ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের উভয় সংকট by গওসল আযম

ইসরায়েলের ধারণা ইরান বহুদিন থেকেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে চলেছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য। ইরান বলছে, তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম শান্তির প্রক্রিয়ায় এবং জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য। সমরবিশারদদের অনেকের মতে, ইরান এখনও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে এগোনোর পথে অগ্রসর হয়নি।


ইসরায়েলের ধারণা, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অত্যন্ত সনি্নকটে পেঁৗছে গেছে

ইরানে ২৬ আগস্ট শুরু হয়েছে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলন। চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। বিশ্ব যখন দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল তখন এ আন্দোলন যথেষ্ট শক্ষিশালী হয়ে উঠেছিল। এখন 'বিশ্বে শিবির নেই'। কিন্তু বিশ্ব কি তারপরও নিরাপদ? একক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের জন্যই হুমকি, এ অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন মহাদেশে। যে দেশটিতে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর নেতারা সমবেত হয়েছেন সেই ইরানও কিন্তু রয়েছে হুমকিতে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অন্যতম প্রধান নীতি হলো স্ব-স্বার্থ চরিতার্থের জন্য ভাগ করা এবং শাসনের নামে বা বন্ধুত্বের আড়ালে শোষণ করা বা শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। এই মতবাদের ভিত্তিতেই মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোকে রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্র, সামরিক স্বৈরতন্ত্র এবং তাদের ছত্রছায়া গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রে ভাগ করেছে। এরপরও যাতে সম্মিলিতভাবে তাদের জ্বালানি শক্তি তাদের বিরুদ্ধে বা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য সৃষ্টি করেছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের। রাষ্ট্রটি ক্ষুদ্র হলেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায়, পারমাণবিক অস্ত্রের সহায়তায় অমিত শক্তির অধিকারী। এ রাষ্ট্রটির কাছে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জও অসহায়। মুসলমানরা অসহায় তাদের বিভেদের কারণে। ইসরায়েল ১৯৮১ সালে ইরাকের পারমাণবিক চুলি্ল ধ্বংস করেছে। বেশ কিছুদিন ধরে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক চুলি্ল ধ্বংস করতে চাইছে এবং এ ব্যাপারে আপ্ত ও প্রাপ্ত অস্ত্র শানাচ্ছে। বিশ্ববাসী পাচ্ছে সম্ভাব্য আক্রমণের বার্তা। আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব লিয়ন প্যানেটা আগে মন্তব্য করেছিলেন_ এপ্রিল, ২০১২ তারিখের মধ্যে ইসরায়েল ইরাকে পারমাণবিক চুলি্ল আক্রমণ করতে পারে। পরে অবশ্য তিনি বলেছিলেন, আক্রমণ হতে পারে জুনের বা এ বছরের মধ্যে।
ইসরায়েলের ধারণা, ইরান বহুদিন থেকেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে চলেছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য। ইরান বলছে, তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম শান্তির প্রক্রিয়ায় এবং জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য। সমরবিশারদদের অনেকের মতে, ইরান এখনও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে এগোনোর পথে অগ্রসর হয়নি। ইসরায়েলের ধারণা, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অত্যন্ত সনি্নকটে পেঁৗছে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে সরে এসে স্বল্পতম সময়ে অস্ত্র তৈরির ঘোষণা দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে। চিন্তাবিদদের অনেকেই মনে করেন, ইরান যদি সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায়, তাহলে ইরান তা করবেই। পারমাণবিক চুলি্ল ধ্বংস করে ইরানকে অস্ত্র তৈরি থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। ইরান আক্রমণ করে তাদের সংকল্পকে আরও দৃঢ় করা হবে মাত্র। এ কথা এখন ইসরায়েলের অধিবাসীদের অনেকেই মনে করে, আকাশপথে ইরান আক্রমণ করে পারমাণবিক চুলি্ল ধ্বংস করার সম্ভাবনা শঙ্কামুক্ত নয়। ইরান পবিত্র কোম শহরের অদূরে ফরদৌয়ের ৮০ মিটার পাথুরে পর্বতের নিচে এক কারখানায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। কারখানার উপরিস্থ পাহাড় একই রকমের এবং অনেক পাহাড় দ্বারা মৌচাকের মতো আবৃত। অনেকে মনে করেন, ফরদৌয়ের কারখানা ধ্বংস করার প্রযুক্তি ইসরায়েলের নেই। ১৯৭৯ সালে শাহের পতনের আগে থেকেই ইরান পাশ্চাত্য দুনিয়ার উন্নত অস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত। শাহের পতনের পর কমিউনিস্ট দুনিয়ার অস্ত্রও ইরানের হাতে এসেছে। উভয় দুনিয়ার অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ইরান নিজস্ব কারিগরি জ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে এবং প্রয়োগে ইরান যে দক্ষতা অর্জন করেছে তা আরব উপমহাদেশের স্বৈরশাসকদের জন্য ঈর্ষণীয়। ইরান বলেছে, আক্রান্ত হলে নৌ আক্রমণসহ যে রাষ্ট্র থেকে আক্রমণ উৎসারিত হবে, সে রাষ্ট্রেও আক্রমণ করবে। কুয়েত, বাহরাইন, কাতার ও সংযু্ক্ত আরব আমিরাতে আমেরিকার ঘাঁটি রয়েছে। এগুলো ইরানের প্রতি-আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে। ফলে আমেরিকা পারমাণবিক চুলি্ল এলাকার বাইরেও ইরানি লক্ষ্যবস্তু আক্রমণ করবে। তখন সরাসরি ইসরায়েল আক্রমণ করবে ইরান। হিজবুল্লাহ এবং হামাস লেবানন ও গাজা থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ করবে। আরব তথা মুসলিম বিশ্ব ইসরায়েল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। ইসরায়েলের ওপর চলবে ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ। ইরান আক্রমণ জন্ম দেবে আঞ্চলিক যুদ্ধের, যা বিশ্বযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করার আশঙ্কা বাদ দেওয়া যায় না। ইরানের শক্তির উৎস জনগণ বর্তমান সরকারকে সর্বশক্তি দিয়ে সমর্থন দেবে। উত্থান ঘটবে ধর্মান্ধ শক্তির।
ইরানের জনগণ মনে করে, তারা একটি প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী। তাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী। তা ছাড়া ইরান ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে কোনো দেশ আক্রমণ করেনি। এসব কারণে ইরানের পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পাশ্চাত্য শক্তি এগুলো বিবেচনায় না নিয়ে হঠকারী এবং একগুঁয়ে ইসরায়েলকে পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত করেছে। পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য পাকিস্তানের পারমাণবিক ক্ষমতার চাবি মৌলবাদীদের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে পারমাণবিক ক্লাবই শঙ্কামুক্ত নয়।
ইরান ৬,৩৬,২৯৩ বর্গমাইলের বিশাল একটি দেশ। জনসংখ্যা প্রায় ৭ কোটি। শিক্ষার হার ৯১ শতাংশ। পারমাণবিক ক্রম কর্মপরিকল্পনা শাহের আমলে গৃহীত। ধারণাবহির্ভূত এলাকার বাইরেও ইরানের পারমাণবিক এলাকা থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। থাকলে সেগুলো আক্রমণের বাইরে নিরাপদ থেকে যাবে। এমনকি সব পারমাণবিক এলাকা ধ্বংস হলেও পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পের ইচ্ছা ধ্বংস হবে না। ধ্বংস হবে না এর জন্য আহরিত জ্ঞান এবং প্রয়োগের জন্য দক্ষ মানুষের। এমনকি বহির্বিশ্ব থেকে পারমাণবিক শক্তি আহরণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর সরবরাহ পাওয়ার দ্বার বন্ধ হবে না। অনেকের বিশ্বাস, ইরানের হাতে বিভিন্ন মানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বিভিন্ন এলাকায় বা অঞ্চলে আছে। বোমা মেরে এর সব একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নাও হতে পারে বা সম্ভব নয়। পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা, ইরানের ইচ্ছা থাকলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করবেই। সে ক্ষেত্রে সৌদি আরব তাদের ঘোষণামতো পারমাণবিক চুলি্ল আহরণের ব্যবস্থা করতে চাইবে। তাদের জন্য এটা বেশ সহজ হবে পাকিস্তানের সহায়তার জন্য। আরও দুই আঞ্চলিক শক্তি যথা_ মিসর ও তুরস্ক তখন চাইবে পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য হতে। এমনকি সুদূরের ব্রাজিলও চাইবে পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য হতে। আমেরিকা কয়েক বছর পরপর ইরানে হামলা চালিয়েও তাদের সব চুলি্ল এলাকা ধ্বংসের সাফল্য শতভাগ নিশ্চিত করতে পারবে না। আবার সর্বাত্মক যুদ্ধ আমেরিকা বা তার মিত্রদের তথা সমগ্র বিশ্বের জন্য জঘন্যতমভাবে মারাত্মক। এক যুগ ধরে ইরাকে ও আফগানিস্তানে আমেরিকার অবস্থান যে কোনো দিক থেকেই সুখকর হয়নি। আমেরিকার অর্থনীতি আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ভাবমূর্তিতে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান, ইরাক, আফগানিস্তানের গণমানুষ আজ আমেরিকার বিরুদ্ধে। তাদের থেকে যে বাণী উৎসারিত হয়েছে তা হচ্ছে, আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন নেই, যা ভিয়েতনাম যুদ্ধ উৎসারিত মন্তব্যের সমার্থক।
যে কোনোভাবেই ইরান আক্রমণকারী বা তার মিত্রদের জন্য সহায়ক হবে না। বাকি থাকল সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়ে ইরানকে পারমাণবিক শক্তি আহরণ থেকে সাময়িকভাবে নিবৃত্ত করা। কিন্তু ইরানের জনমত এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, যে কোনো সরকার বাধ্য হবে পারমাণবিক শক্তি আহরণ করতে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক অবরোধের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো চালিয়ে যাওয়াই আমেরিকার জন্য যৌক্তিক, যদিও ইসরায়েলি চাপ চুলি্ল ধ্বংসের।

গওসল আযম :কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.