বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৯২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মনির আহমেদ, বীর প্রতীক চরম বিপদেও মনোবল হারাননি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন মনির আহমেদ। প্রাণপণ লড়াই করেও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারলেন না। পিছু হটতে বাধ্য হলেন। পেছনে নতুন স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে আবার যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।


কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ওপর আবার আক্রমণ চালাল। শুরু হয়ে গেল রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ যুদ্ধ। এ ঘটনা ঘটে মাধবপুরে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যে সড়কটি সিলেট অভিমুখে গেছে, ওই সড়ক ধরে ১৮ মাইল গেলেই মাধবপুর। সেখান থেকে হবিগঞ্জ জেলা শুরু। ২৮ এপ্রিল সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত মাধবপুরে সংঘটিত হয় সর্বাত্মক এক যুদ্ধ। রক্তক্ষয়ী এ সম্মুখ সমরে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের নৈপুণ্য, সাহস ও দেশপ্রেমের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ যুদ্ধে মনির আহমেদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্ষুদ্র দলের নেতৃত্ব দেন।
সেদিন সকাল আটটার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান লক্ষ্য করে প্রথমে ব্যাপক কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। এরপর পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের বাংকার-ট্রেঞ্চের ভেতর থেকে রিকোয়েললেস রাইফেল (আরআর), মেশিনগান, হালকা মেশিনগান, মর্টার, রাইফেল প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার প্লাটুন পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। তার পরও পাকিস্তানি সেনারা প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দলের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান দিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা চরম সংকটের মধ্যে পড়েন। তখন মনির আহমেদ সাহসিকতার সঙ্গে তাঁর দলের সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তাঁদের পাল্টা হামলায় পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগত কারণে পেছনে হটে যান। পরে পাকিস্তানিরা সেখানেও আক্রমণ করে।
এ যুদ্ধ সম্পর্কে মেজর কে এম সফিউল্লাহর (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান) মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বইয়ে বর্ণনা আছে। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘...এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা অপরিসীম সাহস আর দৃষ্টান্তমূলক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিল। লেফটেন্যান্ট মোর্শেদ, ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন মতিন, সুবেদার নূরুল আমিন চৌধুরী, সুবেদার আবদুল করিম, হাবিলদার কেরামত, হাবিলদার আরসাদ, হাবিলদার মো. মনির (মনির আহমেদ), ল্যান্স নায়েক মান্নান, সেপাই মফিজ, শাহজাহান (শহীদ), সেপাই খায়রুজ্জামান, সেপাই ওয়াহেদ প্রমুখ এই যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব আর নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বেশ কিছুসংখ্যক সৈনিক শাহাদাতবরণ করেন এবং কিছু মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পাকিস্তানিদের পক্ষে ন্যূনতম ২৭০ জন হতাহত হয়।’ (পৃষ্ঠা ১১৭-১২০)।
মনির আহমেদ চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। আলফা (এ) কোম্পানিতে। ১৯৭১ সালে এ রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রথমে যুদ্ধ করেন ৩ নম্বর সেক্টরে। পরে তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভৈরব, আশুগঞ্জ, আখাউড়াসহ আরও কয়েক স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মনির আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১০৩।
মনির আহমেদের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলার (ডাক দিনমনিরহাট) পশ্চিম নূরপুর গ্রামে। বর্তমানে তিনি এখানেই বসবাস করছেন। তাঁর বাবার নাম আলী আহমদ, মা মানাফা খাতুন। স্ত্রী জাহান আফরোজ বেগম। তাঁদের দুই ছেলে, তিন মেয়ে।
সূত্র: মনির আহমেদ বীর প্রতীক, প্রথম আলোর নোয়াখালী প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান, ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.