বিশেষ সাক্ষাৎকার : এমাজউদ্দীন আহমদ-আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা ভয়ংকর
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দুই শিবিরে বিভক্ত। কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : আজকে ক্ষমতাসীন দল যা চায় না, তাই তারা একদিন চেয়েছিল। পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানের পেছনে কাজ করছে এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পারস্পরিক সমঝোতা, জয়-পরাজয়কে খেলোয়াড়োচিত মানসিকতা থেকে দেখা আবশ্যক। অন্যদিকে পরাজয় হলে 'আকাশ ভেঙে পড়ল' আর বিজয়ী হলে 'সব পেয়েছি' ভাব করার জায়গা নেই। আমি যা পছন্দ করি না তা অন্যকে বলতে দেব না, এটা গণতন্ত্র নয়। আমাদের এখানে নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলে মনে করা হয়। আসলে নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের একটি পদক্ষেপ মাত্র।
আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, এই প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। আমি মনে করি, সমগ্র সংবিধানে এই বাক্যটি শ্রেষ্ঠতম। আবার এই বাক্যটিই প্রহসনমূলক হয়েছে রাজনীতিবিদদের দ্বারাই। এভাবেই তো পরস্পর মুখোমুখি হয় আমাদের রাজনীতি।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা কি সংবিধানসম্মত হবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সংবিধানের ১২৩/৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের শেষ ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের যে মডেলকে সামনে রেখে আমাদের এখানে সংসদীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে কি তেমন হচ্ছে? ব্রিটেন কিংবা ভারতের কথা বলা যায়। সেখানে কিন্তু ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের এখানে এই ব্যবস্থা করার পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাচনে আমরাই আসতে চাই, অন্যরা যাতে কেউ না আসতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডে সংসদ কার্যকাল পূর্ণ করার পর অথবা কোনো কারণে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দিলে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আমাদের এখানে কী করা হলো, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা যে যাঁর অবস্থানে থেকে যাবেন আর সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল গণতন্ত্রের মৌল উপাদানগুলো সুসংহত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সংবিধান পরিবর্তন হয়ে যায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে একান্তই নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। বিরোধী দলকে আমলে না এনে।
কালের কণ্ঠ : এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির কোনো পথ কি নেই?
এমাজউদ্দীন আহমদ : রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। মন্ত্রী কিংবা কর্মকর্তা, যেই হোন তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। দুটি দলের মধ্যে বিশ্বাসহীনতা আকাশসম। সরকারি দল বিরোধী দলকে নিয়ে কাজ করে না। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে খেয়াল করুন, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে যাওয়ার আগে কিংবা পরে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলেন, মতবিনিময় হয় তাঁদের মধ্যে। সরকারি দল বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে। অথচ আমাদের এখানে প্রধানমন্ত্রী যদি বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে একটি কথা বলেন, তাও খবর হয়ে যায়। এ কেমন কথা! এটা নিত্য হওয়া উচিত। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভয়ংকর আস্থাহীনতা বিরাজ করছে। এখানে পারস্পরিক অবিশ্বাস মূল হিসেবে কাজ করছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এখন খালেদা জিয়া বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গে। মানসিকতা ভালো-খারাপ বলব না। তবে এটা গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা এ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনগণের ক্ষমতার আমানত হিসেবে মনে না করবেন, ততক্ষণ আমাদের দুর্ভোগ লেগেই থাকবে।
কালের কণ্ঠ : শুধু তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুই নয়, সব সমস্যা নিয়েই সংসদে গিয়ে কথা বলতে আহ্বান জানাচ্ছে সরকারি দল। কিন্তু এতে করে কি সুরাহা হবে বলে আপনি মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এটা ১৯৯৬ সালে বিএনপি বলেছে। এখন বলছে আওয়ামী লীগ। পার্লামেন্টে গিয়ে বললে কী পরিণতি হবে? পার্লামেন্টে যাওয়াই সার হবে। কোনো কাজ হবে না। তবে সংকট কাটানোর জন্য সংলাপের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে হবে। একটা সংকট নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা হলো, এক পক্ষ কিছু ছাড় দিল, আরেক পক্ষ আরেকটু ছাড় দিল। এমন করেই তো এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আলোচনা শেষে যদি পার্লামেন্টে যাওয়া যায়, তাহলে বিষয়টি হবে সুন্দর। আর সরাসরি সেখানে যাওয়ার পর কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে। কোনো প্রস্তাব সেখানে ভোটে চলে গেলে তা নিয়ে আর আলোচনার কোনো সুযোগ থাকে না।
