সরল গরল-সুরঞ্জিত-মঈনের বাহাস বা ‘তত্ত্বাবধায়কের’ নতুন ফর্মুলা by মিজানুর রহমান খান
নতুন নির্বাচন কমিশনকে অন্তর্বর্তীকালীন বা কথিত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারে’ রূপান্তর প্রশ্নে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একটি নতুন ফর্মুলা দিলেন। এটা ভেবে দেখার মতো। সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল মঈন খান গত ২৩ জানুয়ারি রাতে বাংলাভিশনে একটা বাহাসে অংশ নিয়েছিলেন। দুজনের মধ্যে বাদানুবাদ কিছুমাত্র কম ছিল না। কিন্তু আকর্ষণীয় ছিল দুই জ্যেষ্ঠ নেতার দুটি মন্তব্য। ড. খান বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপি অত্যন্ত খোলা মন নিয়ে আলোচনা করেছিল।
রাষ্ট্রপতি যে সংকটের একটা সুরাহা চান, সেই বিষয়ে তাদের মনে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যাটা একটা জায়গায়। আর সেটা হলো, রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা খুবই সীমিত। ড. খান এ কথাও স্বীকার করলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এটা শূন্য রাখা যাবে না। কিন্তু ইসি গঠন কেন এতটা ঢাকঢোল পিটিয়ে করা হচ্ছে, তার একটা ইঙ্গিত মিলল রেলমন্ত্রীর কথায়। আওয়ামী লীগও বিশ্বাস করে না যে, কমিটি দিয়ে ইসি গঠন করলেই সংকট ঘুচে যাবে।
তবে বিএনপির চিন্তার জন্য রেলমন্ত্রী একটি খোরাক দিয়েছেন। সেটি হলো, দলীয় সরকার যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে পরিণত হবে, তখন ইসিকে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ আছে। তাঁর কথায়, ‘কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা নির্বাচনকালে ইসিকে দেওয়া যায়।’ নির্বাচনকালে সংস্থাপন, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিরাট ভূমিকা থাকে। এদের ক্ষমতা ইসিকে দিতে হলে বিদ্যমান সংবিধান ও আইনে কোথায় কী ধরনের পরিবর্তন আনার দরকার পড়বে, তা নিয়ে আলোচনা করা যায়।
বিএনপি যদিও শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল রেখে এ ধরনের ব্যবস্থায় যেতে না-ও রাজি হতে পারে। কিন্তু একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব টিভি টক শোতে স্পষ্ট করে বলা কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। এই নতুন ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে হলে তার প্রাসঙ্গিক দিকগুলো সামনে আসবে। নির্বাচনকালে মন্ত্রিসভার বৈঠক বসবে। প্রধানমন্ত্রীকে যদি বহাল রাখা হয়, তাহলে সম্ভাব্য চিত্রটি হবে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতায় বলশালী ইসি সদস্যরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বৈঠক করছেন। আর সেখানে সভাপতিত্ব করছেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতারত একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী।
তবে এমনও হতে পারে, মেয়াদ পুরো হলে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেবেন। রেওয়াজ হলো, প্রধানমন্ত্রী তখন বঙ্গভবনে যাবেন। তাঁর হাতে থাকবে পদত্যাগপত্র। তিনি তা রাষ্ট্রপতিকে দেবেন। তখন রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীকে বলার কথা, আপনার উত্তরসূরি না আসা পর্যন্ত আপনিই দায়িত্ব চালিয়ে যাবেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তা না-ও বলতে পারেন।
তখন গুপ্ত-ফর্মুলা কার্যকর হতে পারে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে পারেন। সংবিধান বাধা দেবে না। এ সময়ে রাষ্ট্রপতি তাঁর একান্ত নিজস্ব বিবেচনায় যেকোনো সাংসদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিতে পারেন। এটা হলে কিন্তু বিএনপির ফর্মুলা অনুযায়ী অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও একটি নির্বাচনকালীন সরকার আমরা কল্পনা করতে পারি। রেলমন্ত্রী বলছেন, বিএনপি সংসদে এসে কথা বলুক। এই পথ খোলা আছে। ড. মঈন খান জোর দিচ্ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সরকারি দলকেই আনতে হবে। ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে হলেও রেলমন্ত্রী বলেছেন, ‘জনমত দিয়ে যদি বাধ্য করতে পারে, তাহলে আমরা বিল আনব।’
সংসদে যোগ দিতে রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারের প্রথাগত আহ্বান বিএনপি উপেক্ষা করলেও সদস্যপদ টেকাতে তারা হয়তো এই অধিবেশনে যোগ দেবে। কিন্তু সেটা কি একটু অর্থপূর্ণ করা যায় না?
