কালান্তরের কড়চা-চাণক্যপুরীর কূটকৌশল এবং বাংলাদেশের বিদেশনীতি-২ by আবদু্ল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের ইন্দিরা সরকার অকুণ্ঠভাবে সাহায্য জুগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকার মতো সুপারপাওয়ারের রোষ গ্রাহ্য করেননি। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে তিনি ভারতে আশ্রয় দিয়েছেন, ভরণপোষণ করেছেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য তিনি উল্কাবেগে সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত সমর্থন নিশ্চিত করেছেন। ভারতের ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার সেনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। এরপর স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সঙ্গে তো গণতান্ত্রিক ভারতের সখ্য ও সহযোগিতা নিশ্চিত ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কথা ছিল। তা হতে পারল না কেন?
এ প্রশ্নের জবাব বাংলাদেশ ও ভারতের (অন্তত কলকাতার) নিরপেক্ষ ও মুক্তমনা এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর অনেক দিন আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দিলি্ল বিব্রত হবে, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য শত্রুপক্ষ রসদ পাবে_এ কথা ভেবে তাঁরা কিছু লিখতে বা বলতে চাননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু পরেই সিমলায় ইন্দিরা-ভুট্টো বৈঠক হয় এবং বাংলাদেশে আটক পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেওয়াসহ বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ও সেই বৈঠকে সম্পাদিত চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হয় (যে চুক্তি সিমলা চুক্তি নামে পরিচিত)।
আমি তখন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, সিমলা বৈঠক ত্রিপক্ষীয় না হয়ে দ্বিপক্ষীয় কেন হলো তা নিয়ে আমি একটি কলাম লিখতে চাই। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন অস্তিত্বের অধিকারী। তার পক্ষ হয়ে দিলি্লর কথা বলার আর দরকার নেই। ভারতের যেমন পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে, তেমনি পাকিস্তানের সঙ্গে নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশেরও অনেক সমস্যা ও বিরোধ আছে। সুতরাং উপমহাদেশের সার্বিক শান্তি ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা বৈঠকে বাংলাদেশেরও উপস্থিতি প্রয়োজন। সেই উপস্থিতির ব্যবস্থা না করে দিলি্ল কি করে নিজেদের সমস্যা এবং বাংলাদেশের সমস্যা নিয়েও একতরফা আলোচনা ও চুক্তি সম্পাদনে যায়?
বঙ্গবন্ধুকে আমি আরো বলেছিলাম, সিমলা বৈঠকে দেখা গেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বড় বড় সমস্যা রয়ে গেছে, যেমন তাদের কাছে আমাদের পাওনা বিপুল অর্থ, জাতীয় সম্পদের হিস্যা ফেরত পাওয়া, কয়েক লাখ আটকে পড়া উর্দুভাষী পাকিস্তানিকে ফেরত নেওয়া, বাংলাদেশে ৯ মাসব্যাপী হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ক্ষতিপূরণ দেওয়া ইত্যাদি কোনো বিষয় এ আলোচনায় গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে কাশ্মীরে স্থিতাবস্থা মেনে নেওয়ার জন্য (কাশ্মীরের অর্ধেকের বেশি ভারতের, বাকি অংশ পাকিস্তানের) পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি। ভুট্টো অত্যন্ত ধূর্ত লোক। তিনি বাংলাদেশে আটক ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে তাঁর আর্মিকে খুশি করার জন্য আপাতত কাশ্মীরে স্থিতাবস্থা মেনে নিয়ে চুক্তি করেছেন। দিলি্লও খুশি মনে ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানকে উপহার দিয়েছে। আর যুদ্ধবন্দিরাও এ সময় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামেই আটক। আগেই তাদের কৌশল করে ঢাকা থেকে কলকাতায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সুতরাং পাকিস্তানের কাছে তাদের ফেরত দেওয়ার সময় বাংলাদেশের আপত্তি বিবেচনা করার দরকার হয়নি। আমি কি এই বিষয়গুলো আমার লেখায় তুলে ধরতে পারি?
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'না, এই মুহূর্তে লিখ না। আমি ইন্দিরা গান্ধীকে বিব্রত করতে চাই না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল এবং আমাদের তিনি প্রকৃতই বন্ধু।' কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দিলি্লর অবাঙালি আমলাতন্ত্র আবার তাঁর ঘাড়ে চেপে বসেছে। সিমলা বৈঠকে বাংলাদেশের উপস্থিতির ব্যাপারে আপত্তিটা পাকিস্তানের। ইসলামাবাদের অবাঙালি আমলাদের এই আপত্তি। দিলি্লর আমলারা সেই আপত্তি মেনে নিয়েছেন এবং ইন্দিরা গান্ধীকে বুঝিয়েছেন, পাকিস্তান এখন পরাজিত পক্ষ। তার কাছ থেকে কাশ্মীরের ব্যাপারে ভারতের অনুকূল একটা চুক্তিতে সই আদায় করা সম্ভব হবে, দেরিতে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আর সিমলা বৈঠকে বাংলাদেশের উপস্থিতির ব্যাপারে পাকিস্তানের আপত্তির প্রধান কারণ তারা দেখাচ্ছে যে স্বাধীন বাংলাদেশকে তারা এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। স্বীকৃতি দেওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে তারা কোনো বৈঠকে বসতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আমি তাতেও অসম্মতি জানাতাম। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশটির প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসতে না চাইলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সিমলা বৈঠকে না তোলার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানাতাম। তিনি তাতে রাজি হতেন বলে আমার ধারণা। কিন্তু আমি এ অনুরোধ জানাইনি পাকিস্তানে আটক হাজার হাজার বাঙালি সিভিলিয়ান ও আর্মির লোকজনের কথা ভেবে। তারা সেখানে বন্দি অবস্থায় নির্যাতিত হচ্ছিল। অনেকে পাকিস্তান থেকে দুর্গম পথে অন্য দেশে পালাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আমি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেওয়া মেনে নিয়ে আটক বাঙালিদের দ্রুত ফেরত আনতে চেয়েছি। যুদ্ধবন্দি ফেরত দেওয়া বা যুদ্ধবন্দি বিনিময় সব যুদ্ধের পরই হয়। কোরিয়া যুদ্ধের পর জানমুলজন বৈঠক শেষে যুদ্ধবন্দি বিনিময় হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর তাসখন্দ বৈঠক শেষে যুদ্ধবন্দি বিনিময় হয়েছে। আমার কাছে মুখ্য যুদ্ধবন্দির বিচার নয়, মুখ্য যুদ্ধবিরোধীদের বিচার। তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশে আছে। বাকিদেরও দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করা হবেই।'
সিমলা চুক্তি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর বাধ্যবাধকতা আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি আরো বলেছিলেন, 'ভুট্টো যতই গড়িমসি করুন, বাংলাদেশকে শিগগিরই তাঁর স্বীকৃতি দিতে হবে। পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে আমি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতেও বাংলাদেশের প্রতি অনুকূল মনোভাব সৃষ্টি করতে পেরেছি। পাকিস্তানের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো প্রভাবশালী দেশ_বিশেষ করে মিসর ও ইরাক ইতিমধ্যেই চাপ সৃষ্টি করেছে যাতে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং আগামী ইসলামী রাষ্ট্রের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হয়। আমার স্থির বিশ্বাস, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যেসব অমীমাংসিত সমস্যা রয়ে গেছে, অদূর-ভবিষ্যতে তা নিয়ে আমরা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে আলোচনা বৈঠকে বসতে পারব। তাতে ভারতের উপস্থিতি দরকার হবে না।'
বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তাঁর কেবিনেটের আপত্তি অগ্রাহ্য করে লাহোর ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ছুটে গিয়েছিলেন। ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং তাঁকে সদলবলে ঢাকায় এনেছিলেন। ভারতের মতো পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক ও সদ্ভাব রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত আন্তরিক ও আগ্রহী ছিলেন। তাঁর সেই লক্ষ্য যে অর্জিত হয়নি সে জন্য মূলত দায়ী দিলি্লর চাণক্যপুরীর কূটনৈতিক খেলা এবং ভুট্টোর দুরভিসন্ধি ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা। ভুট্টো সময় ও সুযোগ পেয়েই ইন্দিরার সঙ্গে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি ভঙ্গ করেন, হিটলার যেমন করেছিলেন ব্রিটেনের চেম্বারলেনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত মিউনিখ চুক্তি। এমনকি ঢাকা সফর শেষে পাকিস্তানে ফিরে গিয়েই তিনি মুজিব হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আরো বাড়িয়ে তোলেন।
প্রশ্নটি তাই এখনো ওঠে, বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে দিলি্ল অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার পর যেখানে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর কথা ছিল, তা না হয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় কেন বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা, তাঁর সরকারের উচ্ছেদ এবং বাংলাদেশকে আবার ভারতবিরোধী অবস্থানে দাঁড় করানো সম্ভব হলো? বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানোর পর তিন-চার বছর না যেতেই সেই পাকিস্তানের সমর্থক গোষ্ঠী কিভাবে দেশটিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে? পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কিভাবে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে প্রভাব বিস্তার করে? নিষিদ্ধ ঘোষিত সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে কিভাবে তারা পুনর্গঠিত করে? এবং বাংলাদেশের তিন দিকের স্থলভাগ ভারতের দ্বারা বেষ্টিত থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সেই আইএসআই কিভাবে ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটিয়ে এক থাবায় দেশটিকে পুনর্দখল করে তাদের তাঁবেদার রেজিম আবার ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারে?
তা কি সম্ভব হয়েছিল কেবল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির দুর্বলতা ও ভ্রান্তির জন্য? না, তার পেছনে বড় এবং গণতান্ত্রিক প্রতিবেশী ভারতের আধিপত্যবাদী আমলাতন্ত্রের দুর্বলতা, কূটনৈতিক শঠতা এবং পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক জান্তাগুলোর ষড়যন্ত্রের কাছে তাদের পরাজয়ও অন্যতম কারণ ছিল? এ প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব এখন প্রকাশ্য আলোচনার মাধ্যমেই খুঁজে নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং বাংলাদেশ-ভারত স্থায়ী মৈত্রী প্রতিষ্ঠার পথে দিলি্লর আমলাতান্ত্রিক অহমিকা, দম্ভ ও শঠতা যে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করে রেখেছে, তা ব্যর্থ করা যাবে না এবং উপমহাদেশেও শান্তি-সহযোগিতার সুবাতাস নিশ্চিত করা যাবে না।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক ও চুক্তি থেকেও এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে মৈত্রীতে বিশ্বাসী এবং গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের বন্ধুত্ব পাকা করার ব্যাপারে দিলি্লর গড়িমসি রয়েছে এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে এক কাতারে রেখে দুই দেশ সম্পর্কে তারা প্রায় অভিন্ন মনোভাব দেখায়। পাকিস্তানের প্রতি তাদের মনোভাব তবু কিছুটা তোয়াজপূর্ণ, বলা চলে এপিজমেন্ট পলিসি। বাংলাদেশের প্রতি এই নীতি অনেকটাই অবজ্ঞাপূর্ণ।
এই অবজ্ঞাপূর্ণ নীতির প্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যাতায়াতব্যবস্থায়। ভারতে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই পাকিস্তান থেকে গেছে অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত_এ কথা প্রমাণিত হওয়ার পরও পাকিস্তান থেকে ভারতে যাতায়াতে যে কড়াকড়ি ব্যবস্থা, সেই একই কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাতায়াতে। ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করতে গেলে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ও পরিচিত ব্যক্তিদেরও যে অবজ্ঞা ও হয়রানি সহ্য করতে হয়, সেই অবজ্ঞা ও হয়রানি বিশ্বের আর কোনো মিত্র দুটি দেশের একটিকে সহ্য করতে হয় না। ইউরোপে তো এত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও ভিসা প্রথা উঠেই গেছে।
'মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট'_এটাই মনে হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে বর্তমান ভারতের নীতি। একদিকে চলছে, বাংলাদেশকে অকৃত্রিম বন্ধু দেশ আখ্যা দিয়ে নানা ধরনের স্তুতিবাক্য উচ্চারণ এবং অন্যদিকে চলছে, সেই স্তুতিবাক্যের বিপরীত আচরণ এবং দাদাগিরির খেলা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই খেলার যে সূচনা, তা এখন কূটনীতির বড় খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সম্পর্কে দু-একটা উদাহরণ দিতে চাই পরবর্তী আলোচনাটাকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য।
(অসমাপ্ত)
লন্ডন, ১৯ সেপ্টেম্বর, সোমবার, ২০১১
এ প্রশ্নের জবাব বাংলাদেশ ও ভারতের (অন্তত কলকাতার) নিরপেক্ষ ও মুক্তমনা এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর অনেক দিন আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দিলি্ল বিব্রত হবে, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য শত্রুপক্ষ রসদ পাবে_এ কথা ভেবে তাঁরা কিছু লিখতে বা বলতে চাননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু পরেই সিমলায় ইন্দিরা-ভুট্টো বৈঠক হয় এবং বাংলাদেশে আটক পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেওয়াসহ বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ও সেই বৈঠকে সম্পাদিত চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হয় (যে চুক্তি সিমলা চুক্তি নামে পরিচিত)।
আমি তখন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, সিমলা বৈঠক ত্রিপক্ষীয় না হয়ে দ্বিপক্ষীয় কেন হলো তা নিয়ে আমি একটি কলাম লিখতে চাই। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন অস্তিত্বের অধিকারী। তার পক্ষ হয়ে দিলি্লর কথা বলার আর দরকার নেই। ভারতের যেমন পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে, তেমনি পাকিস্তানের সঙ্গে নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশেরও অনেক সমস্যা ও বিরোধ আছে। সুতরাং উপমহাদেশের সার্বিক শান্তি ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা বৈঠকে বাংলাদেশেরও উপস্থিতি প্রয়োজন। সেই উপস্থিতির ব্যবস্থা না করে দিলি্ল কি করে নিজেদের সমস্যা এবং বাংলাদেশের সমস্যা নিয়েও একতরফা আলোচনা ও চুক্তি সম্পাদনে যায়?
বঙ্গবন্ধুকে আমি আরো বলেছিলাম, সিমলা বৈঠকে দেখা গেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বড় বড় সমস্যা রয়ে গেছে, যেমন তাদের কাছে আমাদের পাওনা বিপুল অর্থ, জাতীয় সম্পদের হিস্যা ফেরত পাওয়া, কয়েক লাখ আটকে পড়া উর্দুভাষী পাকিস্তানিকে ফেরত নেওয়া, বাংলাদেশে ৯ মাসব্যাপী হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ক্ষতিপূরণ দেওয়া ইত্যাদি কোনো বিষয় এ আলোচনায় গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে কাশ্মীরে স্থিতাবস্থা মেনে নেওয়ার জন্য (কাশ্মীরের অর্ধেকের বেশি ভারতের, বাকি অংশ পাকিস্তানের) পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি। ভুট্টো অত্যন্ত ধূর্ত লোক। তিনি বাংলাদেশে আটক ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে তাঁর আর্মিকে খুশি করার জন্য আপাতত কাশ্মীরে স্থিতাবস্থা মেনে নিয়ে চুক্তি করেছেন। দিলি্লও খুশি মনে ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানকে উপহার দিয়েছে। আর যুদ্ধবন্দিরাও এ সময় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামেই আটক। আগেই তাদের কৌশল করে ঢাকা থেকে কলকাতায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সুতরাং পাকিস্তানের কাছে তাদের ফেরত দেওয়ার সময় বাংলাদেশের আপত্তি বিবেচনা করার দরকার হয়নি। আমি কি এই বিষয়গুলো আমার লেখায় তুলে ধরতে পারি?
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'না, এই মুহূর্তে লিখ না। আমি ইন্দিরা গান্ধীকে বিব্রত করতে চাই না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল এবং আমাদের তিনি প্রকৃতই বন্ধু।' কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দিলি্লর অবাঙালি আমলাতন্ত্র আবার তাঁর ঘাড়ে চেপে বসেছে। সিমলা বৈঠকে বাংলাদেশের উপস্থিতির ব্যাপারে আপত্তিটা পাকিস্তানের। ইসলামাবাদের অবাঙালি আমলাদের এই আপত্তি। দিলি্লর আমলারা সেই আপত্তি মেনে নিয়েছেন এবং ইন্দিরা গান্ধীকে বুঝিয়েছেন, পাকিস্তান এখন পরাজিত পক্ষ। তার কাছ থেকে কাশ্মীরের ব্যাপারে ভারতের অনুকূল একটা চুক্তিতে সই আদায় করা সম্ভব হবে, দেরিতে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আর সিমলা বৈঠকে বাংলাদেশের উপস্থিতির ব্যাপারে পাকিস্তানের আপত্তির প্রধান কারণ তারা দেখাচ্ছে যে স্বাধীন বাংলাদেশকে তারা এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। স্বীকৃতি দেওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে তারা কোনো বৈঠকে বসতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আমি তাতেও অসম্মতি জানাতাম। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশটির প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসতে না চাইলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সিমলা বৈঠকে না তোলার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানাতাম। তিনি তাতে রাজি হতেন বলে আমার ধারণা। কিন্তু আমি এ অনুরোধ জানাইনি পাকিস্তানে আটক হাজার হাজার বাঙালি সিভিলিয়ান ও আর্মির লোকজনের কথা ভেবে। তারা সেখানে বন্দি অবস্থায় নির্যাতিত হচ্ছিল। অনেকে পাকিস্তান থেকে দুর্গম পথে অন্য দেশে পালাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আমি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেওয়া মেনে নিয়ে আটক বাঙালিদের দ্রুত ফেরত আনতে চেয়েছি। যুদ্ধবন্দি ফেরত দেওয়া বা যুদ্ধবন্দি বিনিময় সব যুদ্ধের পরই হয়। কোরিয়া যুদ্ধের পর জানমুলজন বৈঠক শেষে যুদ্ধবন্দি বিনিময় হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর তাসখন্দ বৈঠক শেষে যুদ্ধবন্দি বিনিময় হয়েছে। আমার কাছে মুখ্য যুদ্ধবন্দির বিচার নয়, মুখ্য যুদ্ধবিরোধীদের বিচার। তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশে আছে। বাকিদেরও দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করা হবেই।'
সিমলা চুক্তি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর বাধ্যবাধকতা আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি আরো বলেছিলেন, 'ভুট্টো যতই গড়িমসি করুন, বাংলাদেশকে শিগগিরই তাঁর স্বীকৃতি দিতে হবে। পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে আমি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতেও বাংলাদেশের প্রতি অনুকূল মনোভাব সৃষ্টি করতে পেরেছি। পাকিস্তানের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো প্রভাবশালী দেশ_বিশেষ করে মিসর ও ইরাক ইতিমধ্যেই চাপ সৃষ্টি করেছে যাতে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং আগামী ইসলামী রাষ্ট্রের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হয়। আমার স্থির বিশ্বাস, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যেসব অমীমাংসিত সমস্যা রয়ে গেছে, অদূর-ভবিষ্যতে তা নিয়ে আমরা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে আলোচনা বৈঠকে বসতে পারব। তাতে ভারতের উপস্থিতি দরকার হবে না।'
বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তাঁর কেবিনেটের আপত্তি অগ্রাহ্য করে লাহোর ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ছুটে গিয়েছিলেন। ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং তাঁকে সদলবলে ঢাকায় এনেছিলেন। ভারতের মতো পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক ও সদ্ভাব রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত আন্তরিক ও আগ্রহী ছিলেন। তাঁর সেই লক্ষ্য যে অর্জিত হয়নি সে জন্য মূলত দায়ী দিলি্লর চাণক্যপুরীর কূটনৈতিক খেলা এবং ভুট্টোর দুরভিসন্ধি ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা। ভুট্টো সময় ও সুযোগ পেয়েই ইন্দিরার সঙ্গে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি ভঙ্গ করেন, হিটলার যেমন করেছিলেন ব্রিটেনের চেম্বারলেনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত মিউনিখ চুক্তি। এমনকি ঢাকা সফর শেষে পাকিস্তানে ফিরে গিয়েই তিনি মুজিব হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আরো বাড়িয়ে তোলেন।
প্রশ্নটি তাই এখনো ওঠে, বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে দিলি্ল অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার পর যেখানে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর কথা ছিল, তা না হয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় কেন বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা, তাঁর সরকারের উচ্ছেদ এবং বাংলাদেশকে আবার ভারতবিরোধী অবস্থানে দাঁড় করানো সম্ভব হলো? বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানোর পর তিন-চার বছর না যেতেই সেই পাকিস্তানের সমর্থক গোষ্ঠী কিভাবে দেশটিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে? পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কিভাবে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে প্রভাব বিস্তার করে? নিষিদ্ধ ঘোষিত সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে কিভাবে তারা পুনর্গঠিত করে? এবং বাংলাদেশের তিন দিকের স্থলভাগ ভারতের দ্বারা বেষ্টিত থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সেই আইএসআই কিভাবে ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটিয়ে এক থাবায় দেশটিকে পুনর্দখল করে তাদের তাঁবেদার রেজিম আবার ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারে?
তা কি সম্ভব হয়েছিল কেবল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির দুর্বলতা ও ভ্রান্তির জন্য? না, তার পেছনে বড় এবং গণতান্ত্রিক প্রতিবেশী ভারতের আধিপত্যবাদী আমলাতন্ত্রের দুর্বলতা, কূটনৈতিক শঠতা এবং পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক জান্তাগুলোর ষড়যন্ত্রের কাছে তাদের পরাজয়ও অন্যতম কারণ ছিল? এ প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব এখন প্রকাশ্য আলোচনার মাধ্যমেই খুঁজে নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং বাংলাদেশ-ভারত স্থায়ী মৈত্রী প্রতিষ্ঠার পথে দিলি্লর আমলাতান্ত্রিক অহমিকা, দম্ভ ও শঠতা যে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করে রেখেছে, তা ব্যর্থ করা যাবে না এবং উপমহাদেশেও শান্তি-সহযোগিতার সুবাতাস নিশ্চিত করা যাবে না।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক ও চুক্তি থেকেও এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে মৈত্রীতে বিশ্বাসী এবং গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের বন্ধুত্ব পাকা করার ব্যাপারে দিলি্লর গড়িমসি রয়েছে এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে এক কাতারে রেখে দুই দেশ সম্পর্কে তারা প্রায় অভিন্ন মনোভাব দেখায়। পাকিস্তানের প্রতি তাদের মনোভাব তবু কিছুটা তোয়াজপূর্ণ, বলা চলে এপিজমেন্ট পলিসি। বাংলাদেশের প্রতি এই নীতি অনেকটাই অবজ্ঞাপূর্ণ।
এই অবজ্ঞাপূর্ণ নীতির প্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যাতায়াতব্যবস্থায়। ভারতে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই পাকিস্তান থেকে গেছে অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত_এ কথা প্রমাণিত হওয়ার পরও পাকিস্তান থেকে ভারতে যাতায়াতে যে কড়াকড়ি ব্যবস্থা, সেই একই কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাতায়াতে। ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করতে গেলে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ও পরিচিত ব্যক্তিদেরও যে অবজ্ঞা ও হয়রানি সহ্য করতে হয়, সেই অবজ্ঞা ও হয়রানি বিশ্বের আর কোনো মিত্র দুটি দেশের একটিকে সহ্য করতে হয় না। ইউরোপে তো এত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও ভিসা প্রথা উঠেই গেছে।
'মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট'_এটাই মনে হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে বর্তমান ভারতের নীতি। একদিকে চলছে, বাংলাদেশকে অকৃত্রিম বন্ধু দেশ আখ্যা দিয়ে নানা ধরনের স্তুতিবাক্য উচ্চারণ এবং অন্যদিকে চলছে, সেই স্তুতিবাক্যের বিপরীত আচরণ এবং দাদাগিরির খেলা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই খেলার যে সূচনা, তা এখন কূটনীতির বড় খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সম্পর্কে দু-একটা উদাহরণ দিতে চাই পরবর্তী আলোচনাটাকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য।
(অসমাপ্ত)
লন্ডন, ১৯ সেপ্টেম্বর, সোমবার, ২০১১
No comments