একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-জীবন থেকে নেয়া by অনুপম হায়াৎ
মহান ভাষা আন্দোলন ও রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারির চাওয়া-পাওয়ার ঘটনা যে চলচ্চিত্রে প্রকাশিত হয়েছে, সেটি জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)। তৎকালীন সারা পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে (১৯৪৭-১৯৭০) জীবন থেকে নেয়াই একমাত্র ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র, যাতে একটি পারিবারিক কাহিনিনির্ভর মেলোড্রামার আড়ালে সমকালীন রাজনীতি, গণ-আন্দোলন, ছাত্র-আন্দোলন, পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ,
একনায়কতন্ত্র সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। এই চলচ্চিত্রেই প্রথমবারের মতো তুলে ধরা হয়েছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা, নগ্নপদে প্রভাতফেরি-মিছিল, পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানারসহ শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদান ও সমবেত কণ্ঠে অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।
চলচ্চিত্রটি নির্মাণের ক্ষেত্রে জহির রায়হানকে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। উল্লেখ্য, জহির রায়হান ছিলেন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকরী এবং কারাবরণকারী প্রথম ১০ জনের মধ্যে একজন। এ ছাড়া ছিলেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় লিখেছিলেন গল্প ‘পোস্টার’ ও উপন্যাস আরেক ফাগুন। ১৯৬৫-৬৬ সালে একুশে ফেব্রুয়ারী নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রাথমিক কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার সেই চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। ইতিমধ্যেই জহির রায়হান কখনো আসেনি, কাচের দেয়াল, সংগম, বাহানা, আনোয়ারা নামে চলচ্চিত্র প্রযোজনা এবং কয়েকটি ছবিও প্রযোজনা করেছেন। এসব চলচ্চিত্র নির্মাণ করে জহির রায়হান তৃপ্ত হননি। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি একটি ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নেন, যার ফসল জীবন থেকে নেয়া ।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ দেশে আবার সামরিক শাসন চালু হয়। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দেশে শুরু হয় রাজনৈতিক তৎপরতা। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে সামরিক আইন ও সেন্সর বিধি অনুসরণ করেই একটি পারিবারিক ঘটনার আড়ালে জহির রায়হান একুশে ফেব্রুয়ারি ও গণ-আন্দোলন নিয়ে একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। প্রথমে ছবির নাম ঠিক করা হয় তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ, পরিচালনায় নূরুল হক বাচ্চু। কিন্তু এক সপ্তাহ পরই ছবির নাম পাল্টে রাখা হয় জীবন থেকে নেয়া, পরিচালনায় জহির রায়হান। এ ঘটনা ১৯৭০ সালের ২০-২৮ জানুয়ারির। ওই সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে জহির রায়হান বিভিন্ন অনুষ্ঠান, মিছিল, প্রভাতফেরি, সমবেত কণ্ঠে গান, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের চিত্র ধারণ করেন। কাহিনি সাজানো হয় একজন উগ্রচণ্ডী দজ্জালরূপী বড় বোনের অত্যাচারে নির্যাতিত স্বামী, দুই ভাই, দুই ভ্রাতৃবধূ ও চাকরদের নিয়ে। মূলত দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে দুই ভাইয়ের নতুন দুই বউ বাড়িতে আসার পর পারিবারিক কর্তৃত্ব ও চাবির গোছার দখল নিয়ে। স্বৈরাচারের ভূমিকায় বড় বোন।
এ ছবির প্রতিটি চরিত্র, ঘটনা, অভিনয়, সংলাপ, শব্দ, সংগীত ও দৃশ্য সবই রূপক। ছবিতে আনোয়ার হোসেনের চরিত্রটি ওই সময়কার জনপ্রিয় কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রতিনিধিত্বকারী, ছাত্রনেতা ফারুক প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক, মুহরির চরিত্রটি স্বাধীন চেতনার পরিচায়ক আর উগ্রচণ্ডী বড় বোনের (রওশন জামিল) চরিত্রটি স্বৈরশাসক ও একনায়কের প্রতীক (আইয়ুব খান/ইয়াহিয়া খান)।
জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রে ব্যবহূত রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জোগায় এবং জাতীয় সংগীত হিসেবে মর্যাদা পায়। নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ও মুক্তিযুদ্ধে উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে। ইকবালের ‘দাও, দাও, দাও, দুনিয়ার সব জাতিকে আজ জাগিয়ে দাও’ এবং খান আতার ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ বিশ্ব মানবিকতা ও মৌলিক অধিকার এবং চাহিদা পূরণের বাণীতে পুষ্ট। আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানটি বাঙালির শোক ও মুক্তির প্রতীক। এসব গান বাঙালিদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও স্বৈরাচার উচ্ছেদে প্রেরণা জোগায়।
এই চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক নবজাতকের নাম ‘মুক্তি’ রাখা এবং গ্রেপ্তার হয়ে ছাত্রনেতার জেলে আগমনের সময় উচ্চারিত রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী...ক্ষয় নাই’ গভীর তাৎপর্যবাহী। রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনগুলো স্বাধীন বাংলাদেশে স্মৃতিসৌধে উৎকীর্ণ হয়ে চির প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এসবই স্রষ্টা ও শিল্পী জহির রায়হানের কাজ। এভাবেই তাঁর জীবন থেকে নেয়ার প্রতিটি ফ্রেমে বন্দী দৃশ্য ও শব্দ আভাস দিয়েছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী ও মেজর মালেক এবং তাঁদের এদেশীয় দোসররা সেন্সর পর্যায়েও এ ছবির ছাড়পত্র না দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক সচেতন দর্শকদের মিছিল, স্লোগান ও দাবির মুখে সামরিক সরকার বাধ্য হয়েছিল এ ছবির ছাড়পত্র দিতে। তবে জীবন থেকে নেয়া মুক্তি পেয়েছিল নির্ধারিত তারিখের এক দিন পর অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল। শেষ পর্যন্ত জনতাই হয়েছিল জয়ী। জীবন থেকে নেয়ার মাধ্যমে এভাবেই তৈরি হয়েছিল ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়।
