হলমার্ক কেলেঙ্কারি-সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ

সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে কারসাজির মাধ্যমে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার ঘটনা প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ায় পরিচালনা পর্ষদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এ চিঠি লেখা


হয়েছে। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এই চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্রটি জানিয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের বড় ধরনের এই জালিয়াতির ঘটনা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ সঠিকভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে ব্যাংকটির আমানতকারীদের স্বার্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ কারণে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের সংকট আর সৃষ্টি না হয়, সেই জন্য এখনই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন প্রয়োজন। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন-সংক্রান্ত কার্যাদি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে চিঠিটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তাও চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সোনালী ব্যাংকের ২৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর নতুন করে কাউকে বরখাস্ত করেনি সোনালী ব্যাংক। এ বিষয়ে গত রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সোনালী ব্যাংককে একটি চিঠি দেওয়া হয়।
হলমার্কসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে একটি মাত্র শাখা থেকে তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা বের করে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ায় প্রধান কার্যালয় ও রূপসী বাংলা শাখার বিভিন্ন পর্যায়ের ৩২ জন কর্মকর্তার জড়িত থাকার সত্যতা মিলেছে। ব্যাংকটির সর্বশেষ ফাংশনাল অডিটের বরাত দিয়েই চিঠিটি তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের শেরাটন হোটেল (বর্তমানে রূপসী বাংলা) শাখায় সংঘটিত এ জালিয়াতির সঙ্গে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৩২ জন কর্মকর্তা জড়িত। তাঁদের মধ্যে শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল হাসানকে আগেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর অবসরে গেছেন। এই অবস্থায় বাকি ২৯ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তাঁদের মধ্যে আছেন মহাব্যবস্থাপক ননী গোপাল নাথ, মীর মাহিদুর রহমান, নওশের আলী খন্দকার, মো. মাহবুবুল হক, আলী হোসেন খান, উপ-মহাব্যবস্থাপক সবিতা সিরাজ, মোহাম্মদ মুছা, শেখ আলতাফ হোসেন, নেসাব আহমেদ চৌধুরী, সহকারী মহাব্যবস্থাপক গোলাম নবী মল্লিক, আশরাফ আলী পাটোয়ারী, মো. সাফিজ উদ্দিন আহমেদ, এজাজ আহমেদ, শামীম আক্তার, ঊর্ধ্বতন নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহেদ উদ্দিন আহমেদ, মুখলেসুর রহমান, শাহিদা খানম, সোহরাব হোসেন, নির্বাহী কর্মকর্তা একরামুল হক মণ্ডল ও শাখা পরিদর্শক কামরুল হোসেন খান। এ ছাড়া রূপসী বাংলা শাখার নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উজ্জ্বল কিশোর ধর, তুষার কান্তি দাশ, জেসমিন নাহার, মিহির চন্দ্র মজুমদার, কনিষ্ঠ কর্মকর্তা ওয়াকিলউদ্দিন আহমেদ ও কর্মকর্তা সাইদুর রহমানকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চিঠিতে সাময়িক বরখাস্ত করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রণয়ন করে চাকরিবিধি মোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। পাক্ষিক ভিত্তিতে এর অগ্রগতিও বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে গতকাল সোমবার পর্যন্ত নতুন করে আর কোনো কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার খবর পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে গত রবিবার সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, তাঁরা ইতিমধ্যে অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ শুরু করেছেন। তবে গতকাল সোমবার বিকেলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত নতুন করে কাউকে বরখাস্ত করা হয়নি।
সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা দুদকে ধরনা দিচ্ছেন
সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা হোটেল শাখার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ৩১ জনকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করার পর নড়েচড়ে বসেছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ। দুদকের মামলায় যেন আসামি করা না হয় সে লক্ষ্যে তাঁরা এখন দৌড়ঝাঁপ করছেন। ইতিমধ্যেই সোনালী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা দুদক কর্মকর্তাদের কাছে যোগাযোগ করেন বলে জানা গেলেও দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান মাত্র একজনের কথা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন।
গতকাল সোমবার বিকেল ৪টার দিকে এই প্রতিবেদকও সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা ননী গোপাল নাথকে দুদকে ছোটাছুটি করতে দেখেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সোমবার বিকেলে সোনালী ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার ননী গোপাল নাথ তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। এ সময় ননী গোপাল নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন তাঁকে যেন মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়।
জানা যায়, দুদক চেয়ারম্যান ননী গোপালকে এ বিষয়ে দুদকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ননী গোপাল পরে ওই কর্মকর্তার কাছে গিয়ে একই অনুরোধ করলে তাঁকে তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে কাগজপত্র দুদকে জমা দিতে বলা হয়।
জানা গেছে, ননী গোপাল দুদকের কর্মকর্তাদের বলেন, তিনি রূপসী বাংলা হোটেল শাখার বিষয়টি প্রথমে ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নজরে আনেন এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে চিঠি লেখেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
এদিকে সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে শুধু হলমার্কই নয়, টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত আরো পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক। তদন্তের স্বার্থে দুদক এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নিয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবিশেষ আর ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। অন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ডিএন স্পোর্টস, প্যারাগন নিট কম্পোজিট, টি অ্যান্ড ব্রাদার্স গ্রুপ, নকশী নিট কম্পোজিট ও খান জাহান আলী সোয়েটার্স।
দুদক জানিয়েছে, তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত ছয় প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য জানতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.