টিআই ধারণা সূচক-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রণীত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বছরের মতো ১৩তম_ এই অবস্থান ইতিবাচক না নেতিবাচক, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। নিচের দিক থেকে স্থির অবস্থানে থাকা নাকি উপরের দিক থেকে ২০ ধাপ নেমে আসা; কোনটি প্রণিধানযোগ্য, স্থির করা কঠিন।
বার্লিনভিত্তিক সংস্থাটি যে পদ্ধতিতে কোনো দেশের দুর্নীতির মাত্রা মূল্যায়ন করে, তাও প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে দুর্নীতির উপস্থিতি প্রবল। গত কয়েক দশকে প্রশাসনের উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যায়ে এই ব্যাধি বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার গৃহীত সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ আটকে আছে দুর্নীতিরই অভিযোগে। দুর্নীতিবিরোধী বৈশ্বিক সংস্থাটির বাংলাদেশ অধ্যায়ের পক্ষ থেকে এই সূচক উপস্থাপনকালে যেসব দুর্নীতির কথা উদ্ধৃত হয়েছে, তাও কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? রেলওয়ে কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি প্রভৃতি ইস্যু কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে রয়েছে। কেবল প্রশাসন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়; দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক অঙ্গীকারও কি যথেষ্ট দৃঢ়? অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে না এলে সাধারণ নাগরিকের পক্ষে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন ও সংঘবদ্ধ হওয়া কঠিন। আমরা আশা করি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই সূচককে সে ক্ষেত্রে তাগিদ হিসেবেই গ্রহণ করবে সরকার। আমরা দেখেছি, ২০০১-২০০৫ সাল একটানা পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতির ধারণা সূচকে নিম্নতম দেশগুলোর সারিতে স্থান পেয়েছিল। অর্থাৎ দুর্নীতির শীর্ষস্থান। পরবর্তী পাঁচ বছরে আট ধাপ এগিয়ে গত বছর ১৩তম স্থানে পেঁৗছেছে। দুর্নীতি কিছুটা হ্রাসের এই অবস্থানে আত্মতৃপ্তির অবকাশ নেই। দুর্নীতির ক্ষেত্রে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। রাজনৈতিক অন্যায় ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে রক্তস্নাত এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো একটি দেশ দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত হবে কেন? আমরা মনে করি, দুর্নীতি দূর করা কেবল অর্থনৈতিক মুক্তি, আইনের শাসন ও নাগরিক অধিকারের বিষয় নয়; এর সঙ্গে একটি জাতির মর্যাদার প্রশ্নও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে জাতি লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে পারে, তারা দুর্নীতির কলঙ্কও বিসর্জন দিতে সক্ষম বলে আমরা বিশ্বাস করি। এই উপলব্ধি সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে আসতে হবে সবার আগে। এর আগে প্রায় প্রত্যেকবারই দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন দল ও সরকার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এর পুনরাবৃত্তি কেউ দেখতে চায় না। সরকারের বরং উচিত হবে, ধারণা সূচকটিকে আত্মবিশ্লেষণের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটান কীভাবে এই অঞ্চলে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের সম্মান লাভ করল; সিঙ্গাপুর কীভাবে তালিকায় শীর্ষ দশ দুর্নীতিমুক্ত দেশের সারিতে স্থান করে নেয়_ আমাদের সরকারের উচিত তা খতিয়ে দেখা। জনপরিসরে যেসব দুর্নীতি, তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলেই পরবর্তী বছর সূচকে উপরের দিকে স্থান হতে পারে। তাতে করে দেশের ভেতরে ও বাইরে সরকারের ভাবমূর্তিই কেবল উজ্জ্বল হবে না, নির্বাচনী বৈতরণী পার হতেও কাজে দেবে। এই সহজ সত্য আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বুঝবেন আশা করা যায়।
No comments