কালের কণ্ঠ : জরুরি জাতীয় কোনো ইস্যুতেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হয় না। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের সমাজ হিসেবে বয়স কম করে হলেও সাড়ে চার হাজার বছরের। অন্যদিকে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমাদের বয়স মাত্র ৪০ বছর। এখনো বিদেশি শাসকদের ভয়ভীতি, অনুসরণ-অনুকরণ করি। তাদের ওপর কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ভরও করি। যেমন- আমাদের জাতীয় কোনো বিষয় অথচ আমরা পরামর্শ চাইলাম যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে। ৪০ বছরে আমাদের পক্ষে আর কতটাই শেখা সম্ভব! ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আজকের পর্যায়ে পৌঁছতে শত শত বছর লেগেছে। তারা পেয়েছে ম্যাগনাকার্টার মতো বিশ্বখ্যাত অনুপ্রেরণা। ভারতে প্রাথমিক পর্যায়েই ঠিক করে রাখা হয়েছিল স্বাধীন হলে তাদের কে কোন দায়িত্ব এবং কিভাবে তা পালন করা হবে। কিন্তু আমাদের এখানে ছিল অনিশ্চিত অবস্থা। আমাদের দেশ বিভাগ হলো, দেখা গেল, আমাদের ভাষার পরিচয়ই আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। আমরা তো রাষ্ট্রভাষা থেকে শুরু করে অনেক ঘটনার মূলে যেতে পারিনি।
কালের কণ্ঠ : সর্বত্র দলীয়করণের অভিযোগ করা হয় বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন আপনি?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ব্যুরোক্রেসিতে দলীয়করণ করলে তা সংশোধন করা সম্ভব হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়করণ সম্ভব নয়। যারা অনুগত তারা সব সময়ই অনুগত হয়ে থাকে। মনে আছে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদের কথা। তিনি ছিলেন অনুগতদের সেরা। বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি জিয়াউর রহমানের গুণকীর্তন করলেন। পরে যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেন তখন সুর পাল্টে ফেললেন। সুতরাং দলীয়করণের পরিণতি কিন্তু ভালো হয় না।
কালের কণ্ঠ : সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ইতিহাস দীর্ঘ। তবে সাফল্যও আছে কিছু। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর ব্যর্থতার যদি পরিমাপ করা হয়, তাহলে বলতে হবে, এটা চরম অভিধায় পড়তে পারে। খাদ্য ও কৃষি খাতে কিছু সাফল্য অবশ্য আছে। শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪-৪.৫ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। দলীয়করণের যে উদাহরণ সরকার তৈরি করেছে, তা বর্ণনা করা কঠিন। আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাকে লজ্জাজনক বলতে হবে অবশ্যই।
কালের কণ্ঠ : শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীলতার কারণ ও প্রতিকারের পথ কী বলে মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : মূল কারণ হচ্ছে, সরকার চায় তার অনুগতদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হোক। ফলে শিক্ষকরা উপাচার্যকে মানতে চান না। কারণ তাঁরাও তো কম যান না। মূল বিষয় হচ্ছে দলবাজি।
কালের কণ্ঠ : ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা একসময় বলা হতো। এখন বলা হচ্ছে শিক্ষক রাজনীতি; এমনকি শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধ করার ব্যাপারে। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ছাত্রদের রাজনীতি বন্ধ হবে কেন? প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাদের অন্যায় আবদার গ্রহণ না করলেই হয়। তারা কিন্তু অনেকের চেয়ে বেশি সহনশীল। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কিভাবে তাদের মূল্যায়ন করবেন। তবে শিক্ষক রাজনীতি না থাকাই উচিত।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য অনেকেই ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশকে দায়ী করছে। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ খুব একটা খারাপ না। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি একে কিভাবে ব্যবহার করছেন, তার ওপর। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন সব কিছুরই পরিবর্তন করতে হয়, এ ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। আরেকটা বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এত নির্বাচন না হওয়াই উচিত। ভিসি পদটি হোক নির্বাচিতদের মধ্য থেকে। এত বেশি নির্বাচন হওয়ার কারণে শিক্ষক নিয়োগের সময়ই চিন্তা করা হয় নতুন ওই শিক্ষক নিয়োগকালীন উপাচার্যের দলের লোক হবেন কি না। অর্থাৎ সেই ভোটটি তিনি পাবেন কি না। তাই সেখানে এত বেশি ভোট না হওয়াই প্রয়োজন।
