কৃষি অর্থনীতি-খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তাদাতা কৃষকের বঞ্চনা নয় by মাহবুব হোসেন
বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন ৯০ ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করত। এখন দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। জেলা ছাড়িয়ে অনেক উপজেলা সদরও যেন শহর। আর রাজধানী ঢাকা তো দেশের ১০ শতাংশের মতো অধিবাসীকে ধারণ করছে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান এবং প্রধান শস্য ধান। এ ধান উৎপাদন হয় গ্রামে এবং এর সঙ্গে জড়িত কৃষক ও ক্ষেতমজুর। তাদের পরিবারের নারীরাও নানাভাবে কৃষি কাজে যুক্ত। এই গ্রামের কৃষক পরিবারগুলো তাদের জমিতে শ্রমে ও ঘামে যে ধান উৎপাদন করছে তার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। বাজারে ধান-চালের দাম যথেষ্ট কম এবং যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা হচ্ছে_ কৃষকরা উৎপাদন ব্যয়ও তুলে আনতে পারছে না। তবে শহরে যারা চালের ক্রেতা, তাদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি স্বস্তির। শ্রমজীবীরাও খুশি। তারা বেশ কম মূল্যেই প্রধান খাদ্যশস্যের জোগান পাচ্ছে। এ কারণেই প্রশ্ন উঠছে_ গ্রামের মানুষ কেন নিজের পকেটের পয়সায় শহরের মানুষের জন্য সস্তায় খাদ্যের জোগান দেবে। এটা যে একবারের জন্য ঘটছে তা নয়। কৃষকের বঞ্চনা এখন অনেকটা নিয়মিত।
এবার বোরো ফসল খুব ভালো হয়েছিল। আমনও ভালো হয়েছে। বলা যায়, আমরা মৌসুমের পর মৌসুম বাম্পার ফলন পাচ্ছি। সরকারের গুদামে এখন ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা। আমন চাল কিনে মজুদ রাখবে কোথায়? সঙ্গত কারণেই বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি। মৌসুমের শুরুতে এমনিতেই ধানের দাম কিছুটা কম থাকে। এবারে আরও কম। চালের মজুদ যাদের রয়েছে_ ধনী কৃষক এমনকি কিছু মাঝারি কৃষক, তারা বোরোর সময়ের মজুদ ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে বাজারে নিম্নগতি। প্রকৃতপক্ষে গত ১৮ মাস ধরেই বাংলাদেশের চালের বাজার রয়েছে নিম্নপর্যায়ে।
চালের বাজারে চাহিদার হঠাৎ করে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে না। আমাদের লোকসংখ্যা বাড়ছে। মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণেও কিছু হেরফের ঘটে। এ কারণে দীর্ঘমেয়াদে চাহিদা বাড়তে থাকে। এক সময়ে বছরে দুই কোটি টন চালেই চলত। এখন সাড়ে তিন কোটি টন উৎপাদন হচ্ছে। আগামীতে আরও পরিবর্তন ঘটবে। এ প্রবণতা চলবে। কিন্তু বাম্পার ফলনের কারণে যে বাড়তি ফসল বাজারে আসে তার সবটা বাজার নিয়ে নেবে, এমনটা হয় না। এ অবস্থায় বাজারে বাড়তি জোগানের সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব পড়ে মূল্যে। একদিকে নতুন ফসল, পাশাপাশি যাদের ঘরে মজুদ ছিল তাদের গুদাম খালি করে বাজারে ছেড়ে দেওয়া_ এভাবেই বাড়তি সরবরাহ সৃষ্টি হয়।
একটা সময় ছিল যখন ক্ষুদ্র এমনকি মাঝারি কৃষকরাও জমিতে ধান বিক্রি করে দিত নগদ অর্থের প্রয়োজন মেটাতে। ক্ষুদ্রঋণ, প্রবাস থেকে পরিবারের সদস্যদের পাঠানো অর্থ এবং অর্থনীতিতে সার্বিক কিছু অগ্রগতি_ এসব কারণে অনেক কৃষক অপচনশীল নয় এমন কৃষিপণ্য (যেমন ধান ও পাট) দাম দেখেশুনে বাজারে ছাড়তে পারে। এবারে এই বাড়তি জোগান সচ্ছল ও মাঝারি কৃষকের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে। অনেকেই বলছেন, উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামেই ধান বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। সাধারণত খাদ্য চাহিদা জোগানের ওপর নির্ভর করেই খাদ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। জোগানে ঘাটতি মনে হলে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উদ্বৃত্ত হলে তা সরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে জমা থাকে। কিন্তু রফতানির বিষয়টি এখনও বিশেষ বিবেচনায় নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থা হচ্ছে 'ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়ার মতো'। ২০০৭ সালের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। তখন বিদেশ থেকে কেনার মতো অর্থ ছিল সরকারের হাতে। কিন্তু বাংলাদেশকে চাল বিক্রির জন্য আগ্রহী দেশ পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের আমদানির প্রধান উৎস ভারত। কিন্তু তারা বিপদ হতে পারে ধরে নিয়ে চাল রফতানি করতে রাজি ছিল না। এমনকি এর প্রতিশ্রুতি দিয়েও অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ভালো মজুদ রাখাকেই অগ্রাধিকার দেয়।
গত বছর সরকার প্রতি কেজি ২৮ টাকা দরে চাল কিনতে চেয়েছে। এবারে কমিয়ে করা হয়েছে ২৬ টাকা। সংগ্রহ মূল্য কেন কমানো হলো সে প্রশ্ন সঙ্গত। সরকারের যুক্তি হচ্ছে_ বাজারে ২৬ টাকা বা তার চেয়েও কম দামে চাল মেলে। এখন যদি আমন মৌসুমে ২৮ টাকা দাম রাখা হয়, তার সুফল ভোগ করবে মিলার ও সচ্ছল কৃষকরা। কারণ ঘরে ঘরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান বা চাল কেনার মতো অবস্থা এখন পর্যন্ত বিরাজ করছে না। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিনামূল্যে ও নির্ধারিত মূল্যে চাল বিতরণ এবং বিক্রির কর্মসূচি সরকারের রয়েছে। কিন্তু এখন চালের দাম যেহেতু যথেষ্ট সহনশীল পর্যায়ে রয়েছে, তাই এ ধরনের কর্মসূচিতে চাহিদা কমে গেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম এখন বেশি। হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে যা গড় দাম তার তুলনায় ৬০ শতাংশ দামেই চাল কেনা হয় বাংলাদেশের বাজারে। ভোক্তাদের জন্য এ পরিস্থিতি খুব ভালো। কিন্তু আমাদের কৃষকরা বিশ্ববাজারের এ রমরমা অবস্থার সুযোগ নিতে পারছে না। এর প্রধান কারণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘকাল ধরে অনুসৃত নীতি। কৃষকরা উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় দাম কম পাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে বিক্রি করে লাভবান হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না। কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থে এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার তাগিদ রয়েছে; কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
আমরা যদি চাহিদা বাড়াতে পারি তাহলে ধান-চালের বাজারে প্রভাব পড়তে পারে। এটা দু'ভাবে করা সম্ভব_ এক. সরকারের সংগ্রহ বাড়িয়ে ভালো মজুদ গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে মজুদ রাখার সীমিত সামর্থ্য। দুই. বিদেশে রফতানি। এভাবে উৎপাদক তথা কৃষকের জন্য কিছু লাভ এনে দেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ কৃষকের জন্য ধান হচ্ছে আয়ের প্রধান উৎস। মোট আবাদযোগ্য জমির চার ভাগের তিন ভাগে ধান চাষ হয়। ধানের দাম কম থাকলে কৃষকের জীবনযাপনে তার গুরুতর প্রভাব পড়ে। তারা শিল্পপণ্য কিনতে পারে কম। ২০০৭ সালের পর ২-৩টি মৌসুমে ধানের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা জামা, জুতা, ঘরবাড়ির নির্মাণসামগ্রী_ এসব কেনায় যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির চিত্র দেখেও তার প্রমাণ মেলে। কিন্তু প্রায় দেড় বছর ধরে ধানের দাম নিম্নমুখী থাকায় চালের ক্রেতারা স্বস্তিতে থাকলেও শিল্প খাতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে কৃষকের সামনে একটি বিকল্প রয়েছে_ ধানের জমির একটি অংশে আলু-ভুট্টা-সবজি ইত্যাদি ফসল চাষ। কিংবা ধান চাষ করলেও উচ্চফলনশীল জাতের চাষ কমিয়ে দেবে। কারণ, এতে সার-বীজ-সেচ ইত্যাদি খাতে ব্যয় বেশি পড়ে। উপকরণের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও সৃষ্টি হতে পারে। বারবার লোকসানের মুখে পড়ে কৃষক যদি এ ধরনের বিকল্প কিছু মাত্রায় হলেও বেছে নেয়, তাহলে মোট ধান উৎপাদন কমে যেতে পারে এবং তার প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘি্নত হতে পারে। ফলে দাম কমার কারণে বাজারে স্বস্তিদায়ক অবস্থা বিরাজ করছে সেটা আর থাকবে না। বাজার ফের চড়ে যাবে এবং তার প্রভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ বাড়বে। সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও টান পড়বে। দেশে ও বিদেশে দাম বেশি থাকলে সরকারকে বেশি দামে খাদ্য কিনতে হবে এবং এর অর্থ হচ্ছে বেশি পরিমাণে ভর্তুকি প্রদান। ফলে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনাতেও দেখা দেবে বাড়তি সমস্যা।
