ঢাকা চিড়িয়াখানার ৫৩ একর জমি চান সরকারদলীয় সাংসদ-১০ ‘চিড়িয়াখানায়’ বন্য প্রাণীর অবৈধ সংগ্রহ by ইফতেখার মাহমুদ

বন্য প্রাণীর প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও কারিগরি আয়োজন ছাড়াই দেশে বেসরকারি ১০টি কথিত চিড়িয়াখানায় অবৈধভাবে রাখা হয়েছে বেশ কিছু বিপন্নপ্রায় প্রাণী। তারা এসব প্রাণী সংগ্রহও করছে চোরাই বাজার থেকে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী, কোনো বন্য প্রাণী সংগ্রহ করা, কেনা, আটকে রাখা ও প্রদর্শন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি বেসরকারিভাবে চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়ারও বিধান নেই।


এই অবস্থায় সরকার বিদ্যমান বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়ার বিধান রেখে ‘বাংলাদেশ চিড়িয়াখানা আইন’ নামে নতুন আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আইন পাস হওয়ার আগেই চারটি প্রতিষ্ঠান চিড়িয়াখানা করার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: মিরপুর এলাকার সরকারদলীয় সাংসদ আসলামুল হকের প্রতিষ্ঠান মাইশা গ্রুপ, নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খবির উদ্দিন ভূঁইয়ার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সোনাইমুড়ী অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স লিমিটেড, দিনাজপুরের আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমানের ভাই ও ছেলের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্বপ্নপুরি ও কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড। এই কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হলেন কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবুল বাসার। এই সংগঠনটি ইতিমধ্যে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ সড়কে একটি চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছে।
এর মধ্যে সাংসদ আসলামুল হকের প্রতিষ্ঠান মাইশা গ্রুপ ‘অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’ ও চিড়িয়াখানা স্থাপনের জন্য ঢাকা চিড়িয়াখানার ৫৩ একর ভূমি ইজারা চেয়ে আবেদন করেছে। এর ৩৫ একর সমতল ভূমি ও ১৮ একর জলাশয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব ছোট ছোট চিড়িয়াখানা স্থাপিত হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিতেই বন্য প্রাণীর প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল নেই।
বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ও দুবাই চিড়িয়াখানার উপদেষ্টা রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে সরকারি চিড়িয়াখানাগুলোই সঠিকভাবে চলছে না। বেসরকারি খাতে চিড়িয়াখানা স্থাপন একটি বিশাল আয়োজন ও ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ জন্য কারিগরি জ্ঞান আছে, এমন জনবল দক্ষিণ এশিয়াতে খুব কম। তাঁর মতে, বন্য প্রাণীর প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও কারিগরি আয়োজন ছাড়া চিড়িয়াখানা স্থাপন করতে দেওয়া ঠিক হবে না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আশরাফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, চিড়িয়াখানা আইন ও বিধিমালা তৈরির পর বেসরকারি খাতে ‘মিনি চিড়িয়াখানা’ স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন বনভূমি ও জলাশয় থেকে অবৈধভাবে বন্য প্রাণী ধরে রাজধানীর কাঁটাবন ও কাপ্তানবাজার, টঙ্গী, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে এনে বিক্রি করা হয়। এসব বন্য প্রাণীর বড় অংশ বেসরকারি কথিত চিড়িয়াখানাগুলো কিনে থাকে।
অভিযোগ রয়েছে, এভাবে বন্য প্রাণী সংগ্রহ করে কেউ কেউ তা বিদেশে পাচারের সঙ্গেও জড়িত আছেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, বন্য প্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস, অবৈধভাবে বন্য প্রাণী শিকার ও ধরে বিক্রি করায় দেশ থেকে অনেক প্রাণী বিলুপ্তির পথে রয়েছে। বন্য প্রাণীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের (ডব্লিউডব্লিউএফ) এক সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর বন্য প্রাণীর বেচাকেনা বাবদ প্রায় ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জৈব সুরক্ষা ও পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা ছাড়াই এসব কথিত চিড়িয়াখানায় রাখা বিপন্নপ্রায় অনেক বন্য প্রাণী মারা যাচ্ছে।
প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুছ মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, বন্য প্রাণী রাখার অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নেই। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কেউ ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বন্য প্রাণী রাখতে পারেন না। তাঁদের কাছ থেকে এসব কথিত চিড়িয়াখানার কেউ অনুমতি নেয়নি।
কথিত চিড়িয়াখানাগুলো: নড়াইলের লোহাগড়ায় পিকনিকস্থল ‘নিরিবিলি’তে গড়ে তোলা কথিত চিড়িয়াখানায় ভালুক, কুমির, হরিণ, মদনটাক পাখিসহ ১৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে। এর মালিক হলেন মহাজোট সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টির (এরশাদ) নড়াইল জেলা শাখার সহসভাপতি সৈয়দ মফিজুর রহমান।
জানতে চাইলে সৈয়দ মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার যদি মনে করে আমাদের চিড়িয়াখানায় বন্য প্রাণী রাখা অপরাধ, তাহলে তা বন্ধ করে দিক।’
সাতক্ষীরা শহরের অদূরে গড়ে ওঠা ‘মোজাফফর গার্ডেন’ একটি বিনোদন পার্ক। এখানে ৪০ প্রজাতির শতাধিক বন্য প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে বিপন্নপ্রায় প্রাণীও রয়েছে।
জানতে চাইলে বিনোদনকেন্দ্রটির পরিচালক নুর হোসেন দাবি করেন, বন ও গ্রাম থেকে লোকজন বন্য প্রাণী ধরে নিয়ে এলে, তাঁরা তা কিনে থাকেন।
নরসংদীর শিবপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা সোনাইমুড়ী পার্কে বানর, হনুমান, হরিণসহ বেশ কিছু বন্য প্রাণী আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি খবিরউদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘এই পার্কে একটি চিড়িয়াখানা গড়ে তোলা আমার অনেক দিনের শখ।’
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে রয়েছে সীতেশ দেবের বন্য প্রাণী অভয়াশ্রম। এই আশ্রমেও শতাধিক বন্য প্রাণী রয়েছে। জাতীয় সংসদের হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ কিছুদিন পরপর ওই আশ্রম থেকে বন্য প্রাণী লাউয়াছড়া বনে অবমুক্ত করেন।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় বিনোদনকেন্দ্র রাসেল পার্কেও রয়েছে একটি কথিত চিড়িয়াখানা। পার্কটির ব্যবস্থাপক আবু সাইদ বলেন, ৪২ প্রজাতির প্রাণী ছিল। এসব প্রাণী তাঁরা ঢাকার কাঁটাবনসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কিনেছিলেন। বেশির ভাগ মারা যাওয়ায় এখন আর নতুন প্রাণী আনা হয়নি।
গাজীপুরের কাশিমপুরে দুলাল ব্রাদার্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জিন্নাত অ্যাপারেলসের কারখানার ভেতরেও একটি ‘মিনি চিড়িয়াখানা’ করা হয়েছে। সেখানে রাজধনেশ, নীল ময়ূরসহ ১৪ প্রজাতির পাখি, হরিণ, বানর ও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী আছে।
দুলাল ব্রাদার্সের চেয়ারম্যান এম এ ওয়াহেদ বলেন, কর্মচারীদের সন্তান ও বন্ধুবান্ধবদের বিনোদন দিতে শখ করে চিড়িয়াখানাটি গড়ে তুলেছেন। সরকারের অনুমোদন পেলে সেখানে আরও বন্য প্রাণী আনা হবে বলে তিনি জানান।
ঢাকা চিড়িয়াখানার ৫৩ একর ভূমি চান সাংসদ: ঢাকা-৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হকের মাইশা গ্রুপ ও মালয়েশিয়ার কোবেডা গ্রুপ যৌথভাবে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত ঢাকা চিড়িয়াখানার ভেতরে ‘অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’ করতে চায়। এ জন্য চিড়িয়াখানার ৩৫ একর ভূমি ও ১৮ একর জলাশয় ইজারা চেয়ে তারা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে।
মাইশা গ্রুপ বলছে, এই পার্ক স্থাপনের জন্য প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মনোনীত প্রতিনিধিদলকে ইংল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়াসহ অন্যান্য খাতে তারা ১০ কোটি টাকা খরচ করেছে।
মাইশা গ্রুপের চেয়ারম্যান সাংসদ আসলামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অনেক দূর এগোনোর পর এখন মন্ত্রণালয় কোনো জবাব দিচ্ছে না। তিনি বলেন, তাঁরা এরই মধ্যে মিরপুর এলাকায় ‘অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’ স্থাপনের প্রাথমিক কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন। সেখানে ডলফিনও রাখা হবে বলে তিনি দাবি করেন।
{এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা, গাজীউল হক, কুমিল্লা, কার্ত্তিক দাস, নড়াইল, আসিফ হোসেন, নারায়ণগঞ্জ, মাসুদ রানা, (গাজীপুর) কালিয়াকৈর}

No comments

Powered by Blogger.