এখন যদি আমরা ধরে নিই, নির্বাচনকালে আওয়ামী লীগ ইসির কাছে এক বা একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রপতির সংলাপ-উদ্যোগ আরও ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। তাই প্রধান বিচারপতির মনোনয়নে আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি কী ধরনের ইসি গঠন করে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। কিন্তু এর প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে ঘুরেফিরে সেই বিচারপতি-নির্ভরতা।
২৬ জানুয়ারি সময় টিভিতে দেখলাম, রেলমন্ত্রী প্রশ্নের উত্তরে বলছেন, আদালতের দ্বার খোলা। মওদুদ সাহেব যদি মনে করে থাকেন, অনুসন্ধান কমিটি অসাংবিধানিক, তাহলে তিনি তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলেই পারেন।
কমিটি গঠনে সাংবিধানিক ও আইনি জটিলতা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কারণ, একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে সম্পূর্ণ নির্বাহী এবং তুমুল রাজনৈতিক প্রকৃতির একটি কাজে সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতিদের যুক্ত করা একটি বিরাট প্রশ্ন। ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় যে ‘আইন ও তার বিধানাবলী’, সেটা সংবিধানের আওতায়। এখন আইনের অস্তিত্ব নেই। তাই প্রশ্ন, ১১৮-র নাম করে মন্ত্রিসভা বিভাগ কী করে প্রজ্ঞাপন জারি করল। এখন তিনটি অনুসন্ধান কমিটি (দুদক, তথ্য ও মানবাধিকার কমিশন) রয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও প্রতিটি সংসদের আইন দ্বারা সৃষ্টি। আমরা যে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠিত হতে দেখি, তা-ও সংসদের আইনের আওতায়। ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম প্রজ্ঞাপন দিয়ে কর্মরত বিচারকদের দায়িত্বের পরিধি বাড়ানো হলো। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রণীত আচরণবিধিতে বলা আছে, বিচারপতিরা তাঁদের সুউচ্চ পদমর্যাদা কাউকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে দেবেন না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কারণে সুপ্রিম কোর্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবার সেই সুপ্রিম কোর্টকেই উত্তপ্ত উনুনে থাকা একটি চরম রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হলো। তার মানে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রাখার পাক চক্র থেকে আমরা বেরোতে পারছি না। কমিটি অবিতর্কিত ইসি দিতে না পারলে তার আঁচ সুপ্রিম কোর্টের গায়েও লাগবে।
তেমন একটি বিতর্কিত ইসিকে সাধারণ নির্বাচনকালে একাধিক মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা দেওয়া হলেও তা সংকট ঘোচাবে না।
‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ বলে একটা কথা আছে। অনুসন্ধান কমিটির সদস্য বাছাই যেভাবে করা হয়েছে, তাতে খুব আশাবাদী হতে পারলাম না। যেমন—হাইকোর্টে দলনিরপেক্ষ অনেক জ্যেষ্ঠ বিচারক ছিলেন। তাঁদের টপকিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করা হলো। আওয়ামী আইনজীবী হিসেবেই যাঁর পরিচিতি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও অনেকেরই জানা। তিনি নিষ্ঠাবান হতে পারেন, কিন্তু কমিটিতে তাঁকে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনগণের কাছে নির্দলীয় প্রতীয়মান হওয়ার সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
অতীতে সাধারণ নির্বাচনের অব্যবহিত আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হতে আমরা দেখেছি। যাঁরা এখন সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার হবেন, তাঁরা যদি দুই বছর পরে সরে দাঁড়ানোর মানসিকতা এখনই বিবেচনায় নেন, তাহলে উত্তম। সিইসি বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে সরিয়ে বিচারপতি আব্দুর রউফ, বিচারপতি কে এম সাদেককে সরিয়ে আবু হেনা, বিচারপতি এম এ আজিজকে সরিয়ে ড. এ টি এম শামসুল হুদাকে আমরা সিইসি হতে দেখেছি। সুতরাং অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে বলেই যেকোনো মূল্যে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে, এ মানসিকতা যেন নবাগতদের না থাকে। তবে অযৌক্তিক কারনে সাংবিধানিক পদাধিকারীদের পদত্যাগও সমীচীন মনে করিনা।
রেলমন্ত্রী বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে অনুসন্ধান কমিটি হয়েছে। তিনি ড. খানের সঙ্গে একমত হন যে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া আর সব কাজে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এখন অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়েই তবে বঙ্গভবনে যাবে। কমিটি প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজন করে নাম প্রস্তাব করবে। এখন সর্বোচ্চ পাঁচজন ও সর্বনিম্ন দুজনকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা যাবে। কমিটি দলগুলোর কাছে পাঁচটি করে নাম চেয়েছে। তবে রাষ্ট্রপতি আপাতত দুজনকে দিয়েই ইসি করতে পারেন। পরে বিএনপি ও অন্যান্য দলের পরামর্শে তিনজন নিয়োগের পথ খোলা থাকবে।
তিনটি বিষয় ইসি গঠন-প্রক্রিয়ায় বিবেচনাযোগ্য। প্রথমত, কমিটিকে মনে রাখতে হবে, সুপ্রিম কোর্ট স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচারক বাছাইয়ের আইন না মেনে পার পাচ্ছেন। কিন্তু এবার তাঁরা পার না-ও পেতে পারেন। ওই ঘটনায় হরতালের ঝুঁকি ছিল না। কিন্তু এবার হরতালের ঝুঁকি থাকবে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী চাইলে পোস্টবক্সের ভূমিকা পালন করতে পারেন। রাষ্ট্রপতিকে একক কর্তৃত্ব পালনের সুযোগ দিতে পারেন। সংবিধান অন্তরায় হবে না। প্রধানমন্ত্রী চাইলে ওই ১০ জনের মধ্য থেকে কাদের বিষয়ে তাঁর সমর্থন রয়েছে, তা রাষ্ট্রপতিকে জানাতে পারেন। ধরা যাক, জনাব ক ও খ-কে সিইসি নিয়োগের জন্য কমিটি সুপারিশ করল। প্রধানমন্ত্রী খ-কে নিয়োগ দিতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিলেন। এটা ঘটলে রাষ্ট্রপতিকে ক নয়, খ-কে নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু কমিটি যদি আগেই তার তালিকা প্রকাশ করে এবং সেভাবেই যদি তা রাষ্ট্রপতির কাছে যায়, তাতে বিতর্ক কম হবে।
সুতরাং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করবে কি না, সেটা আমরা ১০ কার্যদিবস পরেই জানতে পারব। জেনে ভালো লাগল যে ক্ষমতাসীন দল অস্পষ্টভাবে হলেও নির্বাচনকালে ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের’ কিংবা ক্ষমতার মুঠো আলগা করার একটা প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।
বিএনপির উচিত হবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিবাচক ইঙ্গিতসংবলিত গুপ্ত-ফর্মুলাকে আরও আলোকিত করা। অনুসন্ধান কমিটিসংক্রান্ত আধাখেঁচড়া প্রজ্ঞাপনটির সূত্র ধরে সংসদে একটি বিল আনার সুবর্ণ সুযোগ লুফে নেওয়া। এটা তারা সংসদের বাইরে ‘বিকল্প বাজেটের’ মতো সংবাদ সম্মেলন করেও দিতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকেও তাদের উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলের একটি খসড়া প্রকাশ করা।