চাল রফতানির প্রশ্নে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণ আগেই বলেছি_ বিশ্ববাজারের সংকটই এ মনোভাব তৈরি করছে। ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে অস্থিরতার পাশাপাশি আরও সমস্যা ছিল_ সিডর ও বন্যার কারণেও উৎপাদন কম হওয়া। ফলে দেশের বাজারেও দাম বেড়ে যায়। গরিব ভোক্তাদের জন্য এ পরিস্থিতি ছিল বিশেষ কষ্টদায়ক। মানুষ কাপড় বা ঘর বানানোর টিন বা কাঠের জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু খাদ্য তো রোজই চাই এবং একাধিকবার চাই। এ পণ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়ে গেলে জনরোষ সৃষ্টি হয় এবং তার পরিণতিতে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যেতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। আকস্মিক ঝড়-বন্যা-খরায় ফসল উৎপাদন কম হলে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, সেটাই শঙ্কার কারণ। উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্যের যথার্থতাও প্রশ্নের ঊধর্ে্ব নয়। চাহিদা নিয়েও বক্তব্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর অভিন্ন হিসাব দিচ্ছে না। ফলে খাদ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত হতে পারছে না যে বাজারে কত উদ্বৃত্ত বা ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বা বিআইডিএস উৎপাদন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে একটি সমীক্ষা করে জানায় যে, সরকার যা বলছে প্রকৃত উৎপাদন সম্ভবত তার তুলনায় ২০ লাখ টনের মতো কম। বিশেষ করে আমন মৌসুমে উৎপাদন বেশি দেখানো হয়। তবে চাহিদার বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। দেশের জনগণের সার্বিক মাথাপিছু আয় বাড়ছে। তুলনামূলকভাবে চালের চাহিদা বাড়ছে না। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০০৫-০৬ সালের তুলনায় মাথাপিছু চালের চাহিদা বছরে দুই কেজি কমেছে। জাপানে ১৯৫০ সালে বছরে প্রতিজন ১৫০ কেজি চাল গ্রহণ করত। এখন তা কমে হয়েছে ৫৫ কেজি। দক্ষিণ কোরিয়াতেও মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের ওপর চাপ কমতে দেখা গেছে। বাংলাদেশেও চালের চাহিদা কিছুটা কমছে এবং তা পূরণ করছে সবজি, মাছ, ডিম, দুধ ও ফলের মতো খাদ্যদ্রব্য। শহর ও গ্রাম উভয় এলাকাতেই এ চিত্র কমবেশি অভিন্ন। পেশার পরিবর্তনও এর অন্যতম কারণ। কায়িক শ্রমে নিযুক্ত লোকের সংখ্যা কমছে। বাড়ছে মানসিক শ্রম। যান্ত্রিক চাষের আওতায় আসছে বেশি বেশি জমি। মাথাপিছু চালের চাহিদা কমার সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, উৎপাদন যেমন কিছুটা বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে, তেমনি চাহিদাও নিম্নমুখী। এ কারণে বাজারে জোগানে তেমন প্রভাব পড়ছে না।
এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে সরকারের উচিত হবে সীমিত পরিমাণে রফতানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বর্তমান অবস্থায় ৫ থেকে ১০ লাখ টন চাল রফতানি হলে দেশের বাজারে জোগানে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ দায়িত্ব সরকারের নয়, বরং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারবে। সরকারকে কেবল কঠোর মনিটরিং চালু রাখতে হবে, যাতে বিশ্ববাজারে চড়া দাম পাওয়ার কারণে প্রলুব্ধ হয়ে ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত পরিমাণের বেশি রফতানি করে না ফেলেন। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কৃষকের ক্ষতি করে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। যে কৃষককুল সরকারের জন্য চালের বাজারে স্বস্তি এনে দিয়েছে তাকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বর্তমান সরকার চাল রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়ে এ কৃতিত্বও নিতে পারে যে তাদের আমলে দেশ কেবল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়নি, রফতানিকারক দেশেও পরিণত হয়েছে।
