শীতের নিমন্ত্রণ ও মানিক পীরের গান by সাইমন জাকারিয়া

শীতের পূর্ব ঋতু হেমন্ত। এই ঋতু এ দেশের উৎপাদনশীল কৃষক-শ্রমিকদের জন্য অবসরহীন এবং সবচেয়ে ব্যস্ততামুখর। হেমন্তজুড়ে চলে কৃষিপ্রধান এ দেশের প্রধান ফসল মাঠ থেকে বাড়ির উঠানে ও ঘরে তোলার আনন্দ। ধান কাটা থেকে মাড়াই—সবই শেষ হয় হেমন্তের সময়জুড়ে। সে ব্যস্ততার কিছুটা ভাব ও ভার হয়তো শীতের প্রথম ভাগেও থাকে। কিন্তু শীতের দ্বিতীয় ভাগ থেকে শুরু হয় কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের সামান্য অবসর।


কারণ, প্রধান ফসল ধান উৎপাদনের জন্য তেমন কোনো ভাবনা, পরিকল্পনা বা দৈহিক নিবেদন তৎপরতা এই ঋতুতে সাধারণত তেমন একটা থাকে না। তবে কোনো কোনো এলাকায় শীতজুড়ে শাকসবজি বা কাঁচা তরিতরকারি উৎপাদনে কৃষকের সকালটা কিছুটা ব্যস্ততামুখর থাকে। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে রাতজুড়ে অখণ্ড অবসর। তা ছাড়া শরীরটাও এই ঋতুতে একটু অবসর খুঁজে পায় বলে মনও থাকে ফুরফুরে। উপরন্তু শীতের মিষ্টি ও কনকনে আমেজ, মাঝেমধ্যে শিশির-কুয়াশা ছাড়া প্রকৃতির অন্য কোনো উন্মাদনা, ঝড়-ঝাপটা, বৃষ্টিপাত এ ঋতুতে তেমন একটা থাকে না। তাই শীত হয়ে ওঠে বাংলার মানুষের কাছে সংস্কৃতিচর্চার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। গ্রামের মানুষ শীতের নিমন্ত্রণে পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ির উঠানে উঠানে, এমনকি ধানকাটা মাঠের উদার জমিনজুড়ে আয়োজন করে গান, যাত্রা, নৃত্য, সার্কাস ইত্যাদি আনন্দময় সংস্কৃতির উৎসব।
শীতের রাত মানে বাংলাদেশের জনপ্রিয় নাট্যশিল্প যাত্রা আয়োজনের শ্রেষ্ঠ সময়। শুধু যাত্রা কেন, গাজীর গান, মাদার পীরের গান, আলকাপ, কীর্তন, কিচ্ছাগান, গীদালের আখড়া ইত্যাদি আয়োজন চলে বাংলাদেশে শীতজুড়ে। এই বিচিত্র ধরনের গীতি-নাট্য অনুষ্ঠানের কৃত্য ও বিনোদনমূলক ধারার বাইরে শীত ঋতুর পৌষসংক্রান্তিতে সারা দেশে নানা ধরনের কৃত্যমূলক উৎসব চলে। সে উৎসবের সঙ্গে বিচিত্র ধর্মগোষ্ঠীর যোগ থাকে। আমরা এখানে পৌষসংক্রান্তিতে কুষ্টিয়া অঞ্চলে পালিত মানিক পীরের গান পরিবেশনা এবং সে-সম্পর্কিত একটি কৃত্যানুষ্ঠানের কথা বলতে চাই।
