সহজ-সরল-বাবা, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো by কনকচাঁপা
পৃথিবীতে অনেক রকম মানুষই আছেন। তাঁদের কেউ জ্ঞানী, কেউ নির্বোধ, কেউ পরিশ্রমী, কেউ অলস। কেউ কালো, কেউ ফরসা। এসব ক্ষেত্রে শ্রেণীবিন্যাস করে কূল পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমি ভাবি, অনেক রকম মানুষ ও বিজ্ঞানী-শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক_এঁদের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। সবাই কমবেশি মেধার অধিকারী। কিন্তু এই বিজ্ঞানী-শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক_এঁরা পৃথিবী বা পুরো জগৎটাকেই অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভাবনায় দেখে থাকেন।
নিউটন-অ্যারিস্টটল, টমাস আলভা এডিসন, গ্যালিলিও, শেকসপিয়ার, গ্যেটে, ভ্যান গগ, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, পাবলো নেরুদা, ম্যাঙ্মি গোর্কি, মার্ক টোয়েন, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জাফর ইকবাল_কোথা থেকে কোথায় এলাম_আসব না? সবই যে এক সুতোয় বাঁধা। কেউ অঙ্ক কষে পরের হাজার বছরের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন, কেউ আপেল কেন উড়ে গেল না এই একটা প্রশ্ন বাধিয়ে দুনিয়ার তাবড় উত্তরকেই উড়িয়ে নিয়ে গেলেন। কেউ রাজার নীতিকে ছন্দে বাঁধিয়ে গেলেন, কেউ কবিতায় দূর-নক্ষত্রে দুধসাদা ধোঁয়ার জালের অঙ্ক বোঝালেন। সবই কিন্তু ভবিষ্যৎকে_ভবিষ্যতের চিন্তাভাবনাকে হাজার বছরের জন্য এগিয়ে দেওয়ার জন্য। সন্তর্পণে; কিন্তু শক্ত হাতে। এঁদের চোখ অন্য সবার চেয়ে আলাদা। রবিবাবু ঠিকই জানতেন দেড় শ বছর পরও তাঁর লেখা সবার জীবনে আলো ছড়াবে_আমাদের জীবনানন্দের কবিতা ঘাঁটলে, স্ট্যাটোস্ফিয়ার থেকে থার্মোস্ফিয়ার, সবই খুঁজে পাওয়া যাবে। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আকাশের ঠিকানায় যখন চিঠি লিখতে বলেছেন তখন কি আমরা ই-মেইল চিনতাম? এ রকম কাল থেকে কালান্তরে যাওয়া? জ্যোতিষীও ঘাবড়ে যাবেন; কিন্তু শিল্পী? তাঁরা সহজেই সহজ পদচারণে পদযুগলের ছাপ ফেলে অনন্তর হেঁটে গন্তব্যে পেঁৗছে যান। সে গন্তব্য কখনো হয় জনমানবের উৎপ্রাস, কখনো হয় এক গ্লাস হেমলক, কখনো নিদারুণ দারিদ্র্য অথবা ট্রামের তলায় চাপা পড়ে মৃত্যু। এ যেন যুগে যুগে শিল্পী-বিজ্ঞানীদের পাওনা। তবু তাঁরা তাঁদের কাজকে অবশ্যকর্তব্য না ভেবে বিপুল জলরাশির মতো করে প্রবাহিত করে এই পৃথিবীর জনপদকে ফুলে, ফলে, ফসলে ভরিয়ে দিয়েছেন কিছু না পেয়েই। তাঁদের জন্যই হাজার বছরের পৃথিবী আমার কাছে একমুঠো কাব্য। কিন্তু আমি? আমার পরিচয় কী? ছোটবেলায় চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলাম অথবা পটুয়া। বাবা দেননি। সংসারের অর্ধেক কড়ি খরচা করে আমাকে গড়ে তুলেছেন একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। সেই সঙ্গে ভালো মানুষ। কিন্তু আমি কি শিল্পী ও ভালো মানুষ হতে পারলাম। গান যেটা গাই, তা তো স্রষ্টার দান; বাবা, স্বামী, ওস্তাদজির প্রচেষ্টার ফল আর জনগণের ভালোবাসার জোরে। কিন্তু এই সমাজের কোনো কাজে এলাম কি? সত্য কথা বলি না জেলে যাওয়ার ভয়ে, চোর ধরিয়ে দিই না জান বাঁচানোর জন্য, হরতালের সময় বাড়ির বারান্দায় দাঁড়াতেও ভয় পাই, যদি মিছিলের গুলি এসে লাগে! কোথাও কোনো বক্তব্য দিতে গেলে আগে-পিছে ভাবতে ভাবতে আসল কথা চেপে রাখি। কোনো জায়গায় জাতির জনক, কোথাও স্বাধীনতার ঘোষক, কোথাও মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, কোথাও বীরাঙ্গনা বলতে চারদিকে তাকাই। কেন? আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক এবং আপাদমস্তক একজন 'হতে চাওয়া' শিল্পী। আমি কেন ছাপোষা কেরানির মতো হাত কচলাব? একজন শিল্পী-লেখক-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী_তাঁরা সব সময়ই প্রাসঙ্গিক এবং অবশ্যই পৃথিবীর কালের কণ্ঠ। প্রযুক্তি, আয়েশ, সৌন্দর্য, সত্য_সব কিছুকেই তাঁরা কাল থেকে মহাকালে স্থানান্তর করেন। তাঁদের এই ছোটখাটো বিড়ম্বনা, মৃত্যুর ভয় একদমই থাকে না। তেমন নির্ভীক-প্রাসঙ্গিক কি আমি হতে পারব? ঘুণে ধরা সমাজ, নিপীড়িত জনপদ, কলুষিত নদী, বিষাক্ত ফল, আর্সেনিকের পানি, নেতার কোলে পরিকল্পিত লাশ, উত্তেজিত-খেপা আমজনতা_সব কিছু দেখেও আমি গাইব_'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।' গাইব হৃদয়ভরা আবেগ ও নয়নভরা জল নিয়েই; কিন্তু এর আর কোনো অর্থ দাঁড়ায় না।
আমার আর নির্ভীক শিল্পী হওয়া হলো না। আমি কাঁদছি। বাবা_ও দেশবাসী, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো।
লেখক : সংগীতশিল্পী
আমার আর নির্ভীক শিল্পী হওয়া হলো না। আমি কাঁদছি। বাবা_ও দেশবাসী, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো।
লেখক : সংগীতশিল্পী
No comments