চলে গেলেন নির্মল সেন
প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক, বাম রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা নির্মল সেন আর নেই। মঙ্গলবার রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সন্ধ্যায় কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন
। নির্মল সেনকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছিল। গত ২৩ ডিসেম্বর থেকে নির্মল সেন ল্যাব এইডে চিকিৎসারত ছিলেন। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার দিঘিরপাড় গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় তার অক্সিজেন নিতে সমস্যা হচ্ছিল। তাই দ্রুত ল্যাব এইডের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ল্যাব এইডে নির্মল সেন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. সাইদুল ইসলাম ও নিউরোলজি বিভাগের ডা. সিরাজুল হকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। নির্মল সেনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁরা পৃথক শোক বার্তায় নির্মল সেনের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।বর্ণাঢ্য জীবন ॥ নির্মল সেন চলে গেলেও রেখে গেছেন দীর্ঘ এক বর্ণাঢ্য জীবন। ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ খ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন ১৯৩০ সালের ৩ আগস্ট গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সুরেন্দ্র নাথ সেন গুপ্ত। মাতার নাম লাবণ্য প্রভা সেন গুপ্তা। ছয় ভাই ও বোনের মধ্যে নির্মল সেন ছিলেন চতুর্থ।
বাড়ির পাঠশালাতে নির্মল সেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এরপর কোটালীপাড়া উপজেলার প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত। পরবর্তীতে তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি এম ই স্কুলে ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এর পরে তিনি চলে যান বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি গ্রামে তাঁর পিসির বাসায়। সেখান থেকেই ১৯৪৪ সালে কলসকাঠি বি এম একাডেমী থেকে নির্মল সেন প্রবেশিকা (এসএসসি) পাস করেন। প্রবেশিকা পাস করার পর বরিশালের বিএম কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে নির্মল সেন ১৯৪৬ সালে আইএসসি পাস করেন। একই কলেজে বিএসসি পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। জেলখানা থেকে বিএসসি পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে জেলখানা থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৬৩ সালে নির্মল সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষ করেন।
নির্মল সেনের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৪২ সাল থেকে। তখন তিনি ৯ম শ্রেণীর ছাত্র। মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ১৬ দিন স্কুল গেটে ধর্মঘট করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি আরএসপি’তে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে জেলে থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আউয়ালের অনুরোধে ছাত্রলীগে যোগ দেন। তবে নির্মল সেন এম এ আউয়ালের কাছে দাবি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিলে তিনি ছাত্রলীগ করবেন। এম এ আউয়াল নির্মল সেনের এই দাবিটি মেনে নিয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে নির্মল সেন বরিশাল জেলা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তখন তাঁর সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন গোলাম রব্বানি। ১৯৫৪ সালে নির্মল সেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মোমিন তালুকদার এবং এম এ আউয়াল। ১৯৬০ সালে নির্মল সেন আবার আরএসপিতে ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালে আদমজী জুটমিলে রুহুল আমিন কায়সার, খান সাইফুর রহমান, নির্মল সেন, সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮৮ সালে নির্মল সেন এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি গঠন করেন। তিনি এই পার্টির সভাপতি ছিলেন।
শৈশব কাল থেকেই নির্মল সেনের লেখালেখির হাত ছিল। ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় হাতে লেখা ‘কমরেড’ পত্রিকায় তিনি লিখতেন। ১৯৬১ সালে ইত্তেফাক পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতায় তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এর পর তিনি ১৯৬২ সালে দৈনিক জেহাদ পত্রিকায় যোগ দেন। পরে ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান, পরবর্তীতে দৈনিক বাংলায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। প্রেস ট্রাস্টের এই পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত নির্মল সেন এই পত্রিকায়ই যুক্ত ছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালে নির্মল সেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য। দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতা জীবনে নির্মল সেন একাধিক বার জেল খেটেছেন। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে অনশন করেছেন। ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে নির্মল সেন প্রথম জেলে যান। জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালে বন্দিদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে নির্মল সেন ৬ দিন অনশন করেন। এর পরে একই বছর মে মাসে রাজবন্দীদের দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রতিবাদে নির্মল সেন ২৪ দিন অনশন করেন। সে অনশন ভাঙিয়ে ছিলেন ফকির আব্দুল মান্নান। কিন্তু তার পরও নির্মল সেনের দাবি না মানার কারণে তিনি একই বছরের আগস্ট-সেপ্টম্বর মাসে ৪০ দিন অনশন করেন। সে অনশন ভাঙিয়ে ছিলেন মনোরঞ্জন ধর ও ফকির আব্দুল মান্নান। এর পরেও নির্মল সেনের দাবি না মানার কারণে ১৯৫০ সালে নির্মল সেনসহ অনেক রাজবন্দী ৫২ দিন অনশন করেন। এ সময় তাদের কিছু দাবি মানা হয়।