ড. মাহবুব হোসেন :কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং প্রধান নির্বাহী, ব্র্যাক
এবার বোরো ফসল খুব ভালো হয়েছিল। আমনও ভালো হয়েছে। বলা যায়, আমরা মৌসুমের পর মৌসুম বাম্পার ফলন পাচ্ছি। সরকারের গুদামে এখন ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা। আমন চাল কিনে মজুদ রাখবে কোথায়? সঙ্গত কারণেই বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি। মৌসুমের শুরুতে এমনিতেই ধানের দাম কিছুটা কম থাকে। এবারে আরও কম। চালের মজুদ যাদের রয়েছে_ ধনী কৃষক এমনকি কিছু মাঝারি কৃষক, তারা বোরোর সময়ের মজুদ ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে বাজারে নিম্নগতি। প্রকৃতপক্ষে গত ১৮ মাস ধরেই বাংলাদেশের চালের বাজার রয়েছে নিম্নপর্যায়ে।
চালের বাজারে চাহিদার হঠাৎ করে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে না। আমাদের লোকসংখ্যা বাড়ছে। মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণেও কিছু হেরফের ঘটে। এ কারণে দীর্ঘমেয়াদে চাহিদা বাড়তে থাকে। এক সময়ে বছরে দুই কোটি টন চালেই চলত। এখন সাড়ে তিন কোটি টন উৎপাদন হচ্ছে। আগামীতে আরও পরিবর্তন ঘটবে। এ প্রবণতা চলবে। কিন্তু বাম্পার ফলনের কারণে যে বাড়তি ফসল বাজারে আসে তার সবটা বাজার নিয়ে নেবে, এমনটা হয় না। এ অবস্থায় বাজারে বাড়তি জোগানের সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব পড়ে মূল্যে। একদিকে নতুন ফসল, পাশাপাশি যাদের ঘরে মজুদ ছিল তাদের গুদাম খালি করে বাজারে ছেড়ে দেওয়া_ এভাবেই বাড়তি সরবরাহ সৃষ্টি হয়।
একটা সময় ছিল যখন ক্ষুদ্র এমনকি মাঝারি কৃষকরাও জমিতে ধান বিক্রি করে দিত নগদ অর্থের প্রয়োজন মেটাতে। ক্ষুদ্রঋণ, প্রবাস থেকে পরিবারের সদস্যদের পাঠানো অর্থ এবং অর্থনীতিতে সার্বিক কিছু অগ্রগতি_ এসব কারণে অনেক কৃষক অপচনশীল নয় এমন কৃষিপণ্য (যেমন ধান ও পাট) দাম দেখেশুনে বাজারে ছাড়তে পারে। এবারে এই বাড়তি জোগান সচ্ছল ও মাঝারি কৃষকের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছে। অনেকেই বলছেন, উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামেই ধান বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। সাধারণত খাদ্য চাহিদা জোগানের ওপর নির্ভর করেই খাদ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। জোগানে ঘাটতি মনে হলে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উদ্বৃত্ত হলে তা সরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে জমা থাকে। কিন্তু রফতানির বিষয়টি এখনও বিশেষ বিবেচনায় নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থা হচ্ছে 'ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়ার মতো'। ২০০৭ সালের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। তখন বিদেশ থেকে কেনার মতো অর্থ ছিল সরকারের হাতে। কিন্তু বাংলাদেশকে চাল বিক্রির জন্য আগ্রহী দেশ পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের আমদানির প্রধান উৎস ভারত। কিন্তু তারা বিপদ হতে পারে ধরে নিয়ে চাল রফতানি করতে রাজি ছিল না। এমনকি এর প্রতিশ্রুতি দিয়েও অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ভালো মজুদ রাখাকেই অগ্রাধিকার দেয়।