কালের কণ্ঠ : দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাংলাদেশে খুবই খারাপ। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। এ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষমতা হারানোর পর পুলিশের হাতেই মার খান। পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত সেবা প্রদানে নিয়োজিত করতে হবে। তারা যাতে এমন মনে করে না, সরকারি দলের কেউ হলে তার জন্য সাত খুন মাফ। এই যে কিছুদিন আগে বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দেওয়া হলো, এর কোনো মানে আছে? দেশে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। সাংবাদিক দম্পতি খুন হলো, কিছু হলো আজ পর্যন্ত? ইলিয়াস আলী গুম হলো, কিন্তু তাঁর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো বকেই যাচ্ছেন। কোনো প্রতিকার নেই।
কালের কণ্ঠ : আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা হয় না বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : দলের ভেতরে ও বাইরে- সবখানে গণতন্ত্র চর্চা হওয়া উচিত। এটা শুধু কেন্দ্রে করলেই হবে না, একবারে তৃণমূল পর্যায়েও চর্চা করতে হবে। দলের অভ্যন্তরে একবারে গ্রাম শাখাগুলোকেও গণতান্ত্রিক চর্চার আওতায় আনতে হবে।
কালের কণ্ঠ : রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশনে। আপনি কি মনে করেন, তাদের হিসাব বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত?
এমাজউদ্দীন আহমদ : রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছতার প্রয়োজনেই এটা উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। একজন এমপির মেয়াদ শেষ হলে তাঁর হিসাব বিবরণী জনসমক্ষে তুলে ধরা উচিত।
কালের কণ্ঠ : সংসদে না যাওয়ার রীতিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সংসদে না যাওয়ার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। আমাদের এখানে সংসদীয় সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি। আপনি যদি গালি দিতে চান, তাহলেও যান সংসদে। সেখানে গিয়ে মনের ইচ্ছামতো কথা বলুন। তবে সেখানে সরকারি দলের ভূমিকা থাকে বেশি। সরকারি দলকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে বিরোধী দলকে সংসদে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রয়োজনীয় ছাড়ও তাদেরই আগে দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : আজকে ক্ষমতাসীন দল যা চায় না, তাই তারা একদিন চেয়েছিল। পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানের পেছনে কাজ করছে এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পারস্পরিক সমঝোতা, জয়-পরাজয়কে খেলোয়াড়োচিত মানসিকতা থেকে দেখা আবশ্যক। অন্যদিকে পরাজয় হলে 'আকাশ ভেঙে পড়ল' আর বিজয়ী হলে 'সব পেয়েছি' ভাব করার জায়গা নেই। আমি যা পছন্দ করি না তা অন্যকে বলতে দেব না, এটা গণতন্ত্র নয়। আমাদের এখানে নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলে মনে করা হয়। আসলে নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের একটি পদক্ষেপ মাত্র।
আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, এই প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। আমি মনে করি, সমগ্র সংবিধানে এই বাক্যটি শ্রেষ্ঠতম। আবার এই বাক্যটিই প্রহসনমূলক হয়েছে রাজনীতিবিদদের দ্বারাই। এভাবেই তো পরস্পর মুখোমুখি হয় আমাদের রাজনীতি।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা কি সংবিধানসম্মত হবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সংবিধানের ১২৩/৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের শেষ ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের যে মডেলকে সামনে রেখে আমাদের এখানে সংসদীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে কি তেমন হচ্ছে? ব্রিটেন কিংবা ভারতের কথা বলা যায়। সেখানে কিন্তু ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের এখানে এই ব্যবস্থা করার পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাচনে আমরাই আসতে চাই, অন্যরা যাতে কেউ না আসতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডে সংসদ কার্যকাল পূর্ণ করার পর অথবা কোনো কারণে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দিলে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আমাদের এখানে কী করা হলো, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা যে যাঁর অবস্থানে থেকে যাবেন আর সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল গণতন্ত্রের মৌল উপাদানগুলো সুসংহত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সংবিধান পরিবর্তন হয়ে যায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে একান্তই নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। বিরোধী দলকে আমলে না এনে।
কালের কণ্ঠ : এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির কোনো পথ কি নেই?