ক্ষমতাসীনেরা সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের শর্ত কিন্তু আসলে পূরণ করল না। ভালো কাজেও ফাঁকি দিল। অন্যদিকে সংসদ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে পদ্ধতিগতভাবে প্রত্যাখ্যান করে তথাকথিত সুশাসন দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বিএনপিও দেশবাসীকে বোকা বানিয়ে চলেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
তবে বিএনপির চিন্তার জন্য রেলমন্ত্রী একটি খোরাক দিয়েছেন। সেটি হলো, দলীয় সরকার যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে পরিণত হবে, তখন ইসিকে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ আছে। তাঁর কথায়, ‘কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা নির্বাচনকালে ইসিকে দেওয়া যায়।’ নির্বাচনকালে সংস্থাপন, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিরাট ভূমিকা থাকে। এদের ক্ষমতা ইসিকে দিতে হলে বিদ্যমান সংবিধান ও আইনে কোথায় কী ধরনের পরিবর্তন আনার দরকার পড়বে, তা নিয়ে আলোচনা করা যায়।
বিএনপি যদিও শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল রেখে এ ধরনের ব্যবস্থায় যেতে না-ও রাজি হতে পারে। কিন্তু একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব টিভি টক শোতে স্পষ্ট করে বলা কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। এই নতুন ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে হলে তার প্রাসঙ্গিক দিকগুলো সামনে আসবে। নির্বাচনকালে মন্ত্রিসভার বৈঠক বসবে। প্রধানমন্ত্রীকে যদি বহাল রাখা হয়, তাহলে সম্ভাব্য চিত্রটি হবে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতায় বলশালী ইসি সদস্যরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বৈঠক করছেন। আর সেখানে সভাপতিত্ব করছেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতারত একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী।
তবে এমনও হতে পারে, মেয়াদ পুরো হলে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেবেন। রেওয়াজ হলো, প্রধানমন্ত্রী তখন বঙ্গভবনে যাবেন। তাঁর হাতে থাকবে পদত্যাগপত্র। তিনি তা রাষ্ট্রপতিকে দেবেন। তখন রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীকে বলার কথা, আপনার উত্তরসূরি না আসা পর্যন্ত আপনিই দায়িত্ব চালিয়ে যাবেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তা না-ও বলতে পারেন।
তখন গুপ্ত-ফর্মুলা কার্যকর হতে পারে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে পারেন। সংবিধান বাধা দেবে না। এ সময়ে রাষ্ট্রপতি তাঁর একান্ত নিজস্ব বিবেচনায় যেকোনো সাংসদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিতে পারেন। এটা হলে কিন্তু বিএনপির ফর্মুলা অনুযায়ী অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও একটি নির্বাচনকালীন সরকার আমরা কল্পনা করতে পারি। রেলমন্ত্রী বলছেন, বিএনপি সংসদে এসে কথা বলুক। এই পথ খোলা আছে। ড. মঈন খান জোর দিচ্ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সরকারি দলকেই আনতে হবে। ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে হলেও রেলমন্ত্রী বলেছেন, ‘জনমত দিয়ে যদি বাধ্য করতে পারে, তাহলে আমরা বিল আনব।’
সংসদে যোগ দিতে রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারের প্রথাগত আহ্বান বিএনপি উপেক্ষা করলেও সদস্যপদ টেকাতে তারা হয়তো এই অধিবেশনে যোগ দেবে। কিন্তু সেটা কি একটু অর্থপূর্ণ করা যায় না?