গত বছর সরকার প্রতি কেজি ২৮ টাকা দরে চাল কিনতে চেয়েছে। এবারে কমিয়ে করা হয়েছে ২৬ টাকা। সংগ্রহ মূল্য কেন কমানো হলো সে প্রশ্ন সঙ্গত। সরকারের যুক্তি হচ্ছে_ বাজারে ২৬ টাকা বা তার চেয়েও কম দামে চাল মেলে। এখন যদি আমন মৌসুমে ২৮ টাকা দাম রাখা হয়, তার সুফল ভোগ করবে মিলার ও সচ্ছল কৃষকরা। কারণ ঘরে ঘরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান বা চাল কেনার মতো অবস্থা এখন পর্যন্ত বিরাজ করছে না। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিনামূল্যে ও নির্ধারিত মূল্যে চাল বিতরণ এবং বিক্রির কর্মসূচি সরকারের রয়েছে। কিন্তু এখন চালের দাম যেহেতু যথেষ্ট সহনশীল পর্যায়ে রয়েছে, তাই এ ধরনের কর্মসূচিতে চাহিদা কমে গেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম এখন বেশি। হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে যা গড় দাম তার তুলনায় ৬০ শতাংশ দামেই চাল কেনা হয় বাংলাদেশের বাজারে। ভোক্তাদের জন্য এ পরিস্থিতি খুব ভালো। কিন্তু আমাদের কৃষকরা বিশ্ববাজারের এ রমরমা অবস্থার সুযোগ নিতে পারছে না। এর প্রধান কারণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘকাল ধরে অনুসৃত নীতি। কৃষকরা উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় দাম কম পাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে বিক্রি করে লাভবান হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না। কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থে এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার তাগিদ রয়েছে; কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
আমরা যদি চাহিদা বাড়াতে পারি তাহলে ধান-চালের বাজারে প্রভাব পড়তে পারে। এটা দু'ভাবে করা সম্ভব_ এক. সরকারের সংগ্রহ বাড়িয়ে ভালো মজুদ গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে মজুদ রাখার সীমিত সামর্থ্য। দুই. বিদেশে রফতানি। এভাবে উৎপাদক তথা কৃষকের জন্য কিছু লাভ এনে দেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ কৃষকের জন্য ধান হচ্ছে আয়ের প্রধান উৎস। মোট আবাদযোগ্য জমির চার ভাগের তিন ভাগে ধান চাষ হয়। ধানের দাম কম থাকলে কৃষকের জীবনযাপনে তার গুরুতর প্রভাব পড়ে। তারা শিল্পপণ্য কিনতে পারে কম। ২০০৭ সালের পর ২-৩টি মৌসুমে ধানের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা জামা, জুতা, ঘরবাড়ির নির্মাণসামগ্রী_ এসব কেনায় যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির চিত্র দেখেও তার প্রমাণ মেলে। কিন্তু প্রায় দেড় বছর ধরে ধানের দাম নিম্নমুখী থাকায় চালের ক্রেতারা স্বস্তিতে থাকলেও শিল্প খাতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে কৃষকের সামনে একটি বিকল্প রয়েছে_ ধানের জমির একটি অংশে আলু-ভুট্টা-সবজি ইত্যাদি ফসল চাষ। কিংবা ধান চাষ করলেও উচ্চফলনশীল জাতের চাষ কমিয়ে দেবে। কারণ, এতে সার-বীজ-সেচ ইত্যাদি খাতে ব্যয় বেশি পড়ে। উপকরণের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও সৃষ্টি হতে পারে। বারবার লোকসানের মুখে পড়ে কৃষক যদি এ ধরনের বিকল্প কিছু মাত্রায় হলেও বেছে নেয়, তাহলে মোট ধান উৎপাদন কমে যেতে পারে এবং তার প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘি্নত হতে পারে। ফলে দাম কমার কারণে বাজারে স্বস্তিদায়ক অবস্থা বিরাজ করছে সেটা আর থাকবে না। বাজার ফের চড়ে যাবে এবং তার প্রভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ বাড়বে। সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও টান পড়বে। দেশে ও বিদেশে দাম বেশি থাকলে সরকারকে বেশি দামে খাদ্য কিনতে হবে এবং এর অর্থ হচ্ছে বেশি পরিমাণে ভর্তুকি প্রদান। ফলে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনাতেও দেখা দেবে বাড়তি সমস্যা।
চাল রফতানির প্রশ্নে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণ আগেই বলেছি_ বিশ্ববাজারের সংকটই এ মনোভাব তৈরি করছে। ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে অস্থিরতার পাশাপাশি আরও সমস্যা ছিল_ সিডর ও বন্যার কারণেও উৎপাদন কম হওয়া। ফলে দেশের বাজারেও দাম বেড়ে যায়। গরিব ভোক্তাদের জন্য এ পরিস্থিতি ছিল বিশেষ কষ্টদায়ক। মানুষ কাপড় বা ঘর বানানোর টিন বা কাঠের জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু খাদ্য তো রোজই চাই এবং একাধিকবার চাই। এ পণ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়ে গেলে জনরোষ সৃষ্টি হয় এবং তার পরিণতিতে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যেতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। আকস্মিক ঝড়-বন্যা-খরায় ফসল উৎপাদন কম হলে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, সেটাই শঙ্কার কারণ। উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্যের যথার্থতাও প্রশ্নের ঊধর্ে্ব নয়। চাহিদা নিয়েও বক্তব্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর অভিন্ন হিসাব দিচ্ছে না। ফলে খাদ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত হতে পারছে না যে বাজারে কত উদ্বৃত্ত বা ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বা বিআইডিএস উৎপাদন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে একটি সমীক্ষা করে জানায় যে, সরকার যা বলছে প্রকৃত উৎপাদন সম্ভবত তার তুলনায় ২০ লাখ টনের মতো কম। বিশেষ করে আমন মৌসুমে উৎপাদন বেশি দেখানো হয়। তবে চাহিদার বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। দেশের জনগণের সার্বিক মাথাপিছু আয় বাড়ছে। তুলনামূলকভাবে চালের চাহিদা বাড়ছে না। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০০৫-০৬ সালের তুলনায় মাথাপিছু চালের চাহিদা বছরে দুই কেজি কমেছে। জাপানে ১৯৫০ সালে বছরে প্রতিজন ১৫০ কেজি চাল গ্রহণ করত। এখন তা কমে হয়েছে ৫৫ কেজি। দক্ষিণ কোরিয়াতেও মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের ওপর চাপ কমতে দেখা গেছে। বাংলাদেশেও চালের চাহিদা কিছুটা কমছে এবং তা পূরণ করছে সবজি, মাছ, ডিম, দুধ ও ফলের মতো খাদ্যদ্রব্য। শহর ও গ্রাম উভয় এলাকাতেই এ চিত্র কমবেশি অভিন্ন। পেশার পরিবর্তনও এর অন্যতম কারণ। কায়িক শ্রমে নিযুক্ত লোকের সংখ্যা কমছে। বাড়ছে মানসিক শ্রম। যান্ত্রিক চাষের আওতায় আসছে বেশি বেশি জমি। মাথাপিছু চালের চাহিদা কমার সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, উৎপাদন যেমন কিছুটা বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে, তেমনি চাহিদাও নিম্নমুখী। এ কারণে বাজারে জোগানে তেমন প্রভাব পড়ছে না।
এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে সরকারের উচিত হবে সীমিত পরিমাণে রফতানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বর্তমান অবস্থায় ৫ থেকে ১০ লাখ টন চাল রফতানি হলে দেশের বাজারে জোগানে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ দায়িত্ব সরকারের নয়, বরং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারবে। সরকারকে কেবল কঠোর মনিটরিং চালু রাখতে হবে, যাতে বিশ্ববাজারে চড়া দাম পাওয়ার কারণে প্রলুব্ধ হয়ে ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত পরিমাণের বেশি রফতানি করে না ফেলেন। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কৃষকের ক্ষতি করে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। যে কৃষককুল সরকারের জন্য চালের বাজারে স্বস্তি এনে দিয়েছে তাকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বর্তমান সরকার চাল রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়ে এ কৃতিত্বও নিতে পারে যে তাদের আমলে দেশ কেবল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়নি, রফতানিকারক দেশেও পরিণত হয়েছে।
ড. মাহবুব হোসেন :কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং প্রধান নির্বাহী, ব্র্যাক
No comments