমে পড়েছে গুনগুনিয়ে।শীতের শিশিরসিক্ত মাঠভরা সরিষা ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসছে। মানুষের মনকে পুলকিত করছে। দিগন্ত জুড়ে সরিষা ফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য শোভা পাচ্ছে। প্রকৃতি যেন নয়ন জুড়ানো হলুদ আভা রূপ নিয়েছে। এখন সরিষা চাষের মৌসুম। সরিষা ক্ষেতের হলুদিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ভরিয়ে তুলেছে ফসলের মাঠ। এ যেন প্রকৃতির রূপের খেলা। সরিষা চাষে দ্বিগুণ লাভ, ফুল ও পাতা ঝড়ে জৈব সার তৈরি করে জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় নীলফামারীসহ রংপুর কৃষি অঞ্চলের অনেক কৃষক সরিষা চাষে ঝুঁকে পড়ছে। এবারের মৌসুমে সরিষা চাষ করে গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হবে বলে জানিয়েছে সরিষা চাষীরা।বর্তমানে সরিষার বাজার অত্যন্ত চড়া। ফলে সরিষার আবাদ এবার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তরবঙ্গের রংপুর বিভাগের কৃষি অঞ্চলে আট জেলায় এবার সরিষা আবাদে ৪০ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধায় ৭ হাজার ২৪৫ হেক্টর, রংপুরে ৩ হাজার ১২০ হেক্টর, নীলফামারীতে ১ হাজার ৫১০ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৮৩১ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ১০ হাজার ৬৬৮ হেক্টর, পঞ্চগড়ে ৪২৫ হেক্টর, ঠাকুরগাঁওয়ে ৯ হাজার ৩শ’ হেক্টর ও দিনাজপুরে ৭ হাজার ৪৮০ হেক্টর। সূত্র মতে, লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে সরিষার আবাদ হয়েছে প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে। গত বছর এ অঞ্চলের ৩৮ হাজার ৭৬৩ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল। এবারে রংপুর বিভাগের আট জেলায় বাম্পার সরিষা আবাদে কৃষি বিভাগের কর্মকতারা নিজেরা অবাক হয়ে পড়েছেন। তাঁরা বলছেন, কয়েক বছর আগে এমনিভাবে সরিষার চাষ এ এলাকায় হতো না। কিন্তু বর্তমানে সরিষা চাষের ওপর কৃষকরা ঝুঁকে পড়েছেন। কৃষকরা বলছেন, বাজারে বর্তমান সরিষার মণ ২ হাজার ২শ’ থেকে ২ হাজার ৩ শ’ টাকা চলছে। প্রতি বিঘায় ৭ থেকে ৮ মণ সরিষার আবাদ হলে অন্যান্য ফসলের চেয়ে দাম বেশি পাওয়া যাবে।
সরিষার বৈজ্ঞানিক নাম ব্রাসিকা বা ক্রুসিফেরি। তেল প্রদায়ী দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ। সরিষার দানা মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও সরিষার দানা পানির সঙ্গে মিশিয়ে ভিনেগারসহ বিভিন্ন তরল তৈরি করা হয়, দানা পিষে সরিষার তেল তৈরি করা হয় যা রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। সরিষার পাতা সরিষা শাক বা সর্ষে শাক হিসেবে খাওয়া হয়। সরিষা এক বর্ষজীবী উদ্ভিদ। এর উৎপত্তিস্থল এশিয়া। ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মতো বাংলাদেশে শীতকালীন রবিশস্য হিসেবে সরিষার চাষ করা হয়। সরিষার গাছ দৈর্ঘ্যে ১ মিটারের মতো হয়, তবে রাই সরিষা ২ মিটার উঁচু হতেও পারে। বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের প্রায় ৬০ ভাগ আসে সরিষার তেল থেকে এবং এটিই আমাদের ভোজ্যতেলের প্রধান উৎস। বিভিন্ন জাতের সরিষা বীজে ৩৮-৪৪% তেল থাকে আর বাকিটা খৈল ২৫% ও ৪০% আমিষ। এই খৈল গৃহপালিত পশুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে প্রতি হেক্টরে সরিষার ফলন হয় ১.