আজ সেই ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ৭ বছর পূর্তি by শংকর কুমার দে
আজ ভয়াল ১৭ আগস্ট। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ৭ বছরপূর্তি। দীর্ঘ ৭ বছরেও দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার মামলাগুলোর বিচার কাজ শেষ হয়নি। এই ব্যাপারে দায়েরকৃত ২৭৫টি মামলার মধ্যে ৯৪টির বিচার শেষ হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে ১শ’ ৫৬টি মামলা।
তদন্তাধীন ২৫টি মামলার মধ্যে ৫ মামলার তদন্ত কাজ শেষ হয়নি এখনও। চার্জশীট দাখিল করা হলেও মামলাগুলো এখনও বিচারাধীন রয়েছে। তবে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলাকারী জঙ্গীগোষ্ঠীর মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) দেশের ৬৩ জেলার (মুন্সীগঞ্জ বাদে) গুরুত্বপূর্ণ সাড়ে ৪শ’ স্থানে প্রায় সাড়ে ৫শ’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জঙ্গী হামলার প্রকাশ্যে প্রচার চালায়। হামলায় দু‘জন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রকাশ্যে জঙ্গী কার্যক্রম। গত ৫ বছরে জেএমবির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও তাদের নির্মূল করা সম্ভবপর হয়নি। আত্মগোপনে থেকে জেএমবি তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। নামে-বেনামে, ছদ্মনামে জঙ্গীরা এখনও তৎপরতা চালাচ্ছে।
দেশজুড়ে ১৭ আগস্টের পর শুরু হয় একের পর এক আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা। বোমা হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন নিহত হন। আহত হন ৪ শতাধিক। বাংলাদেশ জঙ্গীকবলিত হয়ে পড়ায় সেই ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিম-লে আলোচিত হয়। জঙ্গী গ্রেফতারে তৎপর হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঐ সময় গ্রেফতার হয় জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহসহ প্রায় সাড়ে ৪শ’ জঙ্গী নেতাকর্মী। সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ঢাকা মহানগর বাদে সারাদেশে দায়ের করা হয় ১শ’ ৩৮টি মামলা। হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৪শ’ জন গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে ৯শ’ ৮১ জনকে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, সাংগাঠনিকভাবে জেএমবির কার্যক্রম একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। তবে তাদের একেবারে নির্মূল করা এখনও সম্ভব হয়নি। তাদের দ্বারা বড় ধরনের কোন নাশকতা ঘটানোর মতো ক্ষমতা আর নেই। জেএমবি গ্রেফতার করতে র্যাবের অভিযান চলছে। তাদের গতিবিধি নজরদারিতে আছে।
সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জেএমবির জঙ্গী কার্যক্রমের ঘটনায় সারাদেশে ৩শ’ ২২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে চার্জশীট হয়েছে ২শ’ ৮৯টির। ১শ’ ১৫টি মামলার বিচার কাজ শেষ হয়েছে। ২৫টি মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। ৮টি মামলার তদন্ত কাজ চলছে। বিচার শেষ হওয়া ১শ’ ১৫টি মামলার মধ্যে ৯৫টি মামলায় আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৫১ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। ১শ’ ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং ১শ’ ৮৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
রাজধানীর ৩৩টি স্পটে বোমা হামলার ঘটনায় ১৮টি মামলা দায়ের হয়। এই ১৮টি মামলার মধ্যে ৫টি মামলায় বোমার বাহককে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে মামলার তদন্ত কাজ থেমে গেছে। এ ব্যাপারে ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, র্যাবের হাতে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া জেএমবি ক্যাডারদের মাধ্যমে তথ্য বেরিয়ে আসছে যে তাদের কেউ কেউ ঢাকায় বোমা হামলার সময় বোমা বহন করেছিল অথবা বোমা বিস্ফোরণের তথ্য জানতে পারে। তদন্তকারী সূত্রে জানানো হয়েছে, গ্রেফতারকৃতদের তথ্য অনুযায়ী মামলাগুলোর তদন্ত কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে জেএমবির শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার কর হয়। এদের মধ্যে সিরিজ বোমা হামলার কারিগর মইনুল হক ওরফে ইকবাল ওরফে রাজীবকে গত বছরের ২২ জুন র্যাব ঢাকার পল্লবী থেকে গ্রেফতার করে। এর আগে জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিরিজ বোমা হামলার দায়িত্ব পালনকারী বোমারু মিজানকে ২০০৯ সালের ১৪ মে