সম্পর্কেও নতুন দিগনত্ম
রাজু আহমেদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্যদিয়ে দু'দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কে নতুন দিগনত্ম উন্মোচিত হয়েছে। দ্বিপাৰিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে গুরম্নত্বপূর্ণ তিনটি চুক্তি এবং দু'টি সমঝোতা স্মারক স্বাৰর ছাড়াও দু'দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠককালে পারস্পরিক সম্পর্কিত সকল বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা নানা সমস্যা সমাধানের পথনির্দেশনা তৈরি করেছে।
বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত এই সফরের মধ্যদিয়ে শুরম্ন হওয়া ইতিবাচক প্রয়াসগুলোকে অগ্রসর করতে পারলে নিকটতম প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে বলে রাজনৈতিক বিশেস্নষক, অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন।২০০১ সালের পর থেকে একটি দৰিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রৰমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ওই সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রভাব স্পষ্ট ছিল। '৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এবং তাদের দোসর হিসেবে বিএনপির সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বিসর্জন দিয়ে পাকিসত্মানী ভাবধারায় রাষ্ট্র পরিচালনায় সচেষ্ট ছিল। বৈদেশিক সম্পর্কের ৰেত্রেও একই ধরনের প্রভাব স্পষ্ট ছিল। দৰিণ এশিয়ার ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতির চেয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিই তাদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। আর আঞ্চলিক ও আনত্মর্জাতিক সম্পর্কের ৰেত্রে পাকিসত্মানের এজেন্ডা বাসত্মবায়নই ছিল তাদের মূল লৰ্য। উগ্র সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে একদিকে যেমন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হয়েছে, অন্যদিকে এ অঞ্চলের দেশে দেশে তৎপর বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গী গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে অস্থিতিশীল করে তোলার অপচেষ্টায় নানাভাবে মদদ দেয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত আমলের এসব অপতৎপরতার অনেক চিত্রই ইতোমধ্যে প্রকাশ হয়ে গেছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতেও সাম্প্রদায়িকতা ও অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে একদিকে যেমন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা রয়েছে, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা চালিয়ে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করারও নানামুখী তৎপরতা চলছে। ফলে সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ, বাংলাদেশ ও ভারত, দু'দেশের জন্যই হুমকি হিসেবে আবিভর্ূত হয়েছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী প্রধান দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সপৰ শক্তি সরকার গঠন করে। ওই নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরম্নদ্ধে বিপুল গণরায় দিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে শুধু বাংলাদেশেই অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতার বিজয় অর্জিত হয়নি_ সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র জঙ্গীবাদের ভয়ঙ্কর ছোবল থেকে উপমহাদেশকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ রচনা করেছে। ধর্মনিরপেৰ চেতনার ধারক দুই দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাৰিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে অপশক্তির বিরম্নদ্ধে কঠিন লড়াইয়ের ভবিষ্যত। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় চুক্তি স্বাৰরের মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানের বিরম্নদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের শুভসূচনা করেছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর।
ৰমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার এক বছরের মাথায় ভারত সফরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চার দিনের এই সফরের সব কর্মসূচী ছাপিয়ে বাংলাদেশ-ভারত তো বটেই দৰিণ এশিয়ার মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাৰিক বৈঠক। গত সোমবার দিলস্নীর হায়দারাবাদ হাউসে কাঙ্ৰিত সেই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে দু'দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নিরাপত্তার ৰেত্রে বিদ্যমান সব সমস্যাই আলোচনায় এসেছে। বৈঠক শেষে স্বাৰরিত হয়েছে তিনটি গুরম্নত্বপূর্ণ চুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে_ অপরাধ দমন, সাজাপ্রাপ্ত বন্দী বিনিময় এবং আনত্মর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংঘবদ্ধ অপরাধ ও অবৈধ মাদক পাচার রোধে একযোগে কাজ করার প্রত্যয়। এছাড়া বিদু্যত খাতে সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচী সম্পর্কিত দু'টি সমঝোতা স্মারক স্বাৰরিত হয়েছে। সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিরসন, টিপাইমুখ বাঁধ, তিসত্মাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন, ভারতের ভেতর দিয়ে নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট প্রদান, বাংলাদেশী পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ও অশুল্ক বাধা দূর করাসহ বাংলাদেশের স্বার্থসংশিস্নষ্ট বিষয়গুলোতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। বর্তমান সফরে কোন চুক্তি না হলেও শীঘ্রই এসব বিষয়ে আরও অগ্রগতি হবে বলে আশা করা যায়। কারণ দু'টি দেশের শীর্ষ পর্যায়ে কোন বিষয়ে আলোচনা হওয়া মানেই দু'পৰই এগুলোকে গুরম্নত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। আর দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা মানেই পরবর্তীতে কর্মকর্তা পর্যায়ে 'ফলোআপ' করে সুনির্দিষ্ট সমাধানের পথ তৈরি হওয়া। অর্থাৎ তিসত্মার পানি বণ্টনসহ দীর্ঘ দিন ধরে ঝুলে থাকা বিষয়গুলোতে আনুষ্ঠানিক চুক্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি স্বাৰর এই অঞ্চলের জন্য অত্যনত্ম তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যদিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখা একটি গুরম্নত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হলো। কারণ দীর্ঘ সীমানত্ম যুক্ত থাকায় এক দেশের অপরাধীরা সহজেই অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দু'দেশেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়া জরম্নরী। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ নিমর্ূলের অঙ্গীকার নিয়ে যে চুক্তিটি হয়েছে তা দৰিণ এশিয়ার জন্যই গুরম্নত্বপূর্ণ। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ শুধু বাংলাদেশ বা ভারতের সমস্যা নয়, এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও ভারতের প্রয়াসের সঙ্গে দৰিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশকে যত দ্রম্নত ও কার্যকরভাবে যুক্ত করা যাবে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় তত দ্রম্নত সফলতা আসবে।
অর্থনৈতিক ৰেত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ইসু্য হলো বাণিজ্য ঘাটতি। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে এ বিষয়টিও গুরম্নত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। ভারতের পৰ থেকে বাংলাদেশী পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতা বাড়ানোর নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। একইভাবে পণ্য রফতানিতে বিদ্যমান শুল্ক বহিভর্ূত বাধা দূর করার আশ্বাসও দিয়েছেন মনমোহন সিং। ফলপ্রসূ আলোচনার মধ্যদিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভারতের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির বিদ্যমান সমস্যাগুলো দূর করা হবে বলে আশা করা যায়। এৰেত্রে মনে রাখতে হবে, দৰিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) কার্যকর হওয়ার পর প্রায় ৪ বছর কেটে গেছে। দ্বিপাৰিক সম্পর্ক তো বটেই সাফটার আওতায় প্রাপ্ত সুবিধাটুকুও কাজে লাগাতে পারেনি বিগত সরকার। অথচ সাফটার মধ্যে থেকেও দ্বিপাৰিক চুক্তি করে ভারতের কাছ থেকে বিপুলসংখ্যক পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায় করে নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশও একই রকম সুবিধা আদায় করতে পারে।
যদিও অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে হলে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশ নিয়ে ভারতের সঙ্কীর্ণতা দূর করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হলেও আমলাতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক জটিলতা ভারতের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বাধা দূর করতে বাংলাদেশকে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ভারতকে হতে হবে উদার। এ বিষয়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্যদিয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অগ্রসর করার পথ রচিত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ইতিবাচক পদৰেপগুলো কার্যকর করতে হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা ও শুল্কবহিভর্ূত বাধা দূর করার জন্য সময়সীমা নির্দিষ্ট করতে হবে। একইসঙ্গে এসব সহযোগিতাকে আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রসারিত করতে পারলে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। সফরের আরেকটি গুরম্নত্বপূর্ণ অর্জন হলো_ নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতের মধ্যদিয়ে ট্রানজিট পাওয়ার প্রতিশ্রম্নতি আদায়। ভারতের দেয়া এই প্রতিশ্রম্নতি কার্যকর হলো বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হবে। বিদু্যত খাতের উন্নয়নে দু'দেশের সহযোগিতা পারস্পরিক সম্পর্কে আরও জোরদার করবে। তবে এ সংক্রানত্ম বিধিমালা প্রণয়নে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, নেপাল-ভুটানে পণ্য চলাচলে ট্রানজিটের প্রতিশ্রম্নতি দৰিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের পণ্য বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে। পাশাপাশি ভারতের ৭টি রাজ্যে পণ্য চলাচলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের বিষয়টি যুক্ত করতে পারলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।
ভারতের সঙ্গে স্বাৰরিত সংস্কৃতি বিনিময় সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারক শুধু সরকারী পর্যায়েই নয়_ দু'দেশের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। সরকারী প্রচেষ্টার দু'দেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই পারে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, ৰুধা-দারিদ্র্য এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরম্নদ্ধে লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করতে।
সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর জাতীয়, দ্বিপাৰিক ও আঞ্চলিক সম্পর্কের পাশাপাশি আনত্মর্জাতিক রাজনীতির ৰেত্রেও নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। এই সফর বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক সম্পর্কের ৰেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা ফিরিয়ে আনবে। দ্বিপাৰিক ৰেত্রে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করবে। আঞ্চলিক পর্যায়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নিমর্ূলে ভূমিকা রাখবে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরে ভারতের দিক থেকে যেসব ইতিবাচক প্রতিশ্রম্নতি পাওয়া গেছে আগামী দিনে সেগুলো বাসত্মবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর এজন্য সবচেয়ে জরম্নরী দেশের অভ্যনত্মরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। প্রধানমন্ত্রীর ফেরার পথে 'কাঁটা' না বিছিয়ে বিরোধী দলসহ সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলে ভবিষ্যতে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে আরও অনেক বেশি কিছু আদায় করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান সফর তার ভিত্তি তৈরি করতে পেরেছে বলে বিশেস্নষকরা মনে করেন।
No comments