ট্রাম্পের গাজা ‘সাফ’ করার মতলব সফল হবে না

প্রায় আট বছর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর  জামাতা জ্যারেড কুশনার তথাকথিত ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ (ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি) উন্মোচন করেছিলেন। ফিলিস্তিনিরা যথার্থভাবেই এটিকে ‘শতাব্দীর সেরা ডাকাতি’ বলে আখ্যা দিয়েছিল। কথিত শান্তি প্রস্তাবটির মূল উদ্দেশ্য ছিল, পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে গেড়ে বসা ইহুদিদের বসতিগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা।

চার বছর পর দেখা গেল, আসলে ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ ছিল কুশনারের নতুন তহবিলের জন্য সৌদি আরব থেকে পাওয়া দুই শ কোটি ডলারের বিনিয়োগ।

এখন ট্রাম্প গাজার ফিলিস্তিনিদের অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। তিনি আরব দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন জায়গায় বাড়ি তৈরি করে, যেখানে তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারে। ট্রাম্প প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করতে চাইছেন। এই সংখ্যা ১৯৪৮ সালের নাকবার সময় ভিটেছাড়া হওয়া এবং এখন গাজায় বসবাসকারী শরণার্থীদের সংখ্যার কাছাকাছি।

আমি ট্রাম্পের ‘শান্তিতে বসবাসের’ ধারণার সঙ্গে একমত। তবে তাঁর প্রস্তাবকে একটু পরিবর্তন করা দরকার। ১৫ লাখ ফিলিস্তিনিকে অন্য কোথাও পাঠানোর বদলে ১৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের আসল বাড়িতে, অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে তাঁদের জোরপূর্বক যেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, সেখানে ফেরত পাঠানো হোক। মিসর বা জর্ডানে নয়, বরং এখন যে জায়গাটিকে ইসরায়েল বলা হয়, সে জায়গাটিই তাদের আদি বাড়ি এবং সেখানেই তাদের ফিরে যেতে দেওয়া উচিত।

ট্রাম্প এখন মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু আসলে তাঁর কথা বলা উচিত নেতানিয়াহুর সঙ্গে। গাজার পূর্ব-পশ্চিম দিকে তাকানোর বদলে তাঁকে দখলদার ইসরায়েলের দিকেই নজর দিতে হবে এবং নেতানিয়াহুকে বাধ্য করতে হবে, যাতে তিনি ফিলিস্তিনিদের তাদের আসল গ্রাম ও শহরে ফিরতে দেন (যেমনটি জাতিসংঘের প্রস্তাব ১৯৪-এ বলা হয়েছে)।

তথাকথিত ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ এবং এখনকার ‘গাজা পুরোপুরি সাফ করে ফেলা’র মতো প্রস্তাব আসলে একই ধারার। এটি আদতেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি গভীরভাবে বর্ণবাদী জায়নবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ।

ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রকৃত অর্থে ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির সেই বর্ণবাদী নীতিরই পুনরাবৃত্তি, যার মূল লক্ষ্য হলো ‘নদী থেকে সাগর পর্যন্ত’ (পূর্ব দিকের জর্ডান নদী থেকে পশ্চিমের ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড—যার মধ্যে এখনকার ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজা অন্তর্ভুক্ত) একটি ইহুদি জাতিবাদী রাষ্ট্র কায়েম করা। এটি ন্যায়বিচারের এমন এক ভয়ংকর বিপরীত রূপ, যেখানে নির্যাতিতরা আরও বেশি শাস্তি পায় আর দখলদার আরও শক্তিশালী ও পুরস্কৃত হয়।

ট্রাম্পের এই বর্ণবাদী প্রস্তাবের সবচেয়ে স্পষ্ট ও তীব্র জবাব এসেছে সেই লাখো ফিলিস্তিনির কাছ থেকে যারা প্রচণ্ড কষ্ট করে ঠান্ডার মধ্যে উত্তর গাজায় নিজেদের ঘরে ফেরা শুরু করেছে। ইসরায়েল তাদের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পরও তারা ফিরে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের এই দৃঢ় মনোবল ও সংকল্প দেখিয়ে দিচ্ছে, নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার যেকোনো ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে তারা জীবন দিতে রাজি আছেন।

