সপ্তাহের হালচাল-প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক নীতিকৌশল by আব্দুল কাইয়ুম

রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একবার বলেছিলেন, বাঘে ধরলে ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়েন না। কথাটা অনেক ক্ষেত্রে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু গত শনিবার তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে ঘোষণা দিয়ে বললেন যে কয়লা উত্তোলন করা ঠিক হবে না। আমাদের দেশের ঘনবসতি এলাকায় খনি খুঁড়তে গেলে অনেক সমস্যা হয়, প্রাণহানি হয়।
তাই কয়লাখনি বন্ধ রেখে বরং আমদানি করাই ভালো। তাহলে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রী নির্দয়ভাবে কোনো কিছু আঁকড়ে থাকেন না। মানুষের কথাটা তাঁর চিন্তায় গুরুত্ব পায়। না হলে কয়লাখনির কাজ বন্ধ রাখলেন কেন?
এর আগেও দেখেছি, আড়িয়ল বিলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা তিনি হঠাৎ একদিন বাতিল করে দিলেন। বললেন, মানুষ যখন চায় না, হবে না। সেখানেও প্রমাণ করলেন, তাঁর পরিকল্পনায় ও কাজে তিনি মানুষকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার চেষ্টা করেন। অবশ্য সব ব্যাপারে তিনি এটা করেন না বা করতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রেই দলের বা সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেন। যে কারণে অনেকে তাঁকে বলেন একরোখা। যেটা তিনি ঠিক মনে করেন, সেটা করে ছাড়েন। এবং এ জন্য কখনো কখনো তাঁর নিজের ও সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়। কিন্তু কয়লা বা আগের বিমানবন্দর পরিকল্পনার ঘটনা দুটিকে যদি ব্যতিক্রম হিসেবেও দেখি, মন্দ কী? ফুলবাড়ী কয়লাখনি এলাকায় কয়লা-আতঙ্কে যে মানুষগুলো ভুগছিল, তারা বাঁচল তো!
এ ঘটনাকে ঠিক কয়লানীতি হিসেবে না দেখে ‘রাজনৈতিক কৌশল’ অথবা নীতিগত অবস্থান হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ, কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ তৈরি করা দেশের জন্য লাভজনক, নাকি খনি থেকে ওঠানো বেশি লাভজনক, সে তর্কে গেলে হয়তো বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলবেন, শেখ হাসিনা ভুল করছেন। দেশের ক্ষতি হবে। অনেক বেশি টাকা লাগবে। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এত কয়লা আনাই যাবে না, ইত্যাদি। সবই যুক্তির কথা। কিন্তু, ফুলবাড়ীর লোকেরা যে সংগ্রাম করছে, মিছিল করে জীবন দিচ্ছে, তার কি মূল্য নেই? একটা পুরো এলাকার গ্রামের মানুষ বাপ-দাদার ভিটা বিসর্জন দেবে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে, এটা কতটা ন্যায্য? শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নিলেন, সেটা যতটা না কয়লার ব্যাপারে, তার চেয়েও বেশি মানুষের ব্যাপারে। অর্থাৎ, এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়।
এ কারণেই তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি শেখ হাসিনার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে। এটা কম কথা নয়। তারা তো এই কয়লা নিয়ে শেখ হাসিনাকে দেশের স্বার্থবিরোধী আখ্যা দিতে ছাড়েনি। এখন যে স্বাগত জানাচ্ছে, নিশ্চয়ই অকারণে নয়।
মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করেও যে খনি খোঁড়া যায় না, তা নয়। কিন্তু সেজন্য প্রচুর সম্পদ ও উন্নত প্রযুক্তি দরকার। কয়েক মাস আগে আমি সুইডেনে এ রকম একটি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। সেই দেশে যেকোনো উন্নয়নকাজে মানবাধিকার, মানবিকতা প্রভৃতিকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেওয়া হয়। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার উত্তরে কিরুনা শহরে বছর দশেক আগে বেশ উন্নতমানের আয়রন ওর (লৌহ আকরিক) পাওয়া গেছে। কিন্তু খনি খুঁড়ে সেই লোহা তুলতে হলে শহর থাকে না। এ নিয়ে নগরবাসীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঠিক করা হলো, পুরো শহরই কয়েক কিলোমিটার দূরে সরিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে। লোকসংখ্যা ২৩ হাজার। প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ খুশি। ক্ষতিপূরণ দেবে সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান খনি কোম্পানি এলকুয়াবে। তারাই নতুন শহরে নতুন ও আধুনিক ডিজাইনের বাড়ি তৈরি করে দেবে সবার জন্য। কিন্তু বাদ সাধলেন অপেক্ষাকৃত প্রবীণ নাগরিকেরা। তাঁরা পুরোনো স্মৃতিময় বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছেন না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, মাটি খুঁড়ে তাঁদের বাড়ি পুরোটাই তুলে নিয়ে নতুন শহরে অবিকল আগের মতো করে বসিয়ে দেওয়া হবে। এবার আর কারও আপত্তি রইল না। ফুলবাড়ীতেও যদি সে রকম কিছু করা যেত, সবার জন্য আলাদা জমি, আধুনিক, সুরম্য অট্টালিকা বানিয়ে দেওয়া হতো, যদি সবার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে কারও নিশ্চয়ই আপত্তি থাকত না। কাউকে মিছিল করে জীবনও দিতে হতো না। কিন্তু আমাদের মতো ছোট ও গরিব দেশে তো সেটা সম্ভব নয়।
তাহলে আমাদের কী করতে হবে? যেহেতু আমারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মাটির নিচে কয়লা রেখে দেওয়াই শ্রেয় মনে করছি, তাই আমাদের কিছু অসুবিধা মেনে নিতে হবে। আমদানি করা কয়লা দিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বানাতে হবে। যাদের সংগতি কম, অর্থাৎ আমাদের মতো মধ্য বা নিম্ন মধ্যবিত্ত, তারা না হয় কুপি জ্বালিয়ে, অথবা কষ্টেসৃষ্টে কিছু টাকা জোগাড় করে সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে কাটিয়ে দেব। তাও তো মানুষ বাঁচবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কয়লা-কৌশল প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিতর্কিত হলেও, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অত্যন্ত সঠিক একটি সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক, অর্থাৎ মানুষের স্বার্থকে বিবেচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা যেকোনো সফল রাজনীতিবিদের এটা প্রথম কর্তব্য। দেশে তো সমস্যার অন্ত নেই। এর মধ্যে বাড়তি সমস্যা ডেকে না আনাই ভালো। সরকার যেসব কাজ হাতে নিয়েছে, সেগুলো আগে সুসম্পন্ন করা হোক। মানুষ বাঁচুক। নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ঘুরতে শুরু করেছেন। তিনি যদি সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারেন, তাহলে মানুষ চিরঋণী থাকবে। আরেক মন্ত্রী যদি বাজারে তেল-ডালের দাম কমাতে পারেন, তাহলে তো কথাই নেই। যদি ব্যর্থ ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কিছু মন্ত্রীকে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে তো আরও ভালো।
আর যদি বিরোধী দলের আস্থা অর্জনের জন্য উচ্চ আদালতের রায়কে প্রাধান্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী দুই মেয়াদের নির্বাচন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে আমরা বলতে পারব যে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল সত্যিকার অর্থেই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ও রকম একটি সমঝোতার জন্য দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
প্রশ্ন উঠবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নিলে শেখ হাসিনা কি আর মুখ দেখাতে পারবেন? ওটা কি একটি বড় রাজনৈতিক পরাজয় হবে না? না, হবে না। ইতিহাসে এ রকম অনেক উদাহরণ আছে। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না, যাব না—বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিএনপি তো গিয়েছিল। দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে সেটা দরকার ছিল বলেই বিএনপি সে সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি। না হলে আরও বহু বছর ধরে সেনাশাসনের জাঁতাকলে আমাদের চলতে হতো। অনেক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে জীবন দিতে হতো।
রাজনীতি মানুষের জন্য। সেখানে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ যেন প্রাধান্য না পায়, সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সতর্ক থাকতে হয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.