এখন যদি আমরা ধরে নিই, নির্বাচনকালে আওয়ামী লীগ ইসির কাছে এক বা একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রপতির সংলাপ-উদ্যোগ আরও ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। তাই প্রধান বিচারপতির মনোনয়নে আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি কী ধরনের ইসি গঠন করে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। কিন্তু এর প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে ঘুরেফিরে সেই বিচারপতি-নির্ভরতা।
২৬ জানুয়ারি সময় টিভিতে দেখলাম, রেলমন্ত্রী প্রশ্নের উত্তরে বলছেন, আদালতের দ্বার খোলা। মওদুদ সাহেব যদি মনে করে থাকেন, অনুসন্ধান কমিটি অসাংবিধানিক, তাহলে তিনি তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলেই পারেন।
কমিটি গঠনে সাংবিধানিক ও আইনি জটিলতা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কারণ, একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে সম্পূর্ণ নির্বাহী এবং তুমুল রাজনৈতিক প্রকৃতির একটি কাজে সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতিদের যুক্ত করা একটি বিরাট প্রশ্ন। ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় যে ‘আইন ও তার বিধানাবলী’, সেটা সংবিধানের আওতায়। এখন আইনের অস্তিত্ব নেই। তাই প্রশ্ন, ১১৮-র নাম করে মন্ত্রিসভা বিভাগ কী করে প্রজ্ঞাপন জারি করল। এখন তিনটি অনুসন্ধান কমিটি (দুদক, তথ্য ও মানবাধিকার কমিশন) রয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও প্রতিটি সংসদের আইন দ্বারা সৃষ্টি। আমরা যে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠিত হতে দেখি, তা-ও সংসদের আইনের আওতায়। ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম প্রজ্ঞাপন দিয়ে কর্মরত বিচারকদের দায়িত্বের পরিধি বাড়ানো হলো। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রণীত আচরণবিধিতে বলা আছে, বিচারপতিরা তাঁদের সুউচ্চ পদমর্যাদা কাউকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে দেবেন না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কারণে সুপ্রিম কোর্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবার সেই সুপ্রিম কোর্টকেই উত্তপ্ত উনুনে থাকা একটি চরম রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হলো। তার মানে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রাখার পাক চক্র থেকে আমরা বেরোতে পারছি না। কমিটি অবিতর্কিত ইসি দিতে না পারলে তার আঁচ সুপ্রিম কোর্টের গায়েও লাগবে।
তেমন একটি বিতর্কিত ইসিকে সাধারণ নির্বাচনকালে একাধিক মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা দেওয়া হলেও তা সংকট ঘোচাবে না।
‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ বলে একটা কথা আছে। অনুসন্ধান কমিটির সদস্য বাছাই যেভাবে করা হয়েছে, তাতে খুব আশাবাদী হতে পারলাম না। যেমন—হাইকোর্টে দলনিরপেক্ষ অনেক জ্যেষ্ঠ বিচারক ছিলেন। তাঁদের টপকিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করা হলো। আওয়ামী আইনজীবী হিসেবেই যাঁর পরিচিতি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও অনেকেরই জানা। তিনি নিষ্ঠাবান হতে পারেন, কিন্তু কমিটিতে তাঁকে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনগণের কাছে নির্দলীয় প্রতীয়মান হওয়ার সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