৫ থেকে ২.০ মেট্রিক টন। আবার দেশের অঞ্চল ভেদে ফলন বেশি ও কম হতে পারে। বোনা আমন ফসল তুলে ফেলার পর করা হয় সরিষার চাষ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর রেকর্ড পরিমাণ সরিষার চাষ হয়েছে। পোকার আক্রমণ আর রোগবালাই না থাকায় সরিষার বাম্পার ফলনের নিশ্চয়তা নিয়ে খুশি কৃষকরা। কৃষকরা জানায়, বীজ বোনার ৮৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে সরিষা ঘরে তোলা যায়। পরবর্তী ফসলের আবাদে কোন সমস্যা হয় না, বেশি সারেরও প্রয়োজন হয় না। শুধু ইউরিয়া সার সামান্য ব্যবহার করলেই হলো। চারা গজানোর পরপরই আগাছা ভালভাবে একবার পরিষ্কার করলেই হলো। এ ছাড়া অতিরিক্ত শ্রমের প্রয়োজন হয় না।
নীলফামারী ডিমলার সুন্দরখাতা গ্রামের মফিজ উদ্দিনের পুত্র খলিল তাঁর আবাদী ২ একর ২০ শতক জমিতে সরিষা বপন করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি জানান, ১০ বছর যাবত নিজ উদ্যোগে আবাদযোগ্য জমিতে সরিষা চাষ করে প্রতি মৌসুমে ৫০ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত লাভ করে আসছেন। চলতি মৌসুমে সরিষার ফলন বেশি হওয়ায় এবং বর্তমান বাজার দর তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এবার বেশি লাভের আশা করছেন তিনি। কৃষি বিভাগের মতে, উত্তরাঞ্চলের জমি সরিষা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। অন্যান্য এলাকার চেয়ে উত্তরাঞ্চলের সরিষার দানা পরিপূরক হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি। ফলে এ অঞ্চলের সরিষার চাহিদা দেশ জুড়ে। সরিষা চাষে সাফল্য অর্জন করতে রামডাঙ্গা গ্রামের মকবুল হোসেন বলেন, ভাল বীজ শনাক্ত করে সঠিক সময় বীজ রোপন, সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়, রোগ নিরাময়ের জন্য সঠিক মাত্রায় কীটনাশকসহ ফুলফল বাড়ানোর জন্য ভিটামিন ও
বিভিন্ন প্রকার সার প্রয়োগ করতে হয়। নাউনারা ভাটিয়াপাড়া গ্রামের জমশের আলী বলেন, ১ বিঘা সরিষা চাষ করতে খরচ হয় ১ থেকে দেড় হাজার টাকা। ভাল ফলন হলে বিঘায় ৫ হতে ৬ মণ সরিষা পাওয়া যায়। অন্যান্য ফসল চাষ করে প্রতিবিঘায় যে পরিমাণ লাভ হয় তার চেয়ে ঐ পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ করে দ্বিগুণ বেশি লাভ পাওয়া যায়। তাছাড়া সরিষা চাষ করলে ফুল ও পাতা ঝরে পড়ে জৈবসার তৈরি হয়ে জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে। সে কারণে এ জমিতে পরবর্তীতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না ও ধানের ফলনও ভাল হয়। সরিষা চাষে একদিকে যেমন বেশি লাভ হয় অন্য দিকে জমির উর্বরা শক্তি বাড়ায়। এ ব্যাপারে ডিমলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফতাব হোসেন জানান, এ এলাকার জমি বেলে দোয়াশ পানি ধারণের ক্ষমতা কম, পানি ধারণক্ষমতার জন্য জমিতে জৈব সারের প্রয়োজন। সরিষা চাষ করলে খাবার তেলের চাহিদা পূরণসহ জমিতে পানি ধারণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
No comments