পানামা পেপারস ও শিবঠাকুরের আপন দেশ
কিছুদিন
আগে ব্রিটিশ সংস্থা ‘অক্সফাম’ একটা রিপোর্ট পেশ করেছিল মনে আছে কি?
রিপোর্টের মোদ্দা কথা ছিল, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের হাতে
রয়েছে বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষের সমবেত সম্পদের চেয়েও বেশি সম্পদ! অক্সফামের
সেই রিপোর্টের নাম ছিল ‘অ্যান ইকোনমি ফর দ্য ওয়ান পার্সেন্ট’। দুনিয়ার
প্রায় সব কাগজেই খবরটা ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা হতবাক হয়ে
গিয়েছিলাম। এই অসাম্যের প্রতিকার কী, তা নিয়ে কিছুদিন ভাবনাচিন্তা হয়েছিল।
তারপর সব সময় যা হয়, যে কে সেই। এই বিপুল সম্পদ কীভাবে আহরিত হতে পারে তার
একটা হদিস এই সেদিন আমরা ‘পানামা পেপারস’ মারফত পেলাম। পানামার এই সংস্থা
(ল ফার্ম) মোসাক ফনসেকা ২ লাখ ১৪ হাজার ‘অফশোর’ কোম্পানির সাড়ে ১১ মিলিয়ন
নথি ঘেঁটে ২ দশমিক ৬ টেরাবাইটের যে ডেটা বা তথ্য প্রকাশ করেছে, আয়তনে তা
এডওয়ার্ড স্নোডেনের ‘উইকিলিকস’-এর চেয়েও বিশাল। পৃথিবীর ৭৬টি দেশের ১০৭টি
সংবাদমাধ্যমের ৪০০ সাংবাদিক এই তথ্য ঘেঁটে যা পেয়েছেন, সেই সম্পূর্ণ তালিকা
এ বছরের মে মাসে প্রকাশিত হবে। এ কাজে সাহায্য করেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল
কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’-এর (আইসিআইজে) সদস্য
সাংবাদিকেরা। পানামা পেপারসে ফাঁস হওয়া এই ভয়ংকর তথ্য দেখে আমাদের চক্ষু
চড়কগাছ। করমুক্ত দেশের সাহচর্যে কীভাবে কর ফাঁকি দিয়ে রাষ্ট্রনায়ক ও
ক্ষমতাবানেরা টাকার এভারেস্ট তৈরি করে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারেন,
পানামা পেপারস তারই একটা ঝাঁকিদর্শন। কাদের নাম এই কাণ্ডে জড়িয়েছে? রাশিয়ার
ভ্লাদিমির পুতিন, পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফ, ইংল্যান্ডের ডেভিড ক্যামেরন,
চীনের শি িজনপিং—তালিকায় কে নেই? আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্দুর
গুনলসনের নামও ছিল ওই তালিকায়। একমাত্র তিনিই প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা
দিয়ে সরে গেছেন। দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী অভিযুক্তদের বলেছেন বিদেশে
গচ্ছিত অর্থ দেশে ফেরত নিয়ে আসতে। নৈতিক কারণে এমনভাবে আর কেউ কোনো দেশে
পদত্যাগ করেছেন বলে এখন পর্যন্ত শুনিনি। বরং দেশে দেশে নেতাদের পক্ষ থেকে
এমন একটা ভাব দেখানো হচ্ছে যে এটা আদৌ কোনো দুর্নীতি নয়। পানামা পেপারসে
পাঁচ শরও বেশি ভারতীয়র নাম রয়েছে। এই তালিকায় রাজনীতিবিদেরা যেমন রয়েছেন,
তেমনই রয়েছেন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও ফিল্মের নামকরা নায়ক-নায়িকারা। যেমন
অমিতাভ বচ্চন তাঁর অভিনেত্রী পুত্রবধূ ঐশ্বর্য রাই। দুজনের পক্ষ থেকেই
অবশ্য বলা হয়েছে, তাঁরা নির্দোষ। তাঁদের নাম কেউ ব্যবহার করে থাকতে পারে।
তাঁরা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। দোষী প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকেই
নির্দোষ। আইনের এই আপ্তবাক্যকে মর্যাদা দিতেই হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে
অবশ্যই নজর রাখতে হবে, পানামা পেপারসের রহস্য উদ্ঘাটনে আমাদের দেশের
সরকারের আদৌ কোনো হেলদোল আছে কি না।
ঘটনাটা যেদিন জানাজানি হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন বিদেশে। সেখান থেকে তিনি কথা বলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে। নির্দেশ দেন পূর্ণাঙ্গ তদন্তের। সে জন্য রিজার্ভ ব্যাংক, প্রত্যক্ষ কর কর্তৃপক্ষ ও অর্থনৈতিক তদন্তের কাজে নিযুক্ত গোয়েন্দাদের নিয়ে একটা বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর রঘুরাম রাজনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘ট্যাক্স হেভেন’ বলে যেসব দেশ রয়েছে, সেখানে বৈধভাবেও কোম্পানি খোলা যায়। ভারতের আইনেও বলা আছে, যেকোনো ব্যক্তিই তাঁর আয় থেকে বছরে আড়াই লাখ ডলার বিদেশে পাঠাতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ বৈধ। তিনি জানান, দেখতে হবে পানামা পেপারসের তথ্য অনুযায়ী বিদেশে গচ্ছিত অর্থ বৈধ না অবৈধভাবে রাখা কি না। রঘুরাম রাজনের এই কথা ও কালোটাকা দেশে ফেরানোর উদ্যোগের ক্ষেত্রে ভারতের ট্র্যাক রেকর্ড যা, তাতে খুব একটা কিছু যে হবে সে আশা না করাই ভালো। তিন বছর আগে এ দেশের সরকারি সূত্র অনুযায়ী মোট কালোটাকার পরিমাণের যে আন্দাজটুকু করা হয়েছিল, তা ছিল দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৭০ শতাংশ! সেই হিসাবের এক বছর পর ভোট হয়। ভোটের প্রচারে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হলে ওই টাকা তিনি দেশে ফেরত নিয়ে আসবেন। প্রতিটি মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা জমা পড়বে। ভোট-বাজারে সেটা ছিল একটা ফাটাফাটি স্ক্রিপ্ট। দুই বছর কেটে গেছে, সেই টাকা আসছে তো আসছেই। প্রধানমন্ত্রী এখন আর ভুলেও ওসব কথা মুখে আনেন না।
মাঝেমধ্যে কেন যেন মনে হয় ভারত হলো শিবঠাকুরের আপন দেশ। এ দেশে সব সম্ভব। মাস কয়েক আগে ললিত মোদিকে নিয়ে কী হইচইটাই না হলো! পাঁচ হাজার কোটি টাকা কামিয়ে একটা লোক দেশ থেকে বেমালুম ভেগে গেলেন, আমরা তাঁর টিকিটাও এখনো ছুঁতে পারিনি। পারবও কি না জানি না। সেই লোকটা বিলেতে বসে বসে যা খুশি তাই করে যাচ্ছেন, বলে যাচ্ছেন, রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, আর আমরা অসহায় হয়ে বসে বসে দেখছি।
আর একটা লোক, তাঁর নাম বিজয় মালিয়া, নিজেকে তিনি ‘কিং অব গুড টাইমস’ বিশেষণ দিয়েছেন, ১৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কাছে নয় হাজার কোটি টাকারও বেশি দেনা রেখে ভেগে গেছেন! ললিতের মতো বিজয় মালিয়াও আদৌ কোনো দিন দেশে ফিরে আইনের মুখোমুখি দাঁড়াবেন কি না ঘোর সন্দেহ। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে ও তাঁর পরিবারের অন্যদের সম্পত্তির তালিকা পেশ করতে বলেছে। লোকটা জবাব দিয়েছেন, বউ-ছেলেমেয়েদের সম্পত্তির হিসাব দেবেন না। সাদাচোখে আমরা সবাই জানি, আমাদের টাকায় এত বছর ধরে যে বারফাট্টাই তিনি মেরেছেন, দেশে-বিদেশে যে বিপুল সম্পত্তি বানিয়েছেন, কথায় কথায় যে হারে মচ্ছব করেন, তাতে ব্যাংকের দেনা দুবার শোধ দেওয়া যায়। কিন্তু তা তিনি দেবেন না। টাকা চুরিই যঁার উদ্দেশ্য ছিল, তঁার বয়ে গেছে টাকা শোধ করতে। বিলেতে তিনিও ললিত মোদির মতো আয়েশে কাটিয়ে দেবেন বছরের পর বছর। আমরা আহাম্মকের দল। নেতারাও। ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে আমরা শুধু চেয়েই থাকব! মাঝেমধ্যে কেন যেন মনে হয় ভারত হলো শিবঠাকুরের আপন দেশ। এ দেশে সব সম্ভব। মাস কয়েক আগে ললিত মোদিকে নিয়ে কী হইচইটাই না হলো! পাঁচ হাজার কোটি টাকা কামিয়ে একটা লোক দেশ থেকে বেমালুম ভেগে গেলেন, আমরা তাঁর টিকিটাও এখনো ছুঁতে পারিনি সুপ্রিম কোর্ট নিজের মতো করে একটু চেষ্টা যে করছে না তা নয়। কিন্তু তারও কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের অদ্ভুত সব যুক্তি। একটা নমুনা দিই। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ আর কিছুদিনের মধ্যেই ১০ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে যাবে। হিসাবটা আমার নয়। বিজেপির খুব প্রবীণ নেতা সাবেক মন্ত্রী মুরলি মনোহর যোশির। এর মধ্যে বিজয় মালিয়াদের মতো ৪৪ জন শিল্পপতির কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা পৌনে পাঁচ লাখ কোটি! সুপ্রিম কোর্ট চাইছে, শিল্পের নামে এভাবে যারা জনতার টাকা নয়ছয় করছে, তাদের নামধাম প্রকাশ করে দেওয়া হোক। লোকজন জানুক কে কী ধরনের লোক। সুপ্রিম কোর্ট চাইলেও রঘুরাম রাজন কিন্তু তা চান না। কেন চান না? তাঁর ব্যাখ্যাটা হলো, যারা ‘উইলফুল ডিফল্টার’, মানে বিজয় মালিয়ার মতো যাদের দেনা শোধের কোনো ইচ্ছাই নেই, তাদের নাম প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু সব খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে তা করা ঠিক হবে না। কারণ, তাতে শিল্পমহলে অকারণ উদ্বেগ সৃষ্টি হবে, প্যানিক সৃষ্টি হবে, শিল্প পরিবেশের ক্ষতি হবে। রঘুরামের যুক্তি, সবাই ইচ্ছা করে ব্যবসায় অসফল হন না। অসাফল্যের অনেক কারণ থাকে। টাকা শোধ করতে না পারলেই যদি ঋণখেলাপি হিসেবে নাম উঠে যায়, তাহলে ঝুঁকি নিয়ে কেউ আর শিল্প করতে আসবেন না। ওয়ান পার্সেন্টদের ইকোনমির স্বার্থে সব দেশেই এমন যুক্তিজাল বিছানো হয় কি না জানি না। তবে আমাদের দেশে হয়। আর হয় বলেই ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ শব্দ সমষ্টি বাকি নাইন্টি নাইন পার্সেন্টকে পরিহাস করে।
তবু কিছু বোকা মানুষ এখনো আছেন, যাঁরা চেষ্টায় খামতি রাখেন না। তেমনই কিছু মানুষ এ দেশে একটা ‘অনলাইন ক্যাম্পেন’ শুরু করেছেন। বিজয় মালিয়াদের মতো ৪৪ জন ‘ভারতরত্ন’, যাঁরা আপনার-আমার-জনতার পৌনে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ফুঁকে দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করার জন্য দেশের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির কাছে অনলাইন আবেদন জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই অনলাইন ক্যাম্পেনের পক্ষে ১ লাখ ১০ হাজার মানুষ সই করেছেন। এঁরা সবাই ‘পোয়েটিক জাস্টিসের’ প্রত্যাশী। পানামা পেপারস, কালোটাকা বা খেলাপি ঋণ সব এক সুতোয় গাঁথা। এ দেশের ট্র্যাক রেকর্ডের কথা আমরা জানি। খুব একটা আশাবাদী, তাই হতে পারি না। সামান্য কলমচি আমি। এই লেখাটা ওয়ান পার্সেন্টের বিরুদ্ধে নাইন্টি নাইন পার্সেন্টদের এক নীরব প্রতিবাদ।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লির প্রতিনিধি।