২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার বহুলবাড়ি গ্রামে উদ্যাপিত পৌষসংক্রান্তির ‘মানিক পীরের গান’-এর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে, বিকেল পাঁচটার দিকে আমি বহুলবাড়ি পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে দেখি, গ্রামের একদল সাধারণ লোক খমক, জুড়ি, ঢোল, ঝাঁঝ ইত্যাদি বাজিয়ে একটি বাড়ির উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে মানিক পীরের গান পরিবেশন করছে, আর তিন-চারজন ছুকরি (নারীর সাজে সজ্জিত পুরুষ) ঘুরে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করছে। তারা মানিক পীরের গানের একটি অংশের গীতি-নৃত্য শেষ করতেই ওই বাড়ির গৃহ-নারীরা মানিক পীরের প্রধান গায়ক ও মানিক ফকিরফেরত মণ্ডলকে ভক্তিসহ কিছু চাল-ডাল দেন। এবার মানিক ফকিরের গানের দল অন্য বাড়ির দিকে রওনা দেয় এবং ওই বাড়ির উঠানে গিয়ে তারা আবার আগের বাড়ির মতো নৃত্য ও গীত শুরু করে। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন বাড়ির উঠানে গিয়ে তাদের গীতি-নৃত্য দেখি। জানতে পারি, গীতি-নৃত্যসহযোগে পৌষসংক্রান্তির দিনে মানিক ফকিরের দল মানিক পীরের স্মরণে শিরনি করার জন্য চাল-ডাল সংগ্রহের নিমিত্তে গীতি-নৃত্য সহযোগে ভিক্ষা গ্রহণ করে থাকে এবং সন্ধ্যার পর মানিক পীরের আস্তানায় ভিক্ষা করা চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে তা ভক্তি সহযোগে কিছু কৃত্য পালন করে গ্রামের মানুষের মধ্যে বিতরণ করে দেয়।
এ পর্যায়ে পৌষসংক্রান্তির আয়োজন থেকে সংগৃহীত মানিক পীরের গানের কিছু অংশ আগ্রহী পাঠকের জন্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে।

জাহিরি বা ভিক্ষা করা পালা
কানু বলে একটি লোক ছিল। তার ১২ লাখ গাভি ছিল। ১৩ লাখ গাই, কোলের যে বাছুর ছিল লেখাজোখা নেই। তাই সে কানু ঘোষের মাকে বুঝ করার জন্য চলে গেল সেই কানু ঘোষের বাড়ি। গিয়ে কী করল?
: কী করল?
: কী করল তাহলে এবার শোনো—
সোনার মানিকও রে মানিক ভালো পের/পেতমে গুহালার ঘরে করেছ জাহের\/আল্লাহ আল্লাহ বলো ভাই রে যত মোমিনগণ/মানিক পীরের জাহের কিছু শোনো দিয়া মন\/তবে, দম দম মাদার বলে ছাড়িল জেকের/কানু ঘোষের মা গো বলে কে আয়লো ফকির\/তবে, কালা রে যতনা হলো কাজ হলো মোর দড়ি/ছড়া ঝাঁটো না পড়িতে ফকির আয়লো বাড়ি\/তবে, কানু ঘোষের মা গো বলে বাইরে আছ কে/কুলোত করে চালও-ডালও ফকির বেটার দে\/তবে, ভিক্ষা মাঙার ফকির নয় ভিক্ষা মেঙে খায়/সোয়া সেরও দুগ্ধ পেলে দুয়া করে যায়\/তবে, দুগ্ধ খাওয়ার মুখ যে তোমার দুগ্ধ খেতে চাও/ওই দুগ্ধটুকু থাকলে আবার নুনের দামও হয়\/তবে, ভিক্ষা মাঙার ফকির নয় মা ভিক্ষা মেঙে খায়/সোয়া সেরও দুগ্ধ পেলে দুয়া করে