মিরপুরের পীরেরবাগ থেকে গ্রেফতার করে। এছাড়া র্যাব সিরিজ বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শাহাদত, নরসিংদীতে সাইফুল, ময়মনসিংহ থেকে সাইফুর, গাজীপুর থেকে মোহতাছিম বিল্লাহ ওরফে বশির, নারায়ণগঞ্জ থেকে ক্বারি সাইদুর রহমান ও ঢাকার শনিরআখড়া থেকে হানিফ ওরফে কালামকে গ্রেফতার করে। এরা সকলেই ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল। সর্বশেষ গত জুন মাসে জেএমবির আমির মওলানা সাইদুর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তবে এরা যেসব স্থানে বোমা হামলা চালিয়েছিল ঐ ঘটনায় দায়ের করা অনেক মামলার বিচার কাজ শেষ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এসব আসামিদের অন্য বোমা হামলা মামলায় সম্পূরক চার্জশীট দেয়া হচ্ছে।
সিরিজ বোমা হামলার পূর্ব কথা
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) সিরিজ বোমা হামলা চালায় জঙ্গীরা। রাজধানীসহ সারাদেশে সকাল ১১টায় এ হামলা চালানো হয়। দেশের ৩শ’টি স্থানে মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে একযোগে ৫শ’ বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে দু’জন নিহত ও দু’শতাধিক লোক আহত হয়। পরে আরও প্রায় ২০টি মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়। সিরিজ বোমা হামলার স্থান হিসাবে হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারী-আধাসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বেছে নেয়া হয়। হামলার স্থানসমূহে জামা’তুল মুজাহিদীনের লিফলেট পাওয়া যায়। লিফলেটগুলোতে বাংলাদেশে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বক্তব্য লেখা ছিল। দেশের কর্মরত বিচারকদের প্রতি একটি বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, দ্রুত এদেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে হবে। নতুবা কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে জেএমবি। ইসলামী হুকুমত কায়েমের বিষয়ে তাদের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক শক্তিশালী দেশ ও শীর্ষ রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। অতএব যারা বিচারক আছেন তারা তাগুতি আইন বাদ দিয়ে ইসলামী আইনে বিচার করবেন। নতুবা আরও ভয়াবহ বিপদ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এ সতর্কবাণীর (সিরিজ বোমা হামলা) পর আমরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর আবার হামলা শুরু হবে। প্রসঙ্গত, সিরিজ বোমা হামলায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় শতাধিক মামলা দায়ের করে পুলিশ। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অর্ধশত মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়। এর মধ্যে জয়পুরহাট জেলায় দায়েরকৃত মামলায় ২০০৬ সালের ১৪ মে ১০ জনকে যাবজ্জীবন, ৩ জনকে ২০ বছরের কারাদ- ও ১৪ জনকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেয় আদালত।
সিরিজ বোমা হামলার কিছুদিন পর আবার শুরু হয় ধারাবাহিক হামলা। তারই জের ধরে ওই বছরই ৩ অক্টোবর চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের জেলা আদালতে বিচার কাজ চলাকালে বেলা ১২টায় আবার একযোগে বোমা হামলা চালানো হয়। এজলাসে ঢুকে বিচারককে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারা হয়। তিন জেলা আদালতে প্রতিজেলায় ৩টি করে মোট ৯টি বোমা ছোড়া হয়। এর মধ্যে ৫টি বোমা বিস্ফোরিত হয়। বাকিগুলো অবিস্ফোরিত থাকে। এ ব্যাপারে চাঁদপুর ও চট্টগ্রামে দায়েরকৃত মামলায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এসব মামলায় শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, জাভেদ ইকবাল, আবু জহর, জাহেদুল ইসলাম সুমন, শাহাদত হোসেন ও লাল্টুকে আসামি করা হয়। এর ১৫ দিন পর ১৯ অক্টোবর সিলেটের দ্রত বিচার আদালতের বিচারক বিপ্লব গোস্বামীকে হত্যা করতে বোমা হামলা চালায় জঙ্গীরা। তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু বোমার আঘাতে মারাত্মক আহত হন। এর মাসখানেক পরেই ১৫ নবেম্বর বহুল আলোচিত ঝালকাঠি শহরের অফিসার্সপাড়ায় জাজেস কোয়ার্টারের সামনে বিচারকদের বহনকারী মাইক্রোবাসে শক্তিশালী বোমা দিয়ে হামলা চালানো হয়। বোমা বিস্ফোরণে ঝালকাঠি জজ আদালতের সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহমেদ চৌধুরী ও জগন্নাথ পাঁড়ে নিহত হন। অল্পের জন্য রক্ষা পান আরেক বিচারক আব্দুল আউয়াল। এ হামলার ঘটনায় ২টি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ৩০ নবেম্বর গাজীপুর ও চট্টগ্রাম আদালতে পৌনে এক ঘন্টার ব্যবধানে আত্মঘাতী জঙ্গীরা গায়ে বোমা বেঁধে হামলা চালায়। এতে ২ জঙ্গীসহ ৯ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। সর্বশেষ ২ ডিসেম্বর গাজীপুর জেলা আদালতে আবারও চায়ের ফ্ল্যাক্সে করে বোমা হামলা চালানো হয়। এতে ৭ জন নিহত ও অর্ধশত আহত হয়। সর্বশেষ চলতি বছর জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করার সময় জঙ্গীরা প্রদর্শনীর জন্য রাখা বোমা তুলে ছুড়ে মারে।
জঙ্গী গ্রেফতার
বিভিন্ন হামলার সঙ্গে জড়িত জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমানকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটের পূর্ব শাপলাবাগ এলাকার সূর্র্য দীঘল বাড়ি থেকে, জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইকে ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থানাধীন চেচুয়া বাজারের রামপুরা গ্রাম থেকে, হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর মধ্য বাড্ডা থেকে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের বানিয়াচালা মসজিদ থেকে, আব্দুল আউয়াল ওরফে আদিলকে ২০০৫ সালের ১৮ নবেম্বর ঠাকুরগাঁও থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য আতাউর রহমান ওরফে সানিকে ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য হাফেজ রাকিব হাসান ওরফে মাহমুদকে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে, জেএমবির সূরা সদস্য মোঃ সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে তৌহিদকে ২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিডিএ এলাকার একটি বাড়ি থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য ফারুক হোসেন ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে সিরাজ ওরফে আমজাদকে ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়া-ডগাইর এলাকার আইডিয়াল পাড়ের ৮ নম্বর বাড়ি থেকে, জেএমবির সামরিক কমান্ডার মোঃ মোহতাসিম বিল্লাহ ওরফে বশিরকে ২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে, জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ মোঃ জাহিদ হোসেন সুমন ওরফে বোমা মিজানকে ২০০৯ সালের রাজধানীর মিরপুর পীরেরবাগ এলাকা থেকে ও জেএমবির আইটি শাখার প্রধান বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার মোঃ এমরানুল হক ওরফে রাজীব ওরফে মঈনুল ওরফে আবু তোবা ওরফে ইকবালকে রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে চলতি মাসের জুন মাসে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ঝালকাঠির দুই বিচারক হত্যা মামলায় পরে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ঝালাকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় ২০০৬ সালের ২১ মার্চ মামুন, সুলতান হোসেন খান, শায়খ আব্দুর রহমান, আব্দুল আউয়াল, আতাউর রহমান সানি, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, শাকিল আহমেদ ওরফে মোল্লা ওমর (মৃত) ও মেহেদীসহ ৮ জনকে আসামি করে চার্জশীট দাখিল করা হয়। ২০০৬ সালের ৩০ মে মামলায় রায়ে শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আউয়াল, মাসুম, খালিদ, সাইফুল্লাহসহ মোট ৭ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ এদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোটের কানেকশন
২০০১ সালে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ বিস্তার ঘটে। বহুল আলোচিত আফগান যুদ্ধে অন্তত ১২ হাজার বাংলাদেশী অংশ নেয়। যুদ্ধে অংশ নেয়াদের মধ্যে ১ হাজার ৮২ জন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের। আফগান ফেরত যোদ্ধারা দেশে ফিরে ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলায় ‘জাগো মুজাহিদ’ নামে একটি সংগঠন করে। ১৯৯৫ সালের দিকে মুফতি হান্নান অন্তত ৩ হাজার আফগান ফেরত যোদ্ধাকে সংগঠিত করে। সংগঠিত দলটিকে হরকত-উল-জিহাদ অব বাংলাদেশ সংক্ষেপে (হুজিবি) নাম দেয়া হয়। হুজিবিই পরবর্তীতে হুজি নাম ধারণ করে। হুজি গঠনে বিএনপি-জামায়াতের একটি অংশ নানাভাবে সহযোগিতা করে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী একটি মুসলিম দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা হুজি গঠনে আর্থিক সহায়তা করে। আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া ভারতীয় ও পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার মুজাহিদরা হুজি ও জেএমবির সঙ্গে যোগ দেয়। সম্প্রতি মনসুর আলী ওরফে হাবিবুল্লাহ, ড. ওবায়দুল্লাহ ও হাবিবুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ দেশীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে জঙ্গীদের মোটা অঙ্কের টাকা দেয়া হয়। এসব টাকা দিয়ে আফগান ফেরত জঙ্গীরা ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে। পরে মুফতি হান্নান, শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইয়ের পরামর্শে সুনামগঞ্জ জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার পিছনে, নাইক্ষ্যংছড়ি, হিমছড়ি, বিলাইছড়ি, খাগড়াছড়ি, মানিকছড়ি, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পটিয়া, লালখানবাজার, সিলেট ও কক্সবাজারের উখিয়াসহ আশপাশের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মাদ্রাসার নামে ১৫টি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়। ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব পালন করে মুফতি হান্নান, মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, ভারতীয় জঙ্গী মুফতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ও মাওলানা হাবিবুল্লাহ। লস্কর-ই-তৈয়বার শীর্ষ নেতা আমির রেজা খান, খুররম খৈয়াম ওরফে শাহজাহান, মাওলানা আকরাম, মাওলানা আবু খালেক, মাওলানা জালাল উদ্দিন ট্রেনিং পরিদর্শন করে। জঙ্গীদের মাঝে সনদও বিতরণ করা হয়।
১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়া থেকে ট্রেনিংরত অবস্থায় হুজির ৪০ সদস্যকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রধান ও রোহিঙ্গার সামরিক শাখার প্রধান কমান্ডার মোহাম্মদ সেলিম ওরফে সেলিম উল্লাহকে গ্রেফতার করে। সেলিম উল্লাহর সঙ্গে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলাকারী হুজি নেতা কারাবন্দী মুফতি হান্নান, মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, আবু জান্দাল, মুরসালিন, মুত্তাকিন, ভারতীয় শীর্ষ জঙ্গীনেতা ওবায়দুল্লাহ, হাবিবুল্লাহ, পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা আমির রেজা খান, খুররম খৈয়ামের সখ্য ছিল। হুজি ও জেএমবি সেলিম মোহাম্মদের কাছ থেকে অস্ত্রও সংগ্রহ করে। সেলিম উল্লাহ গ্রেফতার হওয়ার খবর ঢাকার এমপি হোস্টেলে পৌঁছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দু’জন এমপি গ্রেফতারের খবরে চরম নাখোশ হয়। প্রসঙ্গত, সেলিম মোহাম্মদ আরাকানের অধিবাসী। পরে স্থানীয় দুই সাংসদ মোহাম্মদ শাহজালাল ও মোহাম্মদ শাহজাহানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। এই দুই সাংসদ সহোদর। এদের একজন বিএনপি থেকে অপরজন জামায়াত থেকে নির্বাচিত সাংসদ। পরবর্তীতে দুই সাংসদ তাদের বোনকে সেলিম মোহাম্মদের সঙ্গে বিয়ে দেয়।
কক্সবাজার থেকে গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়। গ্রেফতারকৃতদের পক্ষে আইনী লড়াইয়ের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নেতা ব্যারিস্টার কোরবান আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দু’জন স্থানীয় সাংসদ ও ৩ মন্ত্রীর নির্দেশেই জামায়াত নেতা ও আইনজীবীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ব্যারিস্টার কোরবান আলীকে জঙ্গীদের পক্ষে আইনী লড়াই করতে শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইও তদ্বির করেছিল। আদালত গ্রেফতারকৃত হুজি সদস্যদের যাবজ্জীবন সাজা মঞ্জুর করেন। জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার কোরবান আলী জামিনে ব্যর্থ হলে দলের তরফ থেকে যথেষ্ট কথা শুনতে হয়েছিল। পরে অবশ্য বিএনপি-জামায়াত জোটের আর্শীবাদে হুজি সদস্যরা জামিনে ছাড়া পায়। মুক্ত হয়েই আবার তারা গোপনে সংঘটিত হতে থাকে। গত ২ জুলাই সাজাপ্রাপ্ত ৪০ হুজি সদস্যদের মধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এর আগে শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, মুফতি হান্নান, আবু জান্দাল ও আতাউর রহমান সানি গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে বিএনপি-জামায়াতের অনেকের সঙ্গেই তাদের সখ্যের বিষয়টি স্বীকার করে। সর্বশেষ ২০০২ সালে শায়খ রহমান পাকিস্তান গিয়ে লস্কর-ই-তৈয়বার নিকট থেকে অস্ত্রসহ বোমা ও গ্রেনেডের ওপর বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করে। ২০০৫ সালে পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক আব্দুর রহমান ও সাজ্জাদ হোসেন জেএমবিকে ১০ হাজার পাউন্ড সাহায্য করে। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় কক্সবাজারে ট্রেনিং নেয়া অন্তত ২০ হুজি সদস্য এ দুটি হামলায় অংশ নেয়। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ৭ বছর পরও হামলাকারী সব জঙ্গী যেমন ধরা পড়েনি, তেমনি যেসব জঙ্গী হামলায় অংশ নিয়ে ধরা পড়েছে তাদের বিচারও সম্পন্ন হয়নি।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) দেশের ৬৩ জেলার (মুন্সীগঞ্জ বাদে) গুরুত্বপূর্ণ সাড়ে ৪শ’ স্থানে প্রায় সাড়ে ৫শ’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জঙ্গী হামলার প্রকাশ্যে প্রচার চালায়। হামলায় দু‘জন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রকাশ্যে জঙ্গী কার্যক্রম। গত ৫ বছরে জেএমবির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও তাদের নির্মূল করা সম্ভবপর হয়নি। আত্মগোপনে থেকে জেএমবি তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। নামে-বেনামে, ছদ্মনামে জঙ্গীরা এখনও তৎপরতা চালাচ্ছে।
দেশজুড়ে ১৭ আগস্টের পর শুরু হয় একের পর এক আত্মঘাতী জঙ্গী হামলা। বোমা হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন নিহত হন। আহত হন ৪ শতাধিক। বাংলাদেশ জঙ্গীকবলিত হয়ে পড়ায় সেই ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিম-লে আলোচিত হয়। জঙ্গী গ্রেফতারে তৎপর হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঐ সময় গ্রেফতার হয় জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহসহ প্রায় সাড়ে ৪শ’ জঙ্গী নেতাকর্মী। সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ঢাকা মহানগর বাদে সারাদেশে দায়ের করা হয় ১শ’ ৩৮টি মামলা। হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৪শ’ জন গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে ৯শ’ ৮১ জনকে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, সাংগাঠনিকভাবে জেএমবির কার্যক্রম একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। তবে তাদের একেবারে নির্মূল করা এখনও সম্ভব হয়নি। তাদের দ্বারা বড় ধরনের কোন নাশকতা ঘটানোর মতো ক্ষমতা আর নেই। জেএমবি গ্রেফতার করতে র্যাবের অভিযান চলছে। তাদের গতিবিধি নজরদারিতে আছে।
সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জেএমবির জঙ্গী কার্যক্রমের ঘটনায় সারাদেশে ৩শ’ ২২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে চার্জশীট হয়েছে ২শ’ ৮৯টির। ১শ’ ১৫টি মামলার বিচার কাজ শেষ হয়েছে। ২৫টি মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। ৮টি মামলার তদন্ত কাজ চলছে। বিচার শেষ হওয়া ১শ’ ১৫টি মামলার মধ্যে ৯৫টি মামলায় আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৫১ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। ১শ’ ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং ১শ’ ৮৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
রাজধানীর ৩৩টি স্পটে বোমা হামলার ঘটনায় ১৮টি মামলা দায়ের হয়। এই ১৮টি মামলার মধ্যে ৫টি মামলায় বোমার বাহককে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে মামলার তদন্ত কাজ থেমে গেছে। এ ব্যাপারে ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, র্যাবের হাতে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া জেএমবি ক্যাডারদের মাধ্যমে তথ্য বেরিয়ে আসছে যে তাদের কেউ কেউ ঢাকায় বোমা হামলার সময় বোমা বহন করেছিল অথবা বোমা বিস্ফোরণের তথ্য জানতে পারে। তদন্তকারী সূত্রে জানানো হয়েছে, গ্রেফতারকৃতদের তথ্য অনুযায়ী মামলাগুলোর তদন্ত কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে জেএমবির শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার কর হয়। এদের মধ্যে সিরিজ বোমা হামলার কারিগর মইনুল হক ওরফে ইকবাল ওরফে রাজীবকে গত বছরের ২২ জুন র্যাব ঢাকার পল্লবী থেকে গ্রেফতার করে। এর আগে জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিরিজ বোমা হামলার দায়িত্ব পালনকারী বোমারু মিজানকে ২০০৯ সালের ১৪ মে মিরপুরের পীরেরবাগ থেকে গ্রেফতার করে। এছাড়া র্যাব সিরিজ বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শাহাদত, নরসিংদীতে সাইফুল, ময়মনসিংহ থেকে সাইফুর, গাজীপুর থেকে মোহতাছিম বিল্লাহ ওরফে বশির, নারায়ণগঞ্জ থেকে ক্বারি সাইদুর রহমান ও ঢাকার শনিরআখড়া থেকে হানিফ ওরফে কালামকে গ্রেফতার করে। এরা সকলেই ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল। সর্বশেষ গত জুন মাসে জেএমবির আমির মওলানা সাইদুর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তবে এরা যেসব স্থানে বোমা হামলা চালিয়েছিল ঐ ঘটনায় দায়ের করা অনেক মামলার বিচার কাজ শেষ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এসব আসামিদের অন্য বোমা হামলা মামলায় সম্পূরক চার্জশীট দেয়া হচ্ছে।
সিরিজ বোমা হামলার পূর্ব কথা
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) সিরিজ বোমা হামলা চালায় জঙ্গীরা। রাজধানীসহ সারাদেশে সকাল ১১টায় এ হামলা চালানো হয়। দেশের ৩শ’টি স্থানে মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে একযোগে ৫শ’ বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে দু’জন নিহত ও দু’শতাধিক লোক আহত হয়। পরে আরও প্রায় ২০টি মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়। সিরিজ বোমা হামলার স্থান হিসাবে হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারী-আধাসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বেছে নেয়া হয়। হামলার স্থানসমূহে জামা’তুল মুজাহিদীনের লিফলেট পাওয়া যায়। লিফলেটগুলোতে বাংলাদেশে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বক্তব্য লেখা ছিল। দেশের কর্মরত বিচারকদের প্রতি একটি বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, দ্রুত এদেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে হবে। নতুবা কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে জেএমবি। ইসলামী হুকুমত কায়েমের বিষয়ে তাদের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক শক্তিশালী দেশ ও শীর্ষ রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। অতএব যারা বিচারক আছেন তারা তাগুতি আইন বাদ দিয়ে ইসলামী আইনে বিচার করবেন। নতুবা আরও ভয়াবহ বিপদ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এ সতর্কবাণীর (সিরিজ বোমা হামলা) পর আমরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর আবার হামলা শুরু হবে। প্রসঙ্গত, সিরিজ বোমা হামলায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় শতাধিক মামলা দায়ের করে পুলিশ। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অর্ধশত মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়। এর মধ্যে জয়পুরহাট জেলায় দায়েরকৃত মামলায় ২০০৬ সালের ১৪ মে ১০ জনকে যাবজ্জীবন, ৩ জনকে ২০ বছরের কারাদ- ও ১৪ জনকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেয় আদালত।
সিরিজ বোমা হামলার কিছুদিন পর আবার শুরু হয় ধারাবাহিক হামলা। তারই জের ধরে ওই বছরই ৩ অক্টোবর চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের জেলা আদালতে বিচার কাজ চলাকালে বেলা ১২টায় আবার একযোগে বোমা হামলা চালানো হয়। এজলাসে ঢুকে বিচারককে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারা হয়। তিন জেলা আদালতে প্রতিজেলায় ৩টি করে মোট ৯টি বোমা ছোড়া হয়। এর মধ্যে ৫টি বোমা বিস্ফোরিত হয়। বাকিগুলো অবিস্ফোরিত থাকে। এ ব্যাপারে চাঁদপুর ও চট্টগ্রামে দায়েরকৃত মামলায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এসব মামলায় শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, জাভেদ ইকবাল, আবু জহর, জাহেদুল ইসলাম সুমন, শাহাদত হোসেন ও লাল্টুকে আসামি করা হয়। এর ১৫ দিন পর ১৯ অক্টোবর সিলেটের দ্রত বিচার আদালতের বিচারক বিপ্লব গোস্বামীকে হত্যা করতে বোমা হামলা চালায় জঙ্গীরা। তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু বোমার আঘাতে মারাত্মক আহত হন। এর মাসখানেক পরেই ১৫ নবেম্বর বহুল আলোচিত ঝালকাঠি শহরের অফিসার্সপাড়ায় জাজেস কোয়ার্টারের সামনে বিচারকদের বহনকারী মাইক্রোবাসে শক্তিশালী বোমা দিয়ে হামলা চালানো হয়। বোমা বিস্ফোরণে ঝালকাঠি জজ আদালতের সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহমেদ চৌধুরী ও জগন্নাথ পাঁড়ে নিহত হন। অল্পের জন্য রক্ষা পান আরেক বিচারক আব্দুল আউয়াল। এ হামলার ঘটনায় ২টি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ৩০ নবেম্বর গাজীপুর ও চট্টগ্রাম আদালতে পৌনে এক ঘন্টার ব্যবধানে আত্মঘাতী জঙ্গীরা গায়ে বোমা বেঁধে হামলা চালায়। এতে ২ জঙ্গীসহ ৯ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। সর্বশেষ ২ ডিসেম্বর গাজীপুর জেলা আদালতে আবারও চায়ের ফ্ল্যাক্সে করে বোমা হামলা চালানো হয়। এতে ৭ জন নিহত ও অর্ধশত আহত হয়। সর্বশেষ চলতি বছর জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করার সময় জঙ্গীরা প্রদর্শনীর জন্য রাখা বোমা তুলে ছুড়ে মারে।
জঙ্গী গ্রেফতার
বিভিন্ন হামলার সঙ্গে জড়িত জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমানকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটের পূর্ব শাপলাবাগ এলাকার সূর্র্য দীঘল বাড়ি থেকে, জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইকে ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থানাধীন চেচুয়া বাজারের রামপুরা গ্রাম থেকে, হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর মধ্য বাড্ডা থেকে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের বানিয়াচালা মসজিদ থেকে, আব্দুল আউয়াল ওরফে আদিলকে ২০০৫ সালের ১৮ নবেম্বর ঠাকুরগাঁও থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য আতাউর রহমান ওরফে সানিকে ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য হাফেজ রাকিব হাসান ওরফে মাহমুদকে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে, জেএমবির সূরা সদস্য মোঃ সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে তৌহিদকে ২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিডিএ এলাকার একটি বাড়ি থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য ফারুক হোসেন ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে সিরাজ ওরফে আমজাদকে ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়া-ডগাইর এলাকার আইডিয়াল পাড়ের ৮ নম্বর বাড়ি থেকে, জেএমবির সামরিক কমান্ডার মোঃ মোহতাসিম বিল্লাহ ওরফে বশিরকে ২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে, জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ মোঃ জাহিদ হোসেন সুমন ওরফে বোমা মিজানকে ২০০৯ সালের রাজধানীর মিরপুর পীরেরবাগ এলাকা থেকে ও জেএমবির আইটি শাখার প্রধান বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার মোঃ এমরানুল হক ওরফে রাজীব ওরফে মঈনুল ওরফে আবু তোবা ওরফে ইকবালকে রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে চলতি মাসের জুন মাসে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ঝালকাঠির দুই বিচারক হত্যা মামলায় পরে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ঝালাকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় ২০০৬ সালের ২১ মার্চ মামুন, সুলতান হোসেন খান, শায়খ আব্দুর রহমান, আব্দুল আউয়াল, আতাউর রহমান সানি, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, শাকিল আহমেদ ওরফে মোল্লা ওমর (মৃত) ও মেহেদীসহ ৮ জনকে আসামি করে চার্জশীট দাখিল করা হয়। ২০০৬ সালের ৩০ মে মামলায় রায়ে শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আউয়াল, মাসুম, খালিদ, সাইফুল্লাহসহ মোট ৭ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ এদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোটের কানেকশন
২০০১ সালে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ বিস্তার ঘটে। বহুল আলোচিত আফগান যুদ্ধে অন্তত ১২ হাজার বাংলাদেশী অংশ নেয়। যুদ্ধে অংশ নেয়াদের মধ্যে ১ হাজার ৮২ জন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের। আফগান ফেরত যোদ্ধারা দেশে ফিরে ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলায় ‘জাগো মুজাহিদ’ নামে একটি সংগঠন করে। ১৯৯৫ সালের দিকে মুফতি হান্নান অন্তত ৩ হাজার আফগান ফেরত যোদ্ধাকে সংগঠিত করে। সংগঠিত দলটিকে হরকত-উল-জিহাদ অব বাংলাদেশ সংক্ষেপে (হুজিবি) নাম দেয়া হয়। হুজিবিই পরবর্তীতে হুজি নাম ধারণ করে। হুজি গঠনে বিএনপি-জামায়াতের একটি অংশ নানাভাবে সহযোগিতা করে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী একটি মুসলিম দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা হুজি গঠনে আর্থিক সহায়তা করে। আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া ভারতীয় ও পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার মুজাহিদরা হুজি ও জেএমবির সঙ্গে যোগ দেয়। সম্প্রতি মনসুর আলী ওরফে হাবিবুল্লাহ, ড. ওবায়দুল্লাহ ও হাবিবুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ দেশীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে জঙ্গীদের মোটা অঙ্কের টাকা দেয়া হয়। এসব টাকা দিয়ে আফগান ফেরত জঙ্গীরা ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে। পরে মুফতি হান্নান, শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইয়ের পরামর্শে সুনামগঞ্জ জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার পিছনে, নাইক্ষ্যংছড়ি, হিমছড়ি, বিলাইছড়ি, খাগড়াছড়ি, মানিকছড়ি, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পটিয়া, লালখানবাজার, সিলেট ও কক্সবাজারের উখিয়াসহ আশপাশের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মাদ্রাসার নামে ১৫টি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়। ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব পালন করে মুফতি হান্নান, মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, ভারতীয় জঙ্গী মুফতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ও মাওলানা হাবিবুল্লাহ। লস্কর-ই-তৈয়বার শীর্ষ নেতা আমির রেজা খান, খুররম খৈয়াম ওরফে শাহজাহান, মাওলানা আকরাম, মাওলানা আবু খালেক, মাওলানা জালাল উদ্দিন ট্রেনিং পরিদর্শন করে। জঙ্গীদের মাঝে সনদও বিতরণ করা হয়।
১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়া থেকে ট্রেনিংরত অবস্থায় হুজির ৪০ সদস্যকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রধান ও রোহিঙ্গার সামরিক শাখার প্রধান কমান্ডার মোহাম্মদ সেলিম ওরফে সেলিম উল্লাহকে গ্রেফতার করে। সেলিম উল্লাহর সঙ্গে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলাকারী হুজি নেতা কারাবন্দী মুফতি হান্নান, মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, আবু জান্দাল, মুরসালিন, মুত্তাকিন, ভারতীয় শীর্ষ জঙ্গীনেতা ওবায়দুল্লাহ, হাবিবুল্লাহ, পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা আমির রেজা খান, খুররম খৈয়ামের সখ্য ছিল। হুজি ও জেএমবি সেলিম মোহাম্মদের কাছ থেকে অস্ত্রও সংগ্রহ করে। সেলিম উল্লাহ গ্রেফতার হওয়ার খবর ঢাকার এমপি হোস্টেলে পৌঁছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দু’জন এমপি গ্রেফতারের খবরে চরম নাখোশ হয়। প্রসঙ্গত, সেলিম মোহাম্মদ আরাকানের অধিবাসী। পরে স্থানীয় দুই সাংসদ মোহাম্মদ শাহজালাল ও মোহাম্মদ শাহজাহানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। এই দুই সাংসদ সহোদর। এদের একজন বিএনপি থেকে অপরজন জামায়াত থেকে নির্বাচিত সাংসদ। পরবর্তীতে দুই সাংসদ তাদের বোনকে সেলিম মোহাম্মদের সঙ্গে বিয়ে দেয়।
কক্সবাজার থেকে গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়। গ্রেফতারকৃতদের পক্ষে আইনী লড়াইয়ের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নেতা ব্যারিস্টার কোরবান আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দু’জন স্থানীয় সাংসদ ও ৩ মন্ত্রীর নির্দেশেই জামায়াত নেতা ও আইনজীবীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ব্যারিস্টার কোরবান আলীকে জঙ্গীদের পক্ষে আইনী লড়াই করতে শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইও তদ্বির করেছিল। আদালত গ্রেফতারকৃত হুজি সদস্যদের যাবজ্জীবন সাজা মঞ্জুর করেন। জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার কোরবান আলী জামিনে ব্যর্থ হলে দলের তরফ থেকে যথেষ্ট কথা শুনতে হয়েছিল। পরে অবশ্য বিএনপি-জামায়াত জোটের আর্শীবাদে হুজি সদস্যরা জামিনে ছাড়া পায়। মুক্ত হয়েই আবার তারা গোপনে সংঘটিত হতে থাকে। গত ২ জুলাই সাজাপ্রাপ্ত ৪০ হুজি সদস্যদের মধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এর আগে শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, মুফতি হান্নান, আবু জান্দাল ও আতাউর রহমান সানি গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে বিএনপি-জামায়াতের অনেকের সঙ্গেই তাদের সখ্যের বিষয়টি স্বীকার করে। সর্বশেষ ২০০২ সালে শায়খ রহমান পাকিস্তান গিয়ে লস্কর-ই-তৈয়বার নিকট থেকে অস্ত্রসহ বোমা ও গ্রেনেডের ওপর বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করে। ২০০৫ সালে পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক আব্দুর রহমান ও সাজ্জাদ হোসেন জেএমবিকে ১০ হাজার পাউন্ড সাহায্য করে। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় কক্সবাজারে ট্রেনিং নেয়া অন্তত ২০ হুজি সদস্য এ দুটি হামলায় অংশ নেয়। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ৭ বছর পরও হামলাকারী সব জঙ্গী যেমন ধরা পড়েনি, তেমনি যেসব জঙ্গী হামলায় অংশ নিয়ে ধরা পড়েছে তাদের বিচারও সম্পন্ন হয়নি।
No comments