এই দিনে-আসাদকে কি মনে পড়ে?

মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি চূড়োয়
গমগমে এভ্যেন্যুর আনাচে কানাচে


উড়ছে, উড়ছে অবিরাম,
আমাদের হূদয়ের রৌদ্র ঝলসিত
প্রতিধ্বনিময় মাঠে।
চৈত্যন্যেও প্রতিটি মোচায়।...
আসাদের শার্ট আজ আমাদের
প্রাণের পতাকা।’
শামসুর রাহমানের ‘আসাদের শার্ট’ কবিতার এ লাইনগুলো আমরা হয়তো অনেকেই জানি। কিন্তু যাঁকে নিয়ে এই কবিতা, সেই আসাদকে কয়জন চেনে? এ প্রজন্মের কাছে আসাদ কে—এমন প্রশ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর কাছে।
কে এই আসাদ? কেনই বা তাঁর জন্য আজ ২০ জানুয়ারি এই গোটা একটা দিন উৎসর্গ করা হয়েছে। আর এ প্রশ্ন দিয়েই আমরা শুরু করছি।
সন্ধ্যার পর টিএসসিপাড়ের দেয়ালে ভিড় জমায় এক ঝাঁক তরুণ প্রাণ। গলা ছেড়ে গান আর ফাঁকে ফাঁকে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের চুমুকে আরও চাঙা হয় ওরা। আসরের কেন্দ্রে বসে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাহাদ বলেন, ‘আসাদ শহীদ হয়েছেন।’ এর পরই চুপ, আর কোনো উত্তর নেই। কীভাবে কোথায় বা কোন আন্দোলনে শহীদ হলেন আসাদ, তা জানা গেল না ফাহাদের কাছ থেকে। পাশে বসে থাকা বন্ধু সোনিয়া বলতে পারলেন না, কে এই আসাদ?
এ প্রজন্মের কাছে আসাদের পরিচয় ধোঁয়াশে। অথচ এই আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, আর তাঁর সাহসী উদ্দীপনা বাংলাদেশের ইতিহাসকে ভিন্ন দিকে চালিত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী সরকার সোহেল রানা বলেন সামগ্রিকভাবে, ‘আসাদ হলো এক সামষ্টিক চেতনার নাম। যে ব্যক্তি স্বার্থের কথা না ভেবে ভেবেছে দেশের স্বাধীনতার কথা। আর এ স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করতে পর্যন্ত দ্বিধা করে নাই। আসাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবন তুচ্ছ। যেমন: দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন।’
কীভাবে এই আসাদ দিবস কিংবা আসাদের শহীদ হওয়ার সঙ্গে বাংলার ইতিহাস কতটা সম্পৃক্ত, তা নিয়ে বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ‘আসাদের শহীদ হওয়া এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এক সূত্রে গাঁথা। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবির পর জনগণ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। যেখানে সর্বজনীন ভোটাধিকারের কথা বলা হয়। আসাদ কেবল ছাত্রনেতাই নয়, বরং কৃষকনেতা। সাধারণ মানুষকে নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার করেছে। অধিকার আদায়ে যেকোনো গণমুখী আন্দোলনে সে ছিল সক্রিয়। তৎকালীন সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ১১ দফা দাবি আদায়ে মিছিলে নেতৃত্ব দেয় আসাদ। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি মিছিলের সামনেই ছিল সে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে আসতেই গুলি করা হয় আসাদকে। আর আসাদ শহীদ হওয়ায় সারা বাংলা জেগে ওঠে। সবার কণ্ঠে তখন “তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা” কিংবা “জাগো বাঙালি জাগো”। আসাদের মৃত্যুই আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে বাঁক দেয়। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান হয়।’ তিনি আরও বলেন, আসাদ মনে করত, আন্দোলন হলো জনগণতন্ত্রের।
আসাদের মৃত্যু যেন স্ফুলিঙ্গের মতো সারা দেশে আন্দোলনের জোয়ারে ভাসে।
আসাদের পুরো নাম আসাদুজ্জামান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তবে আসাদ সম্পর্কে অনেকেই বলেন, তিনি ছিলেন ধ্রুপদি রাজনৈতিক কর্মী। এই একটি উপাধির জোরালো দাবিদার বলা যায় আসাদকে।
আসাদের মৃত্যুর পর তৎকালীন আইয়ুব সরকার চাপের মুখে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। ঢাকার আইয়ুব গেটের নামকরণ করা হয় আসাদ গেট।
ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান আমাদের অনুভূতির সঙ্গে মিশে আছে। গণ-অভ্যুত্থান ছিল নিজেদের অস্থিত্ব রক্ষার এক আন্দোলন। আর এই আন্দোলনটা শুরু করেছিল শহীদ আসাদ। আসাদ বাঙালির শোণিত ধারায় কী যেন এক দোলা দিয়ে গেল। তৎকালীন মধ্যবিত্ত বাঙালিরা সচেতন হয়। আর এর মূলে ছিল নিজেদের সংস্কৃতিচর্চার একটা আগ্রহ। একবাক্যে বাঙালি বহুদিন ধরে যে নিষ্পেষণের মধ্যে ছিল, আসাদের শহীদ হওয়ার মাধ্যমেই সেই অন্ধকার বলয়ের বাইরে আসার সুযোগ ঘটে। এরপর ঊনসত্তরের আন্দোলন আর সর্বশেষ ধাপে এসে একাত্তরে স্বাধীনতার স্বাদ পায় বাঙালি। মূলত একাত্তরের স্বাধীনতার সূত্রপাত হয় ১৯৬৯ সালে।’ এ প্রজন্মকে ধারাবাহিক সঠিক ইতিহাসটা জেনে নেওয়ার দিকে জোর দিলেন এই ইতিহাসবিদ। কীভাবে আমরা এত দূর পৌঁছলাম, আর কীভাবেই বা আমাদের স্বাধীনতা এল, তা জানা থাকা চাই। তাই আসাদের রক্তমাখা শার্ট কেবল কবিতার পঙিক্ত হয়েই নয়, বরং সেই শার্ট যেন আমরা পতাকার মতো হূদয়ে ধারণ করতে পারি, তেমনই প্রত্যাশা আমাদের।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.