চলচ্চিত্রটি নির্মাণের ক্ষেত্রে জহির রায়হানকে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। উল্লেখ্য, জহির রায়হান ছিলেন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকরী এবং কারাবরণকারী প্রথম ১০ জনের মধ্যে একজন। এ ছাড়া ছিলেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় লিখেছিলেন গল্প ‘পোস্টার’ ও উপন্যাস আরেক ফাগুন। ১৯৬৫-৬৬ সালে একুশে ফেব্রুয়ারী নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রাথমিক কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার সেই চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। ইতিমধ্যেই জহির রায়হান কখনো আসেনি, কাচের দেয়াল, সংগম, বাহানা, আনোয়ারা নামে চলচ্চিত্র প্রযোজনা এবং কয়েকটি ছবিও প্রযোজনা করেছেন। এসব চলচ্চিত্র নির্মাণ করে জহির রায়হান তৃপ্ত হননি। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি একটি ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নেন, যার ফসল জীবন থেকে নেয়া ।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ দেশে আবার সামরিক শাসন চালু হয়। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দেশে শুরু হয় রাজনৈতিক তৎপরতা। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে সামরিক আইন ও সেন্সর বিধি অনুসরণ করেই একটি পারিবারিক ঘটনার আড়ালে জহির রায়হান একুশে ফেব্রুয়ারি ও গণ-আন্দোলন নিয়ে একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। প্রথমে ছবির নাম ঠিক করা হয় তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ, পরিচালনায় নূরুল হক বাচ্চু। কিন্তু এক সপ্তাহ পরই ছবির নাম পাল্টে রাখা হয় জীবন থেকে নেয়া, পরিচালনায় জহির রায়হান। এ ঘটনা ১৯৭০ সালের ২০-২৮ জানুয়ারির। ওই সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে জহির রায়হান বিভিন্ন অনুষ্ঠান, মিছিল, প্রভাতফেরি, সমবেত কণ্ঠে গান, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের চিত্র ধারণ করেন। কাহিনি সাজানো হয় একজন উগ্রচণ্ডী দজ্জালরূপী বড় বোনের অত্যাচারে নির্যাতিত স্বামী, দুই ভাই, দুই ভ্রাতৃবধূ ও চাকরদের নিয়ে। মূলত দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে দুই ভাইয়ের নতুন দুই বউ বাড়িতে আসার পর পারিবারিক কর্তৃত্ব ও চাবির গোছার দখল নিয়ে। স্বৈরাচারের ভূমিকায় বড় বোন।
এ ছবির প্রতিটি চরিত্র, ঘটনা, অভিনয়, সংলাপ, শব্দ, সংগীত ও দৃশ্য সবই রূপক। ছবিতে আনোয়ার হোসেনের চরিত্রটি ওই সময়কার জনপ্রিয় কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রতিনিধিত্বকারী, ছাত্রনেতা ফারুক প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক, মুহরির চরিত্রটি স্বাধীন চেতনার পরিচায়ক আর উগ্রচণ্ডী বড় বোনের (রওশন জামিল) চরিত্রটি স্বৈরশাসক ও একনায়কের প্রতীক (আইয়ুব খান/ইয়াহিয়া খান)।
জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রে ব্যবহূত রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জোগায় এবং জাতীয় সংগীত হিসেবে মর্যাদা পায়। নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ও মুক্তিযুদ্ধে উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে। ইকবালের ‘দাও, দাও, দাও, দুনিয়ার সব জাতিকে আজ জাগিয়ে দাও’ এবং খান আতার ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ বিশ্ব মানবিকতা ও মৌলিক অধিকার এবং চাহিদা পূরণের বাণীতে পুষ্ট। আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানটি বাঙালির শোক ও মুক্তির প্রতীক। এসব গান বাঙালিদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও স্বৈরাচার উচ্ছেদে প্রেরণা জোগায়।
এই চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক নবজাতকের নাম ‘মুক্তি’ রাখা এবং গ্রেপ্তার হয়ে ছাত্রনেতার জেলে আগমনের সময় উচ্চারিত রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী...ক্ষয় নাই’ গভীর তাৎপর্যবাহী। রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনগুলো স্বাধীন বাংলাদেশে স্মৃতিসৌধে উৎকীর্ণ হয়ে চির প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এসবই স্রষ্টা ও শিল্পী জহির রায়হানের কাজ। এভাবেই তাঁর জীবন থেকে নেয়ার প্রতিটি ফ্রেমে বন্দী দৃশ্য ও শব্দ আভাস দিয়েছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী ও মেজর মালেক এবং তাঁদের এদেশীয় দোসররা সেন্সর পর্যায়েও এ ছবির ছাড়পত্র না দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক সচেতন দর্শকদের মিছিল, স্লোগান ও দাবির মুখে সামরিক সরকার বাধ্য হয়েছিল এ ছবির ছাড়পত্র দিতে। তবে জীবন থেকে নেয়া মুক্তি পেয়েছিল নির্ধারিত তারিখের এক দিন পর অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল। শেষ পর্যন্ত জনতাই হয়েছিল জয়ী। জীবন থেকে নেয়ার মাধ্যমে এভাবেই তৈরি হয়েছিল ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়।
No comments