বিদ্যুৎ ও তেলের দাম বাড়ালে হরতাল অবরোধ- তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে বিল আনুন সংসদে যাব: খালেদা জিয়া

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য জাতীয় সংসদে বিল আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, ‘সংসদের আগামী অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল নিয়ে আসুন। আমরা সংসদে যাব। আসুন আলোচনার মাধ্যমে সম্মিলিত এই বিল পাস করি।’
গতকাল বুধবার ১৮ দলীয় জোটের গণসংযোগ কর্মসূচিতে রাজধানীর ভাটারায় শেষ পথসভায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার তার মেয়াদ পুরা করুক। কিন্তু তার আগে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করতে হবে। আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘আজ আমি আর কোনো কর্মসূচি দিচ্ছি না। আগামী দিনে এই ইস্যুতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব। যত দিন না পর্যন্ত সরকার দাবি মানছে, তত দিন পর্যন্ত আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোর হবে।’ তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম আবারও বাড়ানো হলে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে সরকারকে হুঁশিয়ার করেন।
খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি পথসভায় বক্তৃতা করেন। এসব পথসভায় তিনি বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন—এই একটি দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করছেন। সরকারের দুর্নীতি, অপশাসন ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন। কিন্তু সরকার এটাকে ‘অন্যভাবে ব্যবহার’ করছে। তিনি বলেন, ‘সাপকেও বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না। কারণ আওয়ামী লীগ তাদের ছাড়া কিছু বোঝে না।’ তিনি দাবি করেন, নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন দিলে জনগণ আওয়ামী লীগকে ছেঁড়া কাপড়ের মতো ছুড়ে ফেলবে। এ ভয়ে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি ও ‘মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহারের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ঢাকাসহ সব মহানগরে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করে।
গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় রাজধানীর গাবতলীর বাগবাড়িতে পথসভার মধ্য দিয়ে ঢাকায় গণসংযোগ কর্মসূচি শুরু করেন খালেদা জিয়া। এরপর পর্যায়ক্রমে কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ ও সর্বশেষ সন্ধ্যা সাতটায় ভাটারায় পথসভা করেন। এ ছাড়া ধোলাইখালে সমবেত জনতার উদ্দেশে গাড়িতে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন খালেদা। সবগুলো পথসভায় তিনি মোট পৌনে তিন ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে বিএনপির মুখপাত্র ও সম্বয়ক তরিকুল ইসলামসহ বিএনপি ও ১৮ দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা ছিলেন।
বিরোধীদলীয় নেতার পথসভাকে কেন্দ্র করে গতকাল রাজধানীতে যানজটের আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু রাস্তায় যানবাহনের চলাচল খুব কম থাকায় তেমন পরিস্থিতি হয়নি। পথসভায় অংশ নিতে বিএনপি ও যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হন। পথসভাগুলোতে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিও ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁরা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দলের নয় শীর্ষ নেতার ছবিসংবলিত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড বহন করেন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন।
যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গ: ‘জামায়াতকে সঙ্গে পাওয়ার জন্য যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে সরকার মুলা ঝুলিয়েছে’ দাবি করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘আমরাও যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই। বিচারটা স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের করেন, সত্যিকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেন। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কেবল বিএনপি-জামায়াতের নয়, আওয়ামী লীগে এবং প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও যারা যুদ্ধাপরাধী আছে তাদেরও ধরেন, তাহলে বুঝব সত্যিকারের বিচার আপনারা চান।’
‘আওয়ামী লীগের চেহারা ও রং পাল্টাতে সময় লাগে না’ বলে মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর নেতা নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীসহ অনেককে ধরেছেন। কিন্তু ’৮৬ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে এরশাদকে রক্ষা করতে নির্বাচনে গেছেন। এরপর ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, একসঙ্গে মিটিং করেছেন; তখন তারা যুদ্ধাপরাধী ছিল না?’
বিভিন্ন পথসভায় এ বক্তৃতার সময় খালেদা জিয়া কয়েকটি ছবি দেখান। এর মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনার সঙ্গে মতিউর রহমান নিজামীর বৈঠক, আলী আহসান মুজাহিদের সঙ্গে শেখ সেলিমের করমর্দন ও নিজামীর সঙ্গে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর করমর্দনের ছবি। খালেদা বলেন, ‘এই যে দেখেন ইনু সাহেব, পারলে নিলডাউন হয়ে নিজামীর সঙ্গে হাত মেলান। আর এখন বড় বড় কথা বলছেন।’ এ বক্তৃতার সময় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা করতালি দেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘তিনি পাকিস্তানিদের অধীনে শেষ দিন পর্যন্ত চাকরি করেছেন। সে রাজাকারকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়ে বলছেন, রাজাকারের বিচার করবেন।’ বিশ্বজিৎ দাস হত্যার জন্যও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়ী করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া। তিনি কারওয়ান বাজারের পথসভায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দিন-রাত মিথ্যা কথা বলেন। অশ্লীল ও নোংরা ভাষায় কথা বলেন। এর জবাব আমার মুখ দিয়ে বের হয় না।’ যাত্রাবাড়ীর পথসভায় খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতের একটি রায়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘উনার (প্রধানমন্ত্রী) মাথা খারাপ। এ জন্য উনি খারাপ কথা বলেন।’
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে খালেদা বলেন, ‘আপনি বলেছেন, চোরের মায়ের বড় গলা। আমরা কোনো অন্যায় করিনি। আপনার এত বড় গলা কেন? প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে, মেয়ের জামাই, ছেলে, কোথায় কী করেছেন—তা ইন্টারনেটেও ছড়িয়ে গেছে। তাই বড় গলা বন্ধ করেন। আপনিই চোরের মা। আপনার ছেলে আমেরিকার এয়ারপোর্টে ডলারসহ ধরা পড়েছে। সে টাকা আমেরিকা সরকার রেখে দিয়েছে। চোরের মার বড় গলা হলো আপনার।’
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম বাদ দেওয়ায় সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আবুলকে ধরলে আপামণি, দিদিমণি, ভাইয়া, জামাইবাবু, রুই-কাতলারা বেরিয়ে আসবে। সে জন্য আবুলকে ধরা হচ্ছে না।’
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, পদ্মা সেতু, হল-মার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার, ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসা ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে সরকারের লোকেরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। তিনি মির্জা ফখরুলসহ বিরোধী দলের ২৫ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির সমালোচনা করেন।
এসব পথসভায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে সরকারের দুঃশাসন, লুটপাট, নৈরাজ্যের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। তিনি যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তোমাদের জাগতে হবে, ঘুমিয়ে থাকলে হবে না। তোমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের পথ করে দেওয়ার জন্য আমরা রাস্তায় নেমেছি। ঘরে বসে থাকলে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে।’
শনিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠক: আগামী শনিবার রাত আটটায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। ওই বৈঠকে পরবর্তী কর্মসূচির ব্যাপারে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.