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিক করল ঢাকা হলকে মুসলিম হল করে জগন্নাথ হলকে সংখ্যালঘুদের ছেড়ে দেয়া হবে। এরই প্রতিবাদে নির্মল সেন অনশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হলে। ঢাকা হল ছিল একমাত্র কসমোপলিটন হল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জগন্নাথ হল পিএমজি অফিস ছিল। নির্মল সেনের দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল কসমোপলিটন হল করতে হবে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাজি হলো না। কারণ সব হল কসমোপলিটন করতে হলে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হলের নাম পরিবর্তন করতে হবে। কর্তৃপক্ষ এটা চাইলেন না। নির্মল সেন অনশন শুরু করলেন। সে অনশন ৭ দিন পর্যন্ত চলে। ৭ দিন পরে ডাক্তার বললেন নির্মল সেনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তার পর ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি ইব্রাহীম নির্মল সেনের অনশন ভাঙিয়ে বললেন, আমি বেঁচে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল কসমোপলিটন করা হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল কসমোপলিটন করা হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে নির্মল সেন দৈনিক বাংলা বন্ধের প্রতিবাদে এবং সাংবাদিকদের বেতন-ভাতার দাবিতে অনশন করেন। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রেস ট্রাস্টের ৪টি পত্রিকা বন্ধ করে দেবে। কয়েক সাংবাদিকও তাই চেয়ে ছিলেন। কিন্তু সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪টি পত্রিকার সাংবাদিক কর্মচারীদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে দিয়ে পত্রিকাগুলো বন্ধ করা হবে, বাস্তবে তা হয়নি। সরকার থেকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অর্থ দিয়ে সাংবাদিক কর্মচারীদের বিদায় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে নির্মল সেন রাজি হননি। একসময় সিদ্ধান্ত নেন অনশন করবেন। সেই মতো প্রেসক্লাবে অনশন শুরু করলেন। প্রথম রাতে আর্মি আসে। সাংবাদিকদের প্রতিরোধের মুখে আর্মিরা চলে যায়। কদিন পরে ঢাকার হকাররা সিদ্ধান্ত নেয় তাঁর দাবি না মানলে তাঁরা প্রেসক্লাব ঘেরাও করবে। সে দিন রাতে ১২টি আর্মির গাড়ি আসে প্রেসক্লাবে। তারা জোর করে নির্মল সেনকে সিএমএইচে নিয়ে যেতে চান। সিএমএইচে নয়, তিনি পিজিতে যেতে অনাপত্তি জানান। কারণ পিজি প্রেসক্লাবের কাছাকাছি। তাই নির্মল সেনকে গভীর রাতে পিজিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ৯ দিন অনশন করার পরে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নির্মল সেনের অনশন ভাঙ্গান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ৫ দলীয় নেতা হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে নির্মল সেন সংগঠক হিসেবে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। তিনি আগরতলা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি একাধিকবার আগরতলা থেকে ঢাকায় এসে তরুণদের সংগঠিত করেন এবং ভারতের আগরতলায় আরএসপির সহযোগিতায় তরুণদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন।
সাংবাদিকদের নেতা হিসেবে নির্মল সেন ভারত, জার্মানি, রাশিয়া, হাঙ্গেরী, নেপাল, যুগোস্লাভিয়া চেকস্লোভাকিয়া ভ্রমণ করেছেন। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে লন্ডন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীনসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
নির্মল সেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। এসব বইয়ের মধ্যে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র, বার্লিন থেকে মস্কো, পূর্ব বঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ, মা জন্মভূমি, লেনিন থেকে গর্বাচেভ, আমার জবানবন্দী, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, আমার জীবনে ’৭১-এর যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
বিভিন্ন সংগঠনের শোক ॥ নির্মল সেনের মৃত্যুতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি এবং সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়া এক শোক বার্তায় বলেন, দেশের প্রগতিশীল আন্দোলন ও সাংবাদিকতায় বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য জাতি তাঁকে চিরদিন স্মরণ করবে। নেতৃবৃন্দ বলেন, নির্মল সেনের মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাংবাদিক অঙ্গন একজন অভিভাবক হারাল।
শিল্পমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের সভাপতি দিলীপ বড়ুয়া এই কীর্তিমান রাজনীতিক ও সাংবাদিকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। একইসঙ্গে তিনি নির্মল সেনের শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। নির্মল সেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ নাসিম।
No comments