বাকশাল ছিল সাংবিধানিক ক্যু by শহীদুল্লাহ ফরায়জী

আজ ২৫শে জানুয়ারি বাকশাল দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক সাংবিধানিকভাবে প্রথম ক্যু (a silent coup) সংঘটিত হয়।

’৭৪-এর ২৮শে ডিসেম্বর, অপরাধ দমন ও অভ্যন্তরীণ গোলযোগে বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর হুমকি প্রদানের কথা বলে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করা হয়। এর ঠিক ২৭ দিন পর ২৫শে জানুয়ারি ’৭৫-সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় শাসন কায়েম করার লক্ষ্যে সংসদে চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস করিয়ে নেন। শুধুমাত্র ক্ষমতাকে সুসংহত ও চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-সালের সংবিধানকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিল অথচ এই বিলটি নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা বা বিতর্কের সুযোগ দেয়া হয়নি। চতুর্থ সংশোধনী বিলটি এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সংসদে গৃহীত হয় এবং তখনই তা আইনে পরিণত হয়। এত দ্রুত আইনপ্রণয়ের ইতিহাস সংসদীয় রাজনীতিতে বিরল।

আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ২৫শে জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে এতদসংক্রান্ত বিলটি উত্থাপন করেছিলেন। একইদিনে তা ২৯৪-০ ভোটে গৃহীত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন সংসদনেতা এবং প্রধানমন্ত্রী। তার নেতৃত্বেই চতুর্থ সংশোধনী বিল উত্থাপন করা হয় এবং ওইদিনই তা সংসদে গৃহীত হয়েছে। একইদিনে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থেকে (দিনশেষে রাতে) রাষ্ট্রপতি হয়েছেন এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে এই বিলে স্বাক্ষর দিয়ে কার্যকর করেছেন। এটা শুধুই বিরল নয়, ইতিহাসেও একমাত্র দৃষ্টান্ত। সংবিধান আছে, সংসদও আছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি  হয়েছেন। না জনগণের দ্বারা, না সংসদ দ্বারা। একজন ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং  সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নিচ্ছেন কোনো ধরনের নির্বাচন ছাড়াই। প্রজাতন্ত্রে কোনোভাবেই এসব করা সম্ভব নয়, সম্ভব কেবল সম্রাট বা রাজার বেলায়।
আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের প্রতি কতোটুকু আনুগত্যশীল চতুর্থ সংশোধনী সুনির্দিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চতুর্থ সংশোধনীতে সংবিধানের যে-সব ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন করা হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা:

সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন: বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনপদ্ধতির পরিবর্তে বাকশালের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনপদ্ধতি চালু করা হয়েছিল এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অর্থাৎ রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মাঝে ভারসাম্য নীতি গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীতে সৃষ্ট রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। রাষ্ট্রের কোনো বিভাগ যেন স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে তার জন্য স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বা নিয়ন্ত্রণ কিংবা ভারসাম্য রক্ষায় কোনোরকম আইন প্রণয়ন করেনি। বরং রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগকেই পরোক্ষ বা  প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল। সুতরাং এটা ছিল তথাকথিত রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার।

রাষ্ট্রপতি: চতুর্থ সংশোধনীতে প্রথম পরিচ্ছেদ ৪৮ (১) বলা হয় ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচিত হইবেন।’ কাজেই রাষ্ট্রপতি অবশ্যই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে দায়িত্ব পালন করবেন।

৭৫-সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সময়টুকুও ধৈর্য ধরেননি। বরং অতিদ্রুত ক্ষমতা গ্রহণের জন্য চতুর্থ সংশোধনীতে সংবিধান বহির্ভূত একটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়।
চতুর্থ সংশোধনীর সর্বশেষ ৩৪ ধারায় যুক্ত হলো রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান।

সংশোধনীর ৩৪ ধারায় বলা হলো সংবিধানে যাহা বলা হয়েছে, তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে,
ক) এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হবে; খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।

চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে আজীবন রাষ্ট্রপতি পদে থাকার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল। অর্থাৎ জনগণের ভোট ছাড়াই রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এটা আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুই নির্ধারণ করেছেন; জনগণ নয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মেয়াদ আজীবন শেষ হবে না এবং তিনি উক্ত পদে বহাল থাকবেন। কিন্তু পদে বহাল ছিলেন মাত্র ২০২ দিন। ২০২ দিন পর সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হন একটি সামরিক ক্যু-এর মাধ্যমে।

চতুর্থ সংশোধনীতে পদের বিপরীতে ব্যক্তির নাম লেখা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু নেই। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর এমন  দেউলিয়াপনা, চিন্তার দারিদ্র্য ও গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যহীনতা ক্ষমার অযোগ্য। এর মাধ্যমে গণতন্ত্র এবং মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই-সংগ্রাম ও ১৪ বছর কারাগারে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের মানসিকতার প্রমাণ মিলে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি কিন্তু ধরে নিতে হবে তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত। এটাই হলো ‘সাংবিধানিক ক্যু’। এই ‘ক্যু’-এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৭১- সালের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তর পূর্ববর্তী বঙ্গবন্ধু আর পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ক্ষমতার উন্মাদনায় কীভাবে জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাসকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়া হয়েছিল, রক্তের উপর ভাসমান একটি রাষ্ট্রের সংবিধানকে  কীভাবে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন করা হয়েছিলো, তা গভীর পর্যালোচনার প্রয়োজন।

আরও নজিরবিহীন ঘটনা আছে। যেহেতু সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন হয়েছে, সেহেতু জনগণের ম্যান্ডেটের জন্য নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা প্রয়োজন কিন্তু এতে আবার একটা শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। সংশোধনীর ৩৩ ধারায় বলা হলো, ‘এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে দায়িত্ব পালনরত সংসদ, রাষ্ট্রপতি ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে এই আইন প্রবর্তন হইতে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে ভাঙ্গিয়া যাইবে।’ অর্থাৎ জনগণের ভোট ছাড়াই জাতীয় সংসদকে পাঁচ বছরের জন্য পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তী বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়নের জন্য।

১) অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ২) অসাংবিধানিকভাবে সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি। এই অভূতপূর্ব দুটো দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করাই যথেষ্ট। এতেই আওয়ামী লীগের চরিত্র, সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।  
চতুর্থ সংশোধনীর আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ না করলে বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার রাষ্ট্র সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে অসুবিধা হবে।

রাষ্ট্রপতির অভিশংসন:
৭২-সালের সংবিধানে দুটো কারণে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করার বিধান রাখা হয়েছিল:
১) সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণ ২) শারীরিক ও মানসিক  অসামর্থ্য হলে।
এজন্য রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে হলে সংসদ সদস্যগণ সাধারণ  সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন করবেন এবং উত্থাপিত প্রস্তাব  দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা গৃহীত হবে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়েছে সেহেতু  রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দরকার হবে শুধু প্রস্তাব আনতে এবং তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দরকার হবে প্রস্তাব পাস করতে।

আওয়ামী লীগ হয়তো বিশ্বাস করতো বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তার বিরুদ্ধে  অভিশংসন বা অপসারণের প্রস্তাব উত্থাপন হবে এবং সেই অপসারণ ঠেকাতে জটিল প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আওয়ামী লীগের কী ভয়ঙ্কর ভয়!

বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতাকে সুসংহত করতে সংবিধানকে ব্যবহার করা হয়েছে। চতুর্থ সংশোধনীতে বঙ্গবন্ধুকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে। কারণ সংবিধান সংশোধন করতে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোটের প্রয়োজন আর রাষ্ট্রপতি অপসারণের জন্য তিন চতুর্থাংশ ভোটের প্রয়োজন। এতে সংবিধানের প্রাধান্য চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এত সর্বনাশা পদক্ষেপ আওয়ামী লীগের পক্ষেই গ্রহণ করা সম্ভব!

সশস্ত্র লড়াইয়ে অর্জিত একটি রাষ্ট্রের সংবিধান ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধু। শেখ হাসিনা যথার্থই পিতার আদর্শের যোগ্য অনুসারী। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করার ধৈর্যটুকুও ধরতে চাননি, ফলে রাষ্ট্রপতি এবং সংসদ নির্বাচন দুটোকেই নির্বাচনবিহীন সম্পাদন করেছেন। শেখ হাসিনা তার পিতার মতো সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সংবিধানের কোনো ধারা বা উপধারায় সংশোধন করেননি বরং নির্বাচনকে প্রতারণাপূর্ণ করে ক্ষমতাকে ধরে রেখেছেন ১৫ বছর। আর তার পিতা বাকশাল করে মাত্র ২০২ দিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন! যেদিন বাকশাল অর্থাৎ ‘সাংবিধানিক ক্যু’ সম্পন্ন হয়েছে, মূলত সেদিনই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরোয়ানা  জারি হয়েছে। এই অমোঘ সত্য স্বীকার করার সামর্থ্য আওয়ামী লীগের নেই। ফলে  বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভুলগুলো আওয়ামী লীগ পর্যালোচনা করছে না। অহেতুক বঙ্গবন্ধুকে দেবতার আসনে বসাতে গিয়ে তার মানবিক মর্যাদাও বিনষ্ট করছে।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তারবরণ করলেও বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এতো বড় গৌরব, এতো বড় সাফল্য বাঙালি অর্জন করে ফেলবে, তা  তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। বাঙালি যে-তাকে  অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিল তার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাও তিনি দেখাতে পারেননি। ফলে সিরাজুল আলম খান এবং তাজউদ্দীন আহমদকে দ্রুত পরিত্যাগ করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে একমাত্র বিকল্প। স্বাধীনতার স্বপ্ন শুরুতেই হাতছাড়া হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত থেকে মুক্তিযোদ্ধা চেতনা ধারণ করতে না চেয়ে পাকিস্তানি শাসন ব্যবস্থা পুনর্বহাল করলেন। বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা তৃষ্ণার কাছে লাখো- লাখো শহীদের স্বপ্ন বিক্রি হয়ে গেল। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হলো।

রাষ্ট্রক্ষমতা কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে গণতন্ত্র, রাজনৈতিক চরিত্র এবং সংবিধানের শিষ্টাচার থেকে দূরবর্তী করে দিয়েছিল তার আরও কয়েকটি উদাহরণ দেয়া দরকার। আলোচ্য সংশোধনীর মাধ্যমে, বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ব্যতিরেকে সকল রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিতদের অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীদেরকেও বাকশালে যোগদান করার জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।

চতুর্থ সংশোধনীতে সংসদ সদস্য না হলেও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করার বিধান ছিল। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদ আইন পাস করলে তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন, এজন্য রাষ্ট্রপতিকে চরম ভেটো (ধনংড়ষঁঃব াবঃড়) ক্ষমতা দেয়া হয় না। মূল সংবিধানে তা-ই ছিল। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে চরম ভেটো ক্ষমতা দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক একবার ভেটো প্রয়োগ করলে সংসদে গৃহীত বিলটি আর আইনে পরিণত হবে না। অর্থাৎ চতুর্থ সংশোধনীত সংসদকে রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করা হয়।

৭২-সালের সংবিধানের ৪৪ ও ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীতে তা চাতুরতার সঙ্গে কেড়ে নেয়া হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, ‘এই ভাগে প্রদত্ত অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য সংসদ আইনের দ্বারা একটি সাংবিধানিক আদালত-ট্রাইব্যুনাল অথবা কমিশন প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবে।’ অর্থাৎ মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় হাইকোর্টের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি ১০২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগ যেন মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন তুলতে না পারে বা কোনো আদেশ দিতে না পারে।’ তার জন্য মূল সংবিধানের ১০২(১) অনুচ্ছেদকে বিলুপ্ত করা হয়েছে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে  আওয়ামী লীগের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রকাশের দুই একটা নমুনা উল্লেখ করার মতো। মূল সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে ছিল, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে অন্যান্য বিচারপতিকে নিয়োগ দান করবেন। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি একাই প্রধান বিচারপতিসহ সকল বিচারক নিয়োগ করবেন। বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ ছাড়া অন্যান্য বিচারক নিয়োগ দেয়া হয় না। এতে বাকশালের সুপারিশে দলীয় লোকদের বিচারক নিয়োগের স্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ বিচার বিভাগকে বাকশালের একটি অঙ্গ-সংগঠনে পরিণত করা  হয়েছিল। ৯৬ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে চতুর্থ সংশোধনীতে রাখা হয়, ‘অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা কোনো বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে।’ অর্থাৎ বিচারক নিয়োগ এবং অপসারণ রাষ্ট্রপতির ইচ্ছামাফিক বা মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ-শৃঙ্খলা (১১৬ অনুচ্ছেদ) রক্ষায় রাষ্ট্রপতির হাতে একক ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল সংশোধনীতে। এভাবেই একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কবর দেয়া হয়েছিল। সর্বশেষ বিষয়টি উল্লেখ করা জরুরি,  সংশোধনীতে তৃতীয় তফসিল সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনা প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে স্পিকারের নিকট  প্রতিস্থাপিত করে, যা মূল সংবিধান বা প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

রাজনৈতিক-গণতন্ত্র বা সামাজিক-গণতন্ত্রের অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতিতেও শেখ মুজিব ছিলেন উদাসীন। বিপুল জনপ্রিয়তা, প্রবল সম্মোহনী শক্তি এবং প্রচণ্ড বাগ্মিতার অধিকারী বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিত্বকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে তার মতের বিরোধিতা করার ন্যূনতম প্রয়োজনও নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। ফলে স্বাধীনতার পর অল্প কিছুদিনেই বঙ্গবন্ধু সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শাসিত একনায়কতান্ত্রিক (Prime Minister's dictatorship) শাসনব্যবস্থার প্রতিভূ হয়ে ওঠেন। সংবিধান, আইন এবং বিধি-বিধান কোনো কিছুকে তিনি নিজের ঊর্ধ্বে মনে করতেন না।

সংবিধান এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে প্রজাতন্ত্রের নকশা অঙ্কন করা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের যে-স্বপ্ন বপন করা হয়েছিল, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে সাম্য বা সামাজিক সুবিচারের যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল তা উচ্ছেদ করে দিয়ে একদলীয় বাকশাল কায়েম করে।

গণতন্ত্রের বিঘোষিত নীতি হলো: ‘জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি, এই ইচ্ছাটি পর্যায়ক্রমিক এবং প্রকৃত নির্বাচনে প্রকাশ করা হবে, যা সার্বজনীন ও সমান ভোটাধিকার দ্বারা হবে এবং গোপন ভোট বা সমতুল্য অবাধ ভোটদান পদ্ধতি দ্বারা অনুষ্ঠিত হবে।’ কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বিলুপ্ত করে ৭২-সালের সংবিধানের মৌলিক-কাঠামো ধ্বংস করা হয়। এই ধ্বংসের নেতৃত্ব দিয়েছেন, একসময়ের অবিসংবাদিত নেতা।

লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com

mzamin

No comments

Powered by Blogger.