অতীতে সাধারণ নির্বাচনের অব্যবহিত আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হতে আমরা দেখেছি। যাঁরা এখন সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার হবেন, তাঁরা যদি দুই বছর পরে সরে দাঁড়ানোর মানসিকতা এখনই বিবেচনায় নেন, তাহলে উত্তম। সিইসি বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে সরিয়ে বিচারপতি আব্দুর রউফ, বিচারপতি কে এম সাদেককে সরিয়ে আবু হেনা, বিচারপতি এম এ আজিজকে সরিয়ে ড. এ টি এম শামসুল হুদাকে আমরা সিইসি হতে দেখেছি। সুতরাং অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে বলেই যেকোনো মূল্যে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে, এ মানসিকতা যেন নবাগতদের না থাকে। তবে অযৌক্তিক কারনে সাংবিধানিক পদাধিকারীদের পদত্যাগও সমীচীন মনে করিনা।
রেলমন্ত্রী বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে অনুসন্ধান কমিটি হয়েছে। তিনি ড. খানের সঙ্গে একমত হন যে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া আর সব কাজে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এখন অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়েই তবে বঙ্গভবনে যাবে। কমিটি প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজন করে নাম প্রস্তাব করবে। এখন সর্বোচ্চ পাঁচজন ও সর্বনিম্ন দুজনকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা যাবে। কমিটি দলগুলোর কাছে পাঁচটি করে নাম চেয়েছে। তবে রাষ্ট্রপতি আপাতত দুজনকে দিয়েই ইসি করতে পারেন। পরে বিএনপি ও অন্যান্য দলের পরামর্শে তিনজন নিয়োগের পথ খোলা থাকবে।
তিনটি বিষয় ইসি গঠন-প্রক্রিয়ায় বিবেচনাযোগ্য। প্রথমত, কমিটিকে মনে রাখতে হবে, সুপ্রিম কোর্ট স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচারক বাছাইয়ের আইন না মেনে পার পাচ্ছেন। কিন্তু এবার তাঁরা পার না-ও পেতে পারেন। ওই ঘটনায় হরতালের ঝুঁকি ছিল না। কিন্তু এবার হরতালের ঝুঁকি থাকবে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী চাইলে পোস্টবক্সের ভূমিকা পালন করতে পারেন। রাষ্ট্রপতিকে একক কর্তৃত্ব পালনের সুযোগ দিতে পারেন। সংবিধান অন্তরায় হবে না। প্রধানমন্ত্রী চাইলে ওই ১০ জনের মধ্য থেকে কাদের বিষয়ে তাঁর সমর্থন রয়েছে, তা রাষ্ট্রপতিকে জানাতে পারেন। ধরা যাক, জনাব ক ও খ-কে সিইসি নিয়োগের জন্য কমিটি সুপারিশ করল। প্রধানমন্ত্রী খ-কে নিয়োগ দিতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিলেন। এটা ঘটলে রাষ্ট্রপতিকে ক নয়, খ-কে নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু কমিটি যদি আগেই তার তালিকা প্রকাশ করে এবং সেভাবেই যদি তা রাষ্ট্রপতির কাছে যায়, তাতে বিতর্ক কম হবে।
সুতরাং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করবে কি না, সেটা আমরা ১০ কার্যদিবস পরেই জানতে পারব। জেনে ভালো লাগল যে ক্ষমতাসীন দল অস্পষ্টভাবে হলেও নির্বাচনকালে ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের’ কিংবা ক্ষমতার মুঠো আলগা করার একটা প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।
বিএনপির উচিত হবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিবাচক ইঙ্গিতসংবলিত গুপ্ত-ফর্মুলাকে আরও আলোকিত করা। অনুসন্ধান কমিটিসংক্রান্ত আধাখেঁচড়া প্রজ্ঞাপনটির সূত্র ধরে সংসদে একটি বিল আনার সুবর্ণ সুযোগ লুফে নেওয়া। এটা তারা সংসদের বাইরে ‘বিকল্প বাজেটের’ মতো সংবাদ সম্মেলন করেও দিতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকেও তাদের উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলের একটি খসড়া প্রকাশ করা।
ক্ষমতাসীনেরা সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের শর্ত কিন্তু আসলে পূরণ করল না। ভালো কাজেও ফাঁকি দিল। অন্যদিকে সংসদ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে পদ্ধতিগতভাবে প্রত্যাখ্যান করে তথাকথিত সুশাসন দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বিএনপিও দেশবাসীকে বোকা বানিয়ে চলেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments