কথা সামান্যই-উত্তর-ঔপনিবেশিকতা তত্ত্ব এখন অচল by ফজলুল আলম

আমাদের হাতেগোনা যে কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা আছে, তাতে নানা বিষয়ের মধ্যে উত্তর-ঔপনিবেশিকতা তত্ত্বের প্রয়োগ করে কিছু সমালোচক আমাদের প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেন। সেসব আবার বিশেষ মর্যাদাসহকারে ছাপানো হয়। ছাপা অক্ষরের একটা মাহাত্ম্য আছে- পাঠকরা সেটাকে সহজে অগ্রাহ্য করতে পারেন না।


ইন্টারনেটে বিষয় খুঁজতে গেলে প্রায়ই টিউটোরিয়াল মার্কা (ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশিত) যেসব লেখা পাওয়া যায়, সেসবের অধিকাংশেই যথাযথ কথা লেখা হয়নি। বিষয়গুলো সম্পর্কে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন তাঁরা সহজেই ভুল ধরতে পারবেন, কিন্তু সাধারণ পাঠকরা ভুলটাই মেনে নেবেন সে ভয়ও আছে। শোনা কথা এবং অনেক ইঙ্গ-মার্কিন পত্রপত্রিকায় উঠেছিল যে ইরাক আক্রমণের কিছুদিন আগে সিআইএ ও এফবিআই- দুই সংস্থাই ইন্টারনেটে প্রকাশিত একটা রচনা পড়ে দ্রুত অ্যাকশন নেয় যে সাদ্দাম হোসেন 'কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল উইপনস' সব রেডি করে বসে আছে এবং কোনো সময় সাদ্দাম কুর্দিদের ওপর এবং ইসরায়েলে সেসব দিয়ে হামলা করবে। বুশ জুনিয়র এই খবরটি ব্রিটেনের ব্লেয়ারের সঙ্গে আলোচনা করে সঙ্গে সঙ্গে ইরাকের 'জনগণ'কে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল যে ইন্টারনেটে প্রকাশিত রচনার লেখক এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র এবং রচনাটি তার টিউটোরিয়াল অ্যাসাইমেন্টের জন্য লেখা। তাতে কে বিব্রত হয়েছিল জানা নেই, কিন্তু তত দিনে পূর্ণোদ্যমে ইঙ্গ-মার্কিন আক্রমণে ইরাক বিধ্বস্ত। এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য ছাপা অক্ষর ও ইন্টারনেট সম্পর্কে পাঠকদের সাবধান করে দেওয়া।
আমরা বর্তমানে কতকগুলো নতুন টার্মের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছি, তার মধ্যে দুটি হচ্ছে উত্তর-আধুনিকতা (পোস্টমডার্নিজম) ও উত্তর-ঔপনিবেশিকতা (পোস্টকলোনিয়ালিজম)। দুটিই পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তত্ত্ব (ইংরেজিতে আইডিয়োলজি- যেটার বাংলা অনুবাদ মতাদর্শ যথাযথ নয়, কারণ আইডিয়া বা ধারণা থেকে ইংরেজি আইডিয়োলজি শব্দটি এসেছে, আইডিয়াল বা আদর্শ থেকে নয়), এবং পাশ্চাত্যের সুবিধা অনুযায়ী সেগুলোর ব্যবহার হয়। উত্তর-আধুনিকতা তাত্তি্বক ধারণাটির মূলকথা হলো আধুনিককালে যে মার্কসিজমের ধ্যানধারণা বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছিল, সেটার সমাপ্তি হয়েছে আধুনিককাল উত্তরিত হওয়ায়। অন্যদিকে উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব হাজির করা হয়েছে ঔপনিবেশককালের ধারণাগুলো চলমান রাখার জন্য। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে ও পদানত দেশগুলোকে এবং সেসব দেশের জনগণকে হেয় প্রতিপন্ন করত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী উপনিবেশকাল শেষেও অতীতের উপনিবেশ দেশগুলো এখনো ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে পদানতই আছে। এটাকে নিশ্চিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নিও-কলোনিয়ালিজম ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছে। তাতে অনেক দেশ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়, সামাজিক পরিবর্তনে এবং অন্তর্বর্তী শাসনকার্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কাছে নতি স্বীকার করে থাকে। এমনকি আরো নতুনতর ধারণা বিশ্বায়ন (গ্লোবালাইজেশন) নিয়ে এসে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু এটা উত্তর-ঔপনিবেশিকতার পরিমার্জিত সংস্করণ কিংবা সেটার পরিবর্তে চালু করা হচ্ছে কি না তা খুব একটা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের মতো আরো অনেক দেশ বিশ্বায়নের অংশীদার হলে তারা কি আর উত্তর-ঔপনিবেশিক হওয়া থেকে রেহাই পাবে?
উত্তর-আধুনিকতা ও উত্তর-ঔপনিবেশিকতা- এ দুই ধারণা বা ভাবনা যে কতটা ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যমূলক, তা বিদগ্ধ ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন। বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে প্রায়ই উত্তর-ঔপনিবেশিকতার ধূম্রজাল কেন সৃষ্টি করা হয় তা বোঝা মুশকিল। এক হতে পারে, যাঁরা এই কাজটা করেন, তাঁরা নিজেরাই হীনম্মন্যতায় ভুগছেন।
অনেকে যা বুঝতে চান না, সেটা হলো বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য স্টাইলে চালিত বাঙালির জীবনযাপনের বর্ণনা কিংবা পাশ্চাত্যের নারীবাদ তত্ত্বের আনাগোনাকে উত্তর-ঔপনিবেশিকতা বলা যায় না। সাম্রাজ্যলোভী দেশগুলো তাদের উপনিবেশগুলোর শতসহস্র ক্ষতি করেছে, কিন্তু কিছু প্রাপ্তি যে তাদের কাছ থেকে আসেনি, সে কথা অস্বীকার করি কী করে? উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই উপমহাদেশে বিবিধ ধরনের নারী নিগ্রহ বন্ধ করতে দৃঢ়ভাবে কাজ করে গেছে এবং সেই কাজে তারা অনেক ভারতীয়র সহায়তা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদেরই আরেক অবদান নারীশিক্ষা। চলতি সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সতীদাহ সমর্থন করে না, বিধবাবিবাহ সমর্থন করে, কিন্তু মুসলমানদের অনেকেই ফতোয়া দিয়ে নারী নিগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছে। এর কোনোটাকেই উত্তর-ঔপনিবেশিক বলা যায় না। ফলে সাম্রাজ্যবাদ-সমর্থক পাশ্চাত্যের একাডেমিক লেখক (যেমন- ফ্রেডরিক জেমসন) তৃতীয় বিশ্ব নিয়ে যে আবোলতাবোল বকছেন, তা ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই মঙ্গল। তৃতীয় বিশ্বে পারিবারিক পরিমণ্ডল নিয়ে রচিত সাহিত্যে 'জাতিরাষ্ট্র ও শরীরী-রাজনীতির প্রভাব' (জেমসনের কথা) কোনোভাবেই উত্তর-ঔপনিবেশিকতা তত্ত্ব সমর্থন করে না। আমাদের ক্ষুদ্র সাহিত্যজগৎ এখন আর অতীতে নেই, এই জগৎ অতীত থেকে বেরিয়ে এসে এখন বাস্তবতার জগতে আছে এবং ক্রমান্বয়ে স্বকীয়তা অর্জন করছে। পুরুষতন্ত্র-সমর্থক সমাজকে ভেঙে ফেলছে বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার বা বাণিজ্যের অর্থনীতি। নারী ছাড়া পুরুষরা এগোতে পারছে না, পারবেও না- এই উপলব্ধি এসেছে উত্তর-ঔপনিবেশিকতা ছাড়াই।
একটা কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে উত্তর-আধুনিকতা তত্ত্বের (অর্থাৎ মার্কসবিরোধী ভাবনা) সমর্থকদের মধ্যে আমাদের সৃজনশীল লেখকের সংখ্যা অনেক। অনেকে অজ্ঞানে, আবার অনেকে সজ্ঞানে এই তত্ত্ব মানেন। তবে সেই তত্ত্বের বিরোধী মননশীল লেখক ও তাঁদের পাঠকসংখ্যা মোটেই কম নয়- তারা বিভিন্নভাবে প্রমাণ করে দিচ্ছে যে উত্তর-আধুনিকতার তত্ত্ব ভুল।
আধুনিক সময়ের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও অর্থনীতি বা রাজনীতির যে প্রভাব বিশ্বকে আলোড়িত করেছে এবং নতুন নতুন দিক দর্শন করিয়েছে, সেসবের সুবাতাস মাঝেমধ্যে সাম্রাজ্যবাদের অতর্কিত ও পরিকল্পিত হামলায় এলোমেলো হলেও সেই সময় এখনো পার হয়ে যায়নি। তবে উত্তর-ঔপনিবেশিকতা তত্ত্ব অচল হয়ে গেছে, কারণ তত্ত্বগতভাবে উত্তর-ঔপনিবেশিকতা ও মূল ঔপনিবেশিকতায় কোনো পার্থক্য করা হয়নি। সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিন্তু এই তত্ত্ব একেবারেই চলে না। শত শত বর্ষব্যাপী বেশ কিছু কালজয়ী সাহিত্য বাঙালির তো আছেই, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এখন উঠে আসছে নতুন নতুন বিশ্বজয়ী সাহিত্য। আশা জাগে পাশ্চাত্যের নিও-কলোনিয়ালিজম অভিসন্ধি সর্বত্র সফল হবে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক

No comments

Powered by Blogger.