সহজ-সরল-বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার by কনকচাঁপা

এই পৃথিবীতে যত রকম গান আছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রশান্তিময় গান দেশের গান। আর যত দেশের যত দেশাত্মবোধক গান আছে সবচেয়ে প্রিয় আমার দেশকে নিয়ে গানগুলো। যত সুন্দর আমাদের দেশ, ঠিক ততই সুন্দর আমাদের এই গানগুলো। শুধু সুন্দরই নয়, তা প্রাসঙ্গিকও বটে। ভাষা আন্দোলনের সময় দেশের সঙ্গে ভাষার প্রতি অপ্রতিরোধ্য শ্রদ্ধা নিয়ে তৈরি হয়েছে শ্রেষ্ঠতম গান আলতাফ মাহমুদের 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'।


তার যৌক্তিকতা ও বাক্যমূল্য নিয়েই যে ভিত্তি তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই একটা আবেগ কেন্দ্রীভূত হয়ে পুকুরে ঢিল ছোড়া তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে_তার বিনিময়েই পাওয়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ যেন ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। তাই তো তলাহীন ঝুড়ি থেকে মাতৃভাষা দিবসের দেশ শাহনাজ রহ্মতুল্লাহর 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে' আরেকটি মাইলফলক। এই মাইল পোস্টে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে ক্লান্ত সৈনিকরা কিছু পাওয়ার আশা ছেড়ে আবার দেশকে সাজানোর কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সারা বাংলার মানুষ যখন যুদ্ধ-পরবর্তী সময় নিঃস্ব হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জীবনের রসদ খুঁজছিল, সঙ্গে খুঁজছিল বীর যোদ্ধাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা, তখন সেই ভাষা সুর হয়ে ইথারের মাঝে শরীরের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে_আমরা তোমাদের ভুলব না।' আবদুল আলীমের 'আমার দেশের মতো এমন দেশ কি কোথাও আছে' এটা শুনলে মনে হয় সত্যিই তো! এত অল্পে সন্তুষ্ট হওয়া, এত সহজে হাসতে পারা, এত সহজে ফসল হওয়া, হিটার-এসি ও ইলেকট্রিসিটি ছাড়াই বেঁচে থাকা, এত কম পয়সায় জীবন বাঁচিয়ে রাখার দেশ এই একটিই বাংলাদেশ। অদ্ভুত তরল জমিন ও পলিমাটির ব-দ্বীপ এই বাংলাদেশ। আর রবিঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' এটা তো জপের মালার অনুষঙ্গ। আমার ধারণা, এই গানটিকে বিশ্ববাসী গাইবে শুধু 'বাংলার' স্থলে তাদের দেশের নাম বসিয়ে। যেমন_ আমার সোনার আমেরিকা ঙয সু মড়ষফবহ অসবৎরপধ, বি ৎবধষু ষড়াব ুড়ঁ_এমন। এটা হয়ে যাবে বিশ্ব দেশাত্মবোধক গান রুনা লায়লার 'স্বাধীনতা এক গোলাপ ফোটানো দিন'। গানটি শুনলে ভাবি ফুল ফুটে উঠতে ফুলের কোনো কষ্ট হয় কি না জানি না_কিন্তু ফুল হয়ে ওঠার পর যে প্রশান্তি, ঠিক সেই রকম শান্তি একটি বাসস্থানকে শিকলমুক্ত করার মাঝে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের সম্মানই আলাদা। এর জন্যই তো এত কঠিন যুদ্ধ_এত রক্তদান। আর স্থানকাল ভেদাভেদ ভুলে একটি দেশের গানে যখন সুফিয়া কামাল-শেখ মুজিব-শহীদ জিয়া-রবিঠাকুর-কাজী নজরুল সবার স্বপ্ন একাকার হয়ে যায় তখন প্রতিটি লোমকূপ_প্রতিটি ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে। আমাদের জেমসের এই গানটির জন্যই বুঝিবা বাংলাদেশ ও আমি এত দিন অপেক্ষা করছিলাম। সাবিনা ইয়াসমীনের 'সব কটা জানালা খুলে দাও না' শুনে সত্যিই জানালা খুলে দিই! ওরা যদি আসে! তবে দেখবে কত ভালোবাসা, কত অশ্রু, কত আবেগ নিয়ে দুই হাতে অঞ্জলি দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে আছি আমি ও ১৪ কোটি জনতা। তাঁর আরো একটি গান 'জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো' শুনলে বুঝি দেশ ও মা সত্যিই সমার্থক শব্দ। মা নামক স্বর্ণদুয়ার দিয়ে এসে এই স্বর্ণালি মায়াবী ভূমিতে পা দিয়েছি। বড় হয়েছি। মাতৃস্তন ও মোটা ভাত খেয়ে এই মাটিতেই বেড়ে উঠেছি। তাঁরা দুজনই দরিদ্র; কিন্তু মনটা তাঁদের বিশালতায় ভরা_তাঁদের কোনো মনোবৈকল্য নেই। যা আছে তা আমাদের_এই ১৪ কোটি সন্তানের। মায়ের দেওয়া শিক্ষা, পলিমাটির নমনীয়তা, ফসলের প্রাচুর্যতা, বাতাসের কোমলতা_কোনো কিছুই আমাদের আর স্পর্শ করতে পারছে না। আমরা কি ভুল পথে যাচ্ছি? কত দেশই তো মৃত্যুদুয়ার থেকে সত্যিকার শিক্ষার প্রাণস্পর্শে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বে উচ্চ স্বরে গলা ছাড়ছে। আমরা? পারব না? এত অপার সম্ভাবনা দুপায়ে মাড়িয়ে নরকের সামনে দাঁড়াব? চলুন_থমকে দাঁড়াই। আমাদের দেশের স্বপ্নবাজ বিশাল মানুষগুলো কবি-সাহিত্যিকরা, মুক্তিযোদ্ধা-ভাষাসৈনিকরা কী কী চেয়েছিলেন তার লিস্টগুলো একবার, একবার কিন্তু গভীর দৃষ্টিতে দেখে নিই। সেই মতো সারা দিন কিছু কিছু কাজ করি_যার যার ভুলগুলো চুপি চুপি শুধরে নিই। তখনই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি পাবেন। যে শিল্পী, লেখক, সুরকার অনেক আশা নিয়ে সত্যিকারের ভালোবাসা দিয়ে এই অমর শিল্পসৃষ্টি করেছেন তাঁরা স্বস্তি পাবেন। আসুন, আমরা যার যার ক্ষেত্রে সঠিক পথে চলি। আর গুনগুনিয়ে গাই_সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.