এমাজউদ্দীন আহমদ : রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। মন্ত্রী কিংবা কর্মকর্তা, যেই হোন তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। দুটি দলের মধ্যে বিশ্বাসহীনতা আকাশসম। সরকারি দল বিরোধী দলকে নিয়ে কাজ করে না। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে খেয়াল করুন, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে যাওয়ার আগে কিংবা পরে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলেন, মতবিনিময় হয় তাঁদের মধ্যে। সরকারি দল বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে। অথচ আমাদের এখানে প্রধানমন্ত্রী যদি বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে একটি কথা বলেন, তাও খবর হয়ে যায়। এ কেমন কথা! এটা নিত্য হওয়া উচিত। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভয়ংকর আস্থাহীনতা বিরাজ করছে। এখানে পারস্পরিক অবিশ্বাস মূল হিসেবে কাজ করছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এখন খালেদা জিয়া বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গে। মানসিকতা ভালো-খারাপ বলব না। তবে এটা গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা এ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনগণের ক্ষমতার আমানত হিসেবে মনে না করবেন, ততক্ষণ আমাদের দুর্ভোগ লেগেই থাকবে।
কালের কণ্ঠ : শুধু তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুই নয়, সব সমস্যা নিয়েই সংসদে গিয়ে কথা বলতে আহ্বান জানাচ্ছে সরকারি দল। কিন্তু এতে করে কি সুরাহা হবে বলে আপনি মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এটা ১৯৯৬ সালে বিএনপি বলেছে। এখন বলছে আওয়ামী লীগ। পার্লামেন্টে গিয়ে বললে কী পরিণতি হবে? পার্লামেন্টে যাওয়াই সার হবে। কোনো কাজ হবে না। তবে সংকট কাটানোর জন্য সংলাপের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে হবে। একটা সংকট নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা হলো, এক পক্ষ কিছু ছাড় দিল, আরেক পক্ষ আরেকটু ছাড় দিল। এমন করেই তো এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আলোচনা শেষে যদি পার্লামেন্টে যাওয়া যায়, তাহলে বিষয়টি হবে সুন্দর। আর সরাসরি সেখানে যাওয়ার পর কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে। কোনো প্রস্তাব সেখানে ভোটে চলে গেলে তা নিয়ে আর আলোচনার কোনো সুযোগ থাকে না।
কালের কণ্ঠ : জরুরি জাতীয় কোনো ইস্যুতেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হয় না। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের সমাজ হিসেবে বয়স কম করে হলেও সাড়ে চার হাজার বছরের। অন্যদিকে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমাদের বয়স মাত্র ৪০ বছর। এখনো বিদেশি শাসকদের ভয়ভীতি, অনুসরণ-অনুকরণ করি। তাদের ওপর কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ভরও করি। যেমন- আমাদের জাতীয় কোনো বিষয় অথচ আমরা পরামর্শ চাইলাম যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে। ৪০ বছরে আমাদের পক্ষে আর কতটাই শেখা সম্ভব! ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আজকের পর্যায়ে পৌঁছতে শত শত বছর লেগেছে। তারা পেয়েছে ম্যাগনাকার্টার মতো বিশ্বখ্যাত অনুপ্রেরণা। ভারতে প্রাথমিক পর্যায়েই ঠিক করে রাখা হয়েছিল স্বাধীন হলে তাদের কে কোন দায়িত্ব এবং কিভাবে তা পালন করা হবে। কিন্তু আমাদের এখানে ছিল অনিশ্চিত অবস্থা। আমাদের দেশ বিভাগ হলো, দেখা গেল, আমাদের ভাষার পরিচয়ই আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। আমরা তো রাষ্ট্রভাষা থেকে শুরু করে অনেক ঘটনার মূলে যেতে পারিনি।
কালের কণ্ঠ : সর্বত্র দলীয়করণের অভিযোগ করা হয় বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন আপনি?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ব্যুরোক্রেসিতে দলীয়করণ করলে তা সংশোধন করা সম্ভব হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়করণ সম্ভব নয়। যারা অনুগত তারা সব সময়ই অনুগত হয়ে থাকে। মনে আছে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদের কথা। তিনি ছিলেন অনুগতদের সেরা। বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি জিয়াউর রহমানের গুণকীর্তন করলেন। পরে যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেন তখন সুর পাল্টে ফেললেন। সুতরাং দলীয়করণের পরিণতি কিন্তু ভালো হয় না।