যায়\/তবে, সুবুদ্ধি গোয়ালানারীর কুবুদ্ধি ঘটাল/সিকের ওপর দুগ্ধ রেখে ফকিরকে ঘোরাইল\/তবে, দুগ্ধ খাওয়ার মুখ রে তোমার দুগ্ধ খেতে চাও/পালে আছে বাঁজা ধেনু দুয়ে বান্ধে খাও\/তবে, ঘরে ছিল ভাঙা ঝাঁঝর পীরকে এনে দিল/ভাঙা ঝাঁঝর নিয়ে পীর গো গোয়াতে গেল\/তবে, দম দম মাদার গো বলে ছাড়িল হুঙ্কার আল্লাহজির হুঙ্কারে গাভির দুয়ারেতে যায়\/তবে, একও টানো দুইও টানো তিনও টানো দিল/পঞ্চ টানো দিয়ে পীর গো ও গাভি দুয়ে গেল\/তবে, চলো রে সোনার গো খেড়ো আরেক বাড়ি যায়/যা দিয়েছেন খোদা-তায়ালায় থাকুক বরযায়\
সুবুদ্ধি গোয়ালানারীর কুবুদ্ধি ঘটিয়েছিল। সিকের ওপর দুগ্ধ রেখে আমাদের কাছে মিথ্যা কথা বলে আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তারপর যদিও তিনি রাজি হলেন—ঘর থেকে এনে দিলেন ভাঙা ঝাঁঝর। আর বন্ধ্যাধেনু, যে ধেনু জীবনে বাচ্চা দেয়নি, দুধও হয়নি, সেই ধেনু আমাদের দিয়েছে। দুগ্ধ দুয়ে খাবার জন্য।
আমরা দুগ্ধ দুয়েছি। খেয়েছি। এইবার আমরা কী করতে পারি?
ও তো বকিল। ওই বকিলের ধেনু-ধন যা আছে সব আমরা মেরে শেষ করে দেব। দেব?
: দাও।
: ও কান্দে গোয়ালা ওরে এই ছিল মোর কপালে/ওরে রাখাল আবাদে ধেনু পড়ে রইল বাথানে/মানিক রে\/তবে, আল্লাহ আল্লাহ বলো ভাই রে যত মোমিনগণ/মানিক পীরের জাহের কিছু শোনো দিয়া মন\/তবে, বারো লক্ষ গাভি মরল তেরো লক্ষ গাই/কোলেরও যে বাছুর মরল লেখাজোখা নাই\/তবে, কান্দে রে গোয়ালানারী, হাতে লইয়ে লোটা/গাভিরও বদলে কেন রে না মরিল বেটা\/তবে, কান্দে রে গোয়ালানারী হাতে লয়ে লড়ি/বাথান হতে ফিরে এল সাত মণ দড়ি\/তবে, কান্দে রে গোয়ালানারী হাতে লয়ে লোটা/গাভিরও বদলে কেন রে না মরিল বেটা\/তবে, কান্দে রে গোয়ালানারী হাতে লয়ে ভাঁড়/গাভিরও বদলে কেন রে না মরিল রাড়\/তবে, কান্দে রে গোয়ালানারী হাতে লয়ে ঝি/গাভিরও বদলে কেন রে না মরিল ঝি\/তবে, বংশের বাড়ুক মান গরু খেত বাড়ুক ধান/যে বাড়িরও গিন্নি কল্লা হবে সর্বনাশ\/তবে, চলো রে বায়েন গো দোহার আরেক বাড়ি যাই/যা দিয়েছেন খোদা-তাল্লায় থাকুক বরজায়\/ওগো, যখন মানিক পীর আর সোনা পীর দুই ভাই রাগান্বিত হয়ে গোয়ালার গরুর পাল মেরে সাফ করে দিল।
: তারপর কী হলো?
: গরু মেরে সেরে তখন ওরা বলল—চলো এবার আমরা অন্য দেশে চলে যাই। তাই তখন সোনা পীর বলছে—মানিক পীর ভাই, আমরা তো যাব তাহলে এই গোয়ালার কী অবস্থা হবে? ওরা পাগল হতে পারে তাই বলে আমরা তো পাগল নই। বকিলের ধন মেরেছি আবার জিলায়ে দিয়ে যাব।
তাই কী বলছে?

জিলানে বা জিয়ন পালা
মানিক চার যুগেরও সার/মারিলে জিলাইতে পারো মহিমা তোমার\/আরে, আল্লাহ আল্লাহ বলো ভাই রে যতেক মোমিনগণ/মানিক পীরের জাহের কিছু শোনো দিয়া মন\/আরে, মানিক পীর উঠিয়া বলে মানিক পীর রে ভাই/মেরেছ যতেক ধেনু জিলাইয়া যাও\/আরে, মানিক পীর উঠিয়া বলে সোনার পীর রে ভাই/এই দেশেরও কার্য করে অন্য দেশে যাই\/আরে, হূদয়নগর যায়ে পীর গো করিল গমন/সগুনের/সুবলেরও আগে যায়ে দিল দর্শন\/তবে, সগুনেতে আয়ে হায় গো করিল ঠাঁই ঠাঁই/হাড় গুঁড়াইতে লাগল দেখ উঠাই হইল ভাই\/তবে, চলো গো বায়েন গো দোহার আরেক বাড়ি যাই\/আরে, হাত উঠায়ে পা গুটায়ে মারে আশার বাড়ি/সাত দিনকার মরা ধেনু করে গড়াগড়ি\/তবে, সাত দিনকার মরা ধেনু উঠে খাইল ঘাস/বারজান করে বাছুর মায়ের লাগল বাঁট\/তবে, আগে যদি জানতাম মানিক তুমি এমন পীর/আগে দিতাম দুগ্ধ কলা পাছে দিতাম ক্ষীর\/তবে, এই মুষ্টিচাল গো মানিক পৃথিবীতে ছিটাইল/ঝাঁও ঝাঁড়কি তরলা বাঁশি সৃষ্টি হইয়া গেল\/তবে, আগে যদি জানতাম মানিক তুমি এমন পীর/আগে দিতাম দুগ্ধ কলা পাছে দিতাম ক্ষীর\/তবে, চলো রে বায়েন গো দোহার আরেক বাড়ি যাই/যা দিয়েছেন খোদা-তাল্লায় থাকুক বরজায়\
আগেই বলা হয়েছে, এসব গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে ভিক্ষায় অর্জিত চাল-ডাল নিয়ে যে শিরনি বা প্রসাদ রান্না করা হয়, তার প্রথম ভোক্তা হয় নৃত্যকারী ছুকরিরা। ভিক্ষা শেষ হলে তাদের একটি পাটির ওপর সার বেঁধে বসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর মানিক ফকির তাদের (ছুকরিদের) মুখে কানু ঘোষের মা ও কানু ঘোষের স্ত্রী ভেবে ভিক্ষায় অর্জিত দুধ, কলা ও চাল-ডালে তৈরি প্রসাদ খিচুড়ি মুখে তুলে দেন। এরপর বাকি প্রসাদ গ্রামের মানুষের মধ্যে বিতরণ করে দেন।
এই কৃত্য ও গীতি-নৃত্যের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের ইশারা লুকিয়ে আছে। কেননা, মুসলমান পীরকে অপমান করায় তাঁর অভিশাপে হিন্দু কানু ঘোষ ও সুবল ঘোষের গৃহপালিত সব গরুর মৃত্যু ঘটেছিল। আবার সেই হিন্দু কানু ঘোষ ও সুবল ঘোষ ও তাদের পরিবার কর্তৃক মানিক পীর পূজিত হওয়ার পর মৃত গরুর পুনর্জীবন লাভ ঘটেছিল। বর্তমান পৌষসংক্রান্তির কৃত্যাচারে দেখা যায়, মানিক ফকির তাঁর ভিক্ষালব্ধ প্রসাদ কানু ও সুবল ঘোষের মা ও স্ত্রীদের মুখে তুলে দিচ্ছেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে এ কৃত্যাচার তাই নতুন ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

No comments

Powered by Blogger.