এই অবিচল প্রতিজ্ঞা প্রমাণ করে, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তাদের মাতৃভূমির সম্পর্ক ভাঙার নয়। যতই ধ্বংস আর দুঃখ-দুর্দশা আসুক, তারা তাদের ভূমির প্রতি ভালোবাসা ধরে রেখেছে। তাদের জন্য বাড়িঘর শুধু ইট-পাথরের কাঠামো নয়। এটি তাদের পরিচয়, ইতিহাস ও ভূমির সঙ্গে গভীর সম্পর্কের প্রতীক।

ট্রাম্পের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রস্তাব আসলে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের বর্ণবাদী নীতিরই ধারাবাহিকতা। এটি ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এবং মিথ্যা সহানুভূতির আড়ালে দমন-পীড়ন ও উচ্ছেদকে আরও শক্তিশালী করে। সে কারণেই ট্রাম্পের প্রস্তাবকে প্রথম ইসরায়েলের কট্টরপন্থী বর্ণবাদী মন্ত্রী বেজালেল স্মোতরিচ ও ইতামার বেন গভিরকে স্বাগত জানাতে দেখে আমরা মোটেও অবাক হইনি।

এই ইহুদিবাদী নেতাদের মতো ট্রাম্পও মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বই শান্তির পথে বাধা। এই দৃষ্টিভঙ্গি সেই নাৎসি মতাদর্শের সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে তারা ইউরোপীয় ইহুদিদের উপস্থিতিকে সমস্যা হিসেবে দেখত। কিন্তু ভয়াবহ হলোকাস্টের ঘটনা ঘটিয়েও সেই মতাদর্শ সফল হয়নি।

একইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ড্রেসডেন, হামবুর্গ ও লন্ডনে ফেলা মোট বোমার চেয়ে বেশি বোমা ফেলে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের মুছে ফেলার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।

আসলে ভুক্তভোগীদের দোষারোপ করা মানে আসল অপরাধীকে আড়াল করা এবং দখলদারকে দায় এড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া। এই বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ইসরায়েলকে তার দমনমূলক নীতিগুলো অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে। এতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকৃত জবাবদিহি ও তদন্ত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।

১৫ মাসের গণহত্যামূলক যুদ্ধে গাজার ৬৬ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে এবং জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি নিহত বা আহত হয়েছে। এরপরও ফিলিস্তিনিদের মনোবল ভাঙেনি। এখন নতুনভাবে ‘নরম কৌশলে’ তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা আসলে ১৯৪৮ সালের নাকবার পুনরাবৃত্তি। তখন লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে সাময়িকভাবে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল, যাতে ইউরোপের নাৎসি নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা ইহুদিদের জন্য জায়গা তৈরি করা যায়।

যদি বাস্তবিকই স্থানান্তরের কোনো যৌক্তিকতা থাকে, তাহলে তা ইসরায়েলের নেতাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়া উচিত। যেমন নেতানিয়াহু, স্মোতরিচ ও বেন গভির—যাঁদের পূর্বপুরুষেরা পোল্যান্ড, ইউক্রেন ও ইরাকের মতো জায়গায় বসবাস করতেন। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ না করে বরং তাঁদের পূর্বপুরুষদের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবা উচিত।

ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের যে কোনো পরিকল্পনা (প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে) চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের গুরুতর লঙ্ঘন। এটি ইসরায়েলের কট্টরপন্থী নীতিগুলোকে আরও শক্তিশালী করে। এটি ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিরুদ্ধে যায়।

তবে ট্রাম্পের প্রস্তাবে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ, তার প্রশাসনের অনেকে প্রকাশ্যেই ইসরায়েলের ডানপন্থী এজেন্ডার সঙ্গে একমত। আসলে তাঁদের অনেকের কাছে ইহুদিবাদী স্বার্থ রক্ষা করা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্পকে বুঝতেই হবে, ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’র মতো যেকোনো অন্যায় পরিকল্পনা ঘৃণার চক্রকে আরও গভীর করে এবং অনন্ত সংঘাতের বীজ রুয়ে দেয়। তাঁকে বুঝতে হবে, গাজার মানুষের প্রয়োজন ন্যায়বিচার, অবমাননা নয়। তাঁদের প্রাপ্য হলো মর্যাদা, জাতিগত উচ্ছেদ নয়।

*জামাল কানজ ফিলিস্তিনি-আমেরিকান লেখক ও বিশ্লেষক

*মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর ফিলিস্তিনিরা নিজেদের বসতিতে ফিরছেন
যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর ফিলিস্তিনিরা নিজেদের বসতিতে ফিরছেন। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.