কালের কণ্ঠ : সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ইতিহাস দীর্ঘ। তবে সাফল্যও আছে কিছু। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর ব্যর্থতার যদি পরিমাপ করা হয়, তাহলে বলতে হবে, এটা চরম অভিধায় পড়তে পারে। খাদ্য ও কৃষি খাতে কিছু সাফল্য অবশ্য আছে। শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪-৪.৫ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। দলীয়করণের যে উদাহরণ সরকার তৈরি করেছে, তা বর্ণনা করা কঠিন। আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাকে লজ্জাজনক বলতে হবে অবশ্যই।
কালের কণ্ঠ : শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীলতার কারণ ও প্রতিকারের পথ কী বলে মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : মূল কারণ হচ্ছে, সরকার চায় তার অনুগতদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হোক। ফলে শিক্ষকরা উপাচার্যকে মানতে চান না। কারণ তাঁরাও তো কম যান না। মূল বিষয় হচ্ছে দলবাজি।
কালের কণ্ঠ : ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা একসময় বলা হতো। এখন বলা হচ্ছে শিক্ষক রাজনীতি; এমনকি শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধ করার ব্যাপারে। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ছাত্রদের রাজনীতি বন্ধ হবে কেন? প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাদের অন্যায় আবদার গ্রহণ না করলেই হয়। তারা কিন্তু অনেকের চেয়ে বেশি সহনশীল। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কিভাবে তাদের মূল্যায়ন করবেন। তবে শিক্ষক রাজনীতি না থাকাই উচিত।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য অনেকেই ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশকে দায়ী করছে। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ খুব একটা খারাপ না। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি একে কিভাবে ব্যবহার করছেন, তার ওপর। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন সব কিছুরই পরিবর্তন করতে হয়, এ ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। আরেকটা বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এত নির্বাচন না হওয়াই উচিত। ভিসি পদটি হোক নির্বাচিতদের মধ্য থেকে। এত বেশি নির্বাচন হওয়ার কারণে শিক্ষক নিয়োগের সময়ই চিন্তা করা হয় নতুন ওই শিক্ষক নিয়োগকালীন উপাচার্যের দলের লোক হবেন কি না। অর্থাৎ সেই ভোটটি তিনি পাবেন কি না। তাই সেখানে এত বেশি ভোট না হওয়াই প্রয়োজন।
কালের কণ্ঠ : দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাংলাদেশে খুবই খারাপ। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। এ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষমতা হারানোর পর পুলিশের হাতেই মার খান। পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত সেবা প্রদানে নিয়োজিত করতে হবে। তারা যাতে এমন মনে করে না, সরকারি দলের কেউ হলে তার জন্য সাত খুন মাফ। এই যে কিছুদিন আগে বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দেওয়া হলো, এর কোনো মানে আছে? দেশে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। সাংবাদিক দম্পতি খুন হলো, কিছু হলো আজ পর্যন্ত? ইলিয়াস আলী গুম হলো, কিন্তু তাঁর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো বকেই যাচ্ছেন। কোনো প্রতিকার নেই।
কালের কণ্ঠ : আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা হয় না বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : দলের ভেতরে ও বাইরে- সবখানে গণতন্ত্র চর্চা হওয়া উচিত। এটা শুধু কেন্দ্রে করলেই হবে না, একবারে তৃণমূল পর্যায়েও চর্চা করতে হবে। দলের অভ্যন্তরে একবারে গ্রাম শাখাগুলোকেও গণতান্ত্রিক চর্চার আওতায় আনতে হবে।
কালের কণ্ঠ : রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশনে। আপনি কি মনে করেন, তাদের হিসাব বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত?
এমাজউদ্দীন আহমদ : রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছতার প্রয়োজনেই এটা উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। একজন এমপির মেয়াদ শেষ হলে তাঁর হিসাব বিবরণী জনসমক্ষে তুলে ধরা উচিত।
কালের কণ্ঠ : সংসদে না যাওয়ার রীতিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সংসদে না যাওয়ার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। আমাদের এখানে সংসদীয় সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি। আপনি যদি গালি দিতে চান, তাহলেও যান সংসদে। সেখানে গিয়ে মনের ইচ্ছামতো কথা বলুন। তবে সেখানে সরকারি দলের ভূমিকা থাকে বেশি। সরকারি দলকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে বিরোধী দলকে সংসদে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রয়োজনীয় ছাড়ও তাদেরই আগে দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments