হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ-স্পিকারের রুলিং ভিত্তিহীন অকার্যকর অসংগতিপূর্ণ
'একজন বিচারক সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছেন এবং এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি ভেবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন'- জাতীয় সংসদের স্পিকারের এই রুলিংয়ের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে স্পিকারের ওই রুলিং আইনগতভাবে অকার্যকর বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
আদালত বলেছেন, সড়ক ভবনের মামলায় সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। মাননীয় বিচারক সংসদের কোনো কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে তাঁর আদালতে বা কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন তুলেছেন- এমন কিছুও স্পিকারের রুলিংয়ে নেই। এমনকি সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে কোনো মামলা দায়ের বা বিচারাধীন থাকার বিষয়টি স্পিকার তাঁর রুলিংয়ে বলেননি। সুতরাং সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদের কোনো লঙ্ঘন হয়নি। স্পিকারের রুলিং সংবিধানের ৯৬(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ রুলিং সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির সঙ্গেও অসংগতিপূর্ণ।
রায়ে আরো বলা হয়, রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ যাতে সংবিধানে দেওয়া ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন না করে, তা দেখার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের।
বিশেষ অধিকারের সীমা সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে। এই ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের। জাতীয় সংসদ তার এই বিশেষ অধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচারক হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারে না।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ বি এম আলতাফ হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন। গত ২৪ জুলাই আদালত এই রায় দিলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন গতকাল সোমবার। ২৪ জুলাই আদালত স্পিকারের রুলিংয়ের বৈধতা নিয়ে দায়ের করা রিট আবেদন কিছু অভিমতসহ নিষ্পত্তি করে রায় দিয়েছিলেন। গতকাল রায় প্রকাশের পর তা সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপক্ষের কেঁৗসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়। তিনি বলেন, এ রায় যুগান্তকারী। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচার বিভাগ ও সংসদের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ নিয়ে এর আগে কোনো রায় হয়নি।
রায়ে সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, মাননীয় বিচারপতি সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করেছেন, এটি বলা যায় কি? সংবিধানের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে কোনো মামলা দায়ের করা হলেই কেবল সংশ্লিষ্ট মামলাটি সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদে বাধা হিসেবে উল্লেখ করার সুযোগ আছে।
সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, 'সুপ্রিম কোর্টের ও অন্যান্য বিচারকগণ সংসদের সমালোচনা থেকে মুক্ত। বিচারকদের বিষয়ে সংসদের অপ্রত্যাশিত বিষয়ে আলোচনা করা যাবে না। বিচারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একজন বিচারকের আচরণ সংসদের বিবেচনাধীন বিষয় হতে পারে না। সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধির বিধান অবজ্ঞা করে এ ধরনের আলোচনা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।' রায়ে বলা হয়, 'আমাদের আইন প্রণেতাদের নিঃসন্দেহে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এই ক্ষমতা সংবিধানে দেওয়া এখতিয়ারের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে আইন প্রণেতাদের স্বাধীনতা। সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতার জন্য এই স্বাধীনতা প্রয়োজন।'
রায়ে বলা হয়, 'আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের। নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার। বিচারিক ক্ষমতা আদালতের। তিনটি অঙ্গের প্রতিটিকে অন্য অঙ্গের বিষয়ে বিধান লক্ষ্য রেখে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে হবে। স্বাভাবিক কার্য পরিচালনার স্বার্থে একটি অঙ্গকে অন্য অঙ্গ থেকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে না। রাষ্ট্রের সব অঙ্গ তাদের কর্তৃত্ব, এখতিয়ার ও ক্ষমতা সংবিধান থেকে প্রাপ্ত। সংবিধান হচ্ছে এই তিনটি অঙ্গের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যদি কোনো অঙ্গ তার ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে, তাহলে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ তার বিচারিক বিবেচনার ক্ষমতা আদালতের ওপর ন্যস্ত করেছে। সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ দ্বারা সুরক্ষিত। ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ বিষয়ে ব্যাখ্যাকারীও বিচার বিভাগ। তাই আইন প্রণেতাদের বিচারিক ক্ষমতা গ্রহণ অসাংবিধানিক। সংবিধানের ৯৪ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ও বিচারকগণ বিচারিক ক্ষেত্রে স্বাধীন।'
রায়ে আরো বলা হয়, 'আইনসভা ও বিচার বিভাগ এই দুটি অঙ্গ সংবিধানের সৃষ্টি। আইনসভা ও বিচার বিভাগ এই দুটি অঙ্গসহ নির্বাহী বিভাগ বিদ্বেষপ্রসূত না হয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করা উচিত। বিচার বিভাগ ও সংসদ- রাষ্ট্রের এই দুটি অঙ্গের মধ্যে সমঝোতা ও ঐক্য গোটা জাতির জন্য প্রত্যাশিত। স্পিকার নিজেই পর্দা টেনে দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে তার ইস্যু সৃষ্টি করা কাম্য হতে পারে না।' রায়ে বলা হয়, 'স্পিকার বলেছেন, মহামান্য আদালতের প্রতি আমাদের সবার শ্রদ্ধা আছে। আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে রয়েছে ৪০ বছর ধরে গড়ে ওঠা গভীর সম্প্রীতি ও আস্থার সম্পর্ক। পারস্পরিক এ সুসম্পর্কের কারণেই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এ দেশটি আজ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এবং স্পিকার হিসেবে সব সময় বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একে অন্যের পরিপূরক এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন। এ ক্ষেত্রে কর্মপদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে কিন্তু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে এক এবং তা সর্বাবস্থায় জনগণের কল্যাণ সাধন। দেশ ও জাতির কল্যাণে এ সম্পর্ক অটুট হোক, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।'
রায়ে বলা হয়, 'সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়েছে। জনগণ সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সংবিধানের সীমার মধ্যে থেকে সংসদকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।'
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়, 'একজন বিচারক শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তাঁর পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে অযোগ্য হয়ে পড়তে পারেন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন- এমন তথ্য পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে এবং এর ফল জানানোর জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। কাউন্সিল যদি তদন্তে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ওই বিচারক দায়িত্ব পালনে অযোগ্য হয়েছেন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হয়েছেন তাহলে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করবেন।'
রায়ে বলা হয়, 'সংবিধানের ৯৪ (৪) ও ১১৬ ক অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে মূল স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং একে ধ্বংস করা যায় না। সংবিধানের ৯৪ (৪) অনুচ্ছেদ এবং কার্যপ্রণালি বিধি সংসদ সদস্যদের বাকস্বাধীনতার ওপর সীমা আরোপ করেছে। আমাদের দেশে আইন প্রণেতারা সংবিধান ও সাংবিধানিক আদালতের দ্বারা বাধ্য। সাংবিধানিক আদালত সংসদের প্রণীত আইনকে অসাংবিধানিক হলে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে।'
পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের ফারুক আহমেদ লেঘারী বনাম ফেডারেশন অব পাকিস্তান মামলার বরাত দিয়ে রায়ে বলা হয়, 'সংবিধান একটি জীবিত বৃক্ষের মতো। দেশ ও জনগণের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময়ের বিবর্তনে এটি বেড়ে ওঠে ও ফুলে ভরে ওঠে।' রায়ে আরো বলা হয়, আইন আদালতের দায়িত্ব হলো কী সঠিক তা খুঁজে বের করে নির্দ্বিধায় তা বলা।
সড়ক ভবন নিয়ে আদালত অবমাননা মামলায় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ৫ জুনের মধ্যে ব্লক সি-এর বাকি অংশ ও ব্লক এ-এর দুটি কক্ষ সুপ্রিম কোর্টকে হস্তান্তর করতে ১৪ মে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। এ আদেশ নিয়ে গত ২৯ মে সংসদে আলোচনা হয়। এ আলোচনায় জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ কিছু মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, 'দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন, এটি ভালো দেখায় না। আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে।'
৫ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ স্পিকারের এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। সংসদে স্পিকারের বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অভিহিত করে হাইকোর্ট বলেন, 'এটা হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাঁর বক্তব্য আদালত অবমাননাকর। ওই পদে থাকার অধিকার তাঁর নেই।'
আদালতের এ মন্তব্যের পর ওই দিন সন্ধ্যায় সংসদে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন সরকারদলীয় কয়েকজন সংসদ সদস্য। তাঁরা বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাঁকে অপসারণের দাবি জানান।
এ অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না হওয়ার পক্ষে মত দেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। পরে ১৮ জুন স্পিকার রুলিং দেন। রুলিংয়ে তিনি বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি প্রত্যাহারের জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'একজন বিচারপতি সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন করেছেন।' এ বিচারপতির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার ভার প্রধান বিচারপতির ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি বলেন, 'মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে।'
এ অবস্থায় ওই রুলিংয়ের দুটি অংশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এ কে এম শফিউদ্দিন হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন। আবেদনকারী পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আখতার ইমাম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়।
গত ১৮ জুলাই এ রিট আবেদনের ওপর বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের বেঞ্চ শুনানি গ্রহণে বিব্রতবোধ করেন। এরপর রিট আবেদনটি বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে উপস্থাপন করে শুনানি করা হয়।
No comments