ঘটনাটা যেদিন জানাজানি হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন বিদেশে। সেখান থেকে তিনি কথা বলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে। নির্দেশ দেন পূর্ণাঙ্গ তদন্তের। সে জন্য রিজার্ভ ব্যাংক, প্রত্যক্ষ কর কর্তৃপক্ষ ও অর্থনৈতিক তদন্তের কাজে নিযুক্ত গোয়েন্দাদের নিয়ে একটা বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর রঘুরাম রাজনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘ট্যাক্স হেভেন’ বলে যেসব দেশ রয়েছে, সেখানে বৈধভাবেও কোম্পানি খোলা যায়। ভারতের আইনেও বলা আছে, যেকোনো ব্যক্তিই তাঁর আয় থেকে বছরে আড়াই লাখ ডলার বিদেশে পাঠাতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ বৈধ। তিনি জানান, দেখতে হবে পানামা পেপারসের তথ্য অনুযায়ী বিদেশে গচ্ছিত অর্থ বৈধ না অবৈধভাবে রাখা কি না। রঘুরাম রাজনের এই কথা ও কালোটাকা দেশে ফেরানোর উদ্যোগের ক্ষেত্রে ভারতের ট্র্যাক রেকর্ড যা, তাতে খুব একটা কিছু যে হবে সে আশা না করাই ভালো। তিন বছর আগে এ দেশের সরকারি সূত্র অনুযায়ী মোট কালোটাকার পরিমাণের যে আন্দাজটুকু করা হয়েছিল, তা ছিল দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৭০ শতাংশ! সেই হিসাবের এক বছর পর ভোট হয়। ভোটের প্রচারে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হলে ওই টাকা তিনি দেশে ফেরত নিয়ে আসবেন। প্রতিটি মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা জমা পড়বে। ভোট-বাজারে সেটা ছিল একটা ফাটাফাটি স্ক্রিপ্ট। দুই বছর কেটে গেছে, সেই টাকা আসছে তো আসছেই। প্রধানমন্ত্রী এখন আর ভুলেও ওসব কথা মুখে আনেন না।
মাঝেমধ্যে কেন যেন মনে হয় ভারত হলো শিবঠাকুরের আপন দেশ। এ দেশে সব সম্ভব। মাস কয়েক আগে ললিত মোদিকে নিয়ে কী হইচইটাই না হলো! পাঁচ হাজার কোটি টাকা কামিয়ে একটা লোক দেশ থেকে বেমালুম ভেগে গেলেন, আমরা তাঁর টিকিটাও এখনো ছুঁতে পারিনি। পারবও কি না জানি না। সেই লোকটা বিলেতে বসে বসে যা খুশি তাই করে যাচ্ছেন, বলে যাচ্ছেন, রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, আর আমরা অসহায় হয়ে বসে বসে দেখছি।
আর একটা লোক, তাঁর নাম বিজয় মালিয়া, নিজেকে তিনি ‘কিং অব গুড টাইমস’ বিশেষণ দিয়েছেন, ১৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কাছে নয় হাজার কোটি টাকারও বেশি দেনা রেখে ভেগে গেছেন! ললিতের মতো বিজয় মালিয়াও আদৌ কোনো দিন দেশে ফিরে আইনের মুখোমুখি দাঁড়াবেন কি না ঘোর সন্দেহ। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে ও তাঁর পরিবারের অন্যদের সম্পত্তির তালিকা পেশ করতে বলেছে। লোকটা জবাব দিয়েছেন, বউ-ছেলেমেয়েদের সম্পত্তির হিসাব দেবেন না। সাদাচোখে আমরা সবাই জানি, আমাদের টাকায় এত বছর ধরে যে বারফাট্টাই তিনি মেরেছেন, দেশে-বিদেশে যে বিপুল সম্পত্তি বানিয়েছেন, কথায় কথায় যে হারে মচ্ছব করেন, তাতে ব্যাংকের দেনা দুবার শোধ দেওয়া যায়। কিন্তু তা তিনি দেবেন না। টাকা চুরিই যঁার উদ্দেশ্য ছিল, তঁার বয়ে গেছে টাকা শোধ করতে। বিলেতে তিনিও ললিত মোদির মতো আয়েশে কাটিয়ে দেবেন বছরের পর বছর। আমরা আহাম্মকের দল। নেতারাও। ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে আমরা শুধু চেয়েই থাকব! মাঝেমধ্যে কেন যেন মনে হয় ভারত হলো শিবঠাকুরের আপন দেশ। এ দেশে সব সম্ভব। মাস কয়েক আগে ললিত মোদিকে নিয়ে কী হইচইটাই না হলো! পাঁচ হাজার কোটি টাকা কামিয়ে একটা লোক দেশ থেকে বেমালুম ভেগে গেলেন, আমরা তাঁর টিকিটাও এখনো ছুঁতে পারিনি সুপ্রিম কোর্ট নিজের মতো করে একটু চেষ্টা যে করছে না তা নয়। কিন্তু তারও কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের অদ্ভুত সব যুক্তি। একটা নমুনা দিই। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ আর কিছুদিনের মধ্যেই ১০ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে যাবে। হিসাবটা আমার নয়। বিজেপির খুব প্রবীণ নেতা সাবেক মন্ত্রী মুরলি মনোহর যোশির। এর মধ্যে বিজয় মালিয়াদের মতো ৪৪ জন শিল্পপতির কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা পৌনে পাঁচ লাখ কোটি! সুপ্রিম কোর্ট চাইছে, শিল্পের নামে এভাবে যারা জনতার টাকা নয়ছয় করছে, তাদের নামধাম প্রকাশ করে দেওয়া হোক। লোকজন জানুক কে কী ধরনের লোক। সুপ্রিম কোর্ট চাইলেও রঘুরাম রাজন কিন্তু তা চান না। কেন চান না? তাঁর ব্যাখ্যাটা হলো, যারা ‘উইলফুল ডিফল্টার’, মানে বিজয় মালিয়ার মতো যাদের দেনা শোধের কোনো ইচ্ছাই নেই, তাদের নাম প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু সব খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে তা করা ঠিক হবে না। কারণ, তাতে শিল্পমহলে অকারণ উদ্বেগ সৃষ্টি হবে, প্যানিক সৃষ্টি হবে, শিল্প পরিবেশের ক্ষতি হবে। রঘুরামের যুক্তি, সবাই ইচ্ছা করে ব্যবসায় অসফল হন না। অসাফল্যের অনেক কারণ থাকে। টাকা শোধ করতে না পারলেই যদি ঋণখেলাপি হিসেবে নাম উঠে যায়, তাহলে ঝুঁকি নিয়ে কেউ আর শিল্প করতে আসবেন না। ওয়ান পার্সেন্টদের ইকোনমির স্বার্থে সব দেশেই এমন যুক্তিজাল বিছানো হয় কি না জানি না। তবে আমাদের দেশে হয়। আর হয় বলেই ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ শব্দ সমষ্টি বাকি নাইন্টি নাইন পার্সেন্টকে পরিহাস করে।
তবু কিছু বোকা মানুষ এখনো আছেন, যাঁরা চেষ্টায় খামতি রাখেন না। তেমনই কিছু মানুষ এ দেশে একটা ‘অনলাইন ক্যাম্পেন’ শুরু করেছেন। বিজয় মালিয়াদের মতো ৪৪ জন ‘ভারতরত্ন’, যাঁরা আপনার-আমার-জনতার পৌনে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ফুঁকে দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করার জন্য দেশের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির কাছে অনলাইন আবেদন জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই অনলাইন ক্যাম্পেনের পক্ষে ১ লাখ ১০ হাজার মানুষ সই করেছেন। এঁরা সবাই ‘পোয়েটিক জাস্টিসের’ প্রত্যাশী। পানামা পেপারস, কালোটাকা বা খেলাপি ঋণ সব এক সুতোয় গাঁথা। এ দেশের ট্র্যাক রেকর্ডের কথা আমরা জানি। খুব একটা আশাবাদী, তাই হতে পারি না। সামান্য কলমচি আমি। এই লেখাটা ওয়ান পার্সেন্টের বিরুদ্ধে নাইন্টি নাইন পার্সেন্টদের এক নীরব প্রতিবাদ।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লির প্রতিনিধি।
No comments