পদ্মা সেতু প্রকল্প-অর্থমন্ত্রী বুধবার বিবৃতি দেবেন-বিশ্বব্যাংককে আর চিঠি নয়!
দিন দুয়েক আগেও অর্থমন্ত্রীর মুখে যে স্বস্তির ছাপ ছিল, রবিবার থেকে তা আর নেই। শনিবার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার আশার বাণী শোনানোর পরের দিনই দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ায় যেন ভাষা হারিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়টি গতকাল সোমবারও মুহিত সাংবাদিকদের কাছে খোলাসা করেননি। 'আই অ্যাম নট রেডি' মন্তব্য করে গতকাল তিনি শুধু এটুকু বলেছেন, এ নিয়ে বুধবার বিবৃতি আসছে।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা গুরেরো বরাবর যে চিঠিটি অর্থমন্ত্রী লিখেছিলেন, তার ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতও নেওয়া হয়েছিল। জানা গেছে, চিঠিটি আর পাঠানোরও কোনো উদ্যোগ নেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের। ওই চিঠির একটি অনুলিপি সংস্থাটির ঢাকা অফিসের প্রধান অ্যালেন গোল্ডস্টেইনকেও পাঠানোর কথা ছিল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, যেহেতু অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের আগ্রহ নেই, তাই সরকারও এখন আর ওই চিঠি দেওয়ার কথা ভাবছে না।
নিয়মিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে গতকাল সোমবার পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়টি আলোচনা হবে, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের দিকনির্দেশনা দেবেন- সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন আশা থাকলেও মন্ত্রিসভায় প্রসঙ্গটি আলোচনায়ই আসেনি বলে জানা গেছে। তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে ওই বৈঠক সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি।
অর্থমন্ত্রী গতকাল সকালে সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে না গিয়ে সরাসরি যোগ দেন মন্ত্রিসভার বৈঠকে। ওই বৈঠকের পর সব মন্ত্রী বের হলেও ভেতরে আলাদাভাবে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। পরে মন্ত্রী চলে আসেন নিজের দপ্তরে।
এ সময় সাংবাদিকরা অর্থমন্ত্রীর কাছে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি না দাঁড়িয়ে অল্প কয়েকটি কথা বলতে বলতেই নিজের রুমে ঢুকে পড়েন। এ সময় মন্ত্রী বলেন, 'আমি আপনাদেরকে একটি স্টেটমেন্ট (বিবৃতি) দেব। তবে আই অ্যাম নট রেডি (আমি প্রস্তুত নই)।' পরে আবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মন্ত্রী বলেন, এই বিবৃতি বুধবার পাওয়া যাবে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে 'নানা কথা শোনা যাচ্ছে' সাংবাদিকদের এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী শুধু বলেন, 'শুনতে থাকুন।'
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে কথা বলতে এইচ টি ইমামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন ও এসএমএস দেওয়া হলেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নিজের ধারণা থেকে বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে অর্থমন্ত্রী যে বিবৃতি দেবেন, সেখানে বিষয়টিকে কিভাবে উপস্থাপন করা হবে, তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করা হতে পারে। ওই কর্মকর্তা জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়ার তেমন কোনো সুযোগই নেই। তাই প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগের বিষয়টিও এখন আর সরকারের আলোচনায় নেই। বরং সরকার দেশবাসীর সামনে দাতা সংস্থাটির অবস্থান কিভাবে তুলে ধরবে, পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকার নতুন কোনো পরিকল্পনা দেশবাসীকে জানাবে কি না- বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
ইআরডির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ৩১ আগস্ট এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সঙ্গে করা ঋণচুক্তি কার্যকরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার তেমন কোনো আশ্বাসের সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। এদিকে ৩১ আগস্টের পর সরকার আবেদন করলেও এডিবি ও জাইকা নতুন করে চুক্তি কার্যকরের মেয়াদ বাড়াবে কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়। আর বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করলেও চুক্তির ১২০ কোটি ডলার এখনো বাংলাদেশের নামেই বরাদ্দ রয়েছে। তবে এডিবি ও জাইকা ঋণচুক্তি বাতিল করলে ওই অর্থ সংস্থা দুটির তহবিলে ফেরত যাবে। ফলে নতুন করে এ দুই সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করা সময়সাপেক্ষ ও দুষ্কর হয়ে পড়বে।
রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশ্বব্যাংক যে পদ্মা সেতুতে আর অর্থায়ন করবে না- সে তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে অর্থমন্ত্রী রবিবারই জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। এর আগে বিশ্বব্যাংকের শর্তমতো প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগের বিষয়টি সামনে আসে। তবে শেষ মুহূর্তে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো মনোভাব না দেখানোর কারণে মসিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হচ্ছে না।
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে অর্থায়ন স্থগিত রাখে। এ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক আকস্মিকভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে। তারপর গত ২৩ জুলাই মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন সৈয়দ আবুল হোসেন। বিদায় দেওয়া হয় সরকারের দুই কর্মকর্তাকেও। অন্য দুই দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ঋণচুক্তি কার্যকরের মেয়াদ বাড়ায়। এ সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ শুরু করে সরকার। এডিবি ও জাইকাও বিশ্বব্যাংকের মন গলানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে। পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়া যাবে- এমন ইঙ্গিত পাওয়ার পরই গত ২২ আগস্ট মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি। বিশ্বব্যাংকের শর্তের মধ্যে কেবল দুটি শর্তই অপূর্ণ থাকে। এর মধ্যে একটি হলো প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগ ও অন্যটি দুদকের তদন্ত কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি সম্পৃক্ত করা। দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ইতিমধ্যেই শেষ শর্তটি মেনে নেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। ড. মসিউর রহমানও বলেছেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়া গেলে পদত্যাগ করতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই।
No comments