বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ, বীর প্রতীক আহত হয়েও যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাননি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ সকালবেলা নিজেদের প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলো সুরক্ষিত করছেন। তখন আনুমানিক আটটা। এমন সময় শুরু হলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ। প্রথম গোলা এসে পড়ল তাঁর অবস্থান থেকে ২৫০-৩০০ গজ দূরে।
বিরাট আগুনের কুণ্ডলী আকাশের দিকে উঠে গেল। ভয় না পেয়ে সহযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করার জন্য তিনি দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিতে থাকলেন। দ্বিতীয় গোলা এসে পড়ল ঠিক তাঁর ১০০ গজ সামনে। এক-দেড় মিনিটের মধ্যে তৃতীয় গোলা এসে পড়ল একদম তাঁর কাছে। কোনো কিছু বোঝার আগেই বাতাসের প্রবল ধাক্কা তাঁকে শূন্যে অনেক ওপরে তুলে দরাম করে নিচে ফেলল। প্রথমে তিনি বুঝতে পারেননি। একটু পর তীব্র ব্যথায় বুঝতে পারলেন তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে গোলার স্প্লিন্টারের টুকরা লেগেছে। তাঁর গোটা শরীর রক্তাক্ত। সফিকউল্লাহ ভয় পেলেন না, দমেও গেলেন না। একজন এসে তাঁর ক্ষতস্থানে দ্রুত ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। তীব্র ব্যথা-জ্বালা উপেক্ষা করে তিনি সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দিতে থাকলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। একসময় অচেতন হয়ে পড়লেন। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। বালিয়াডাঙ্গায়।
বালিয়াডাঙ্গা সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার অন্তর্গত। বালিয়াডাঙ্গার পশ্চিমে ভারতের পশ্চিম বাংলা রাজ্যের সীমান্ত। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সাতক্ষীরা-যশোর এলাকায় ভারত সীমান্ত বরাবর প্রতিরক্ষা অবস্থান সুদৃঢ় করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান দুর্বল করার জন্য আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার অংশহিসেবে মোহাম্মদ সফিকউল্লাহর নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ১৬ সেপ্টেম্বর সীমান্ত অতিক্রম করে বালিয়াডাঙ্গায় অবস্থান নেয়। ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করে। সেদিন সারা দিন যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা মোহাম্মদ সফিকউল্লাহর নেতৃত্বে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। পাকিস্তানিরা বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করে। মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ সে সব উপেক্ষা করে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যান। ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছোড়া গোলার স্প্লিন্টারে মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ আহত হন। আহত হয়েও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাননি। একজন সহযোদ্ধা তাঁর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ার পর ওই অবস্থাতেই ঘণ্টা খানেক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এরপর তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। কয়েক ঘণ্টা পর সতেজ হয়ে আবার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এতে তাঁর সহযোদ্ধারা উদ্দীপ্ত হন।
মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ ১৯৭১ সালে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের বাংলার শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পরে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের হাকিমপুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁকে ক্যাপ্টেন উপাধি প্রদান করা হয়।
বালিয়াডাঙ্গার যুদ্ধ এত ভয়াবহ, লোমহর্ষক ও মারাত্মক ছিল যে আজও সে কথা মনে করলে ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা শিউরে ওঠেন। ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এম এ মঞ্জুর বীর উত্তমের মতে ‘বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধ ছিল যুদ্ধ-জগতের এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী সংঘর্ষ।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২৩।
মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে অবসর নেন। তখন তাঁর পদবি ছিল কর্নেল। ২০০৮ সালে তিনি মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার কৈলাইন গ্রামে। বাবার নাম সাহেবউল্লাহ, মা রাবেয়া খাতুন। স্ত্রী নাসিমা আক্তার। তাঁর এক ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮ এবং মুক্তিযুদ্ধে আট নম্বর সেক্টর, বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধ, কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
বালিয়াডাঙ্গা সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার অন্তর্গত। বালিয়াডাঙ্গার পশ্চিমে ভারতের পশ্চিম বাংলা রাজ্যের সীমান্ত। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সাতক্ষীরা-যশোর এলাকায় ভারত সীমান্ত বরাবর প্রতিরক্ষা অবস্থান সুদৃঢ় করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান দুর্বল করার জন্য আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার অংশহিসেবে মোহাম্মদ সফিকউল্লাহর নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ১৬ সেপ্টেম্বর সীমান্ত অতিক্রম করে বালিয়াডাঙ্গায় অবস্থান নেয়। ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করে। সেদিন সারা দিন যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা মোহাম্মদ সফিকউল্লাহর নেতৃত্বে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। পাকিস্তানিরা বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করে। মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ সে সব উপেক্ষা করে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যান। ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছোড়া গোলার স্প্লিন্টারে মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ আহত হন। আহত হয়েও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাননি। একজন সহযোদ্ধা তাঁর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ার পর ওই অবস্থাতেই ঘণ্টা খানেক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এরপর তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। কয়েক ঘণ্টা পর সতেজ হয়ে আবার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এতে তাঁর সহযোদ্ধারা উদ্দীপ্ত হন।
মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ ১৯৭১ সালে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের বাংলার শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পরে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের হাকিমপুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁকে ক্যাপ্টেন উপাধি প্রদান করা হয়।
বালিয়াডাঙ্গার যুদ্ধ এত ভয়াবহ, লোমহর্ষক ও মারাত্মক ছিল যে আজও সে কথা মনে করলে ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা শিউরে ওঠেন। ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এম এ মঞ্জুর বীর উত্তমের মতে ‘বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধ ছিল যুদ্ধ-জগতের এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী সংঘর্ষ।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২৩।
মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে অবসর নেন। তখন তাঁর পদবি ছিল কর্নেল। ২০০৮ সালে তিনি মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার কৈলাইন গ্রামে। বাবার নাম সাহেবউল্লাহ, মা রাবেয়া খাতুন। স্ত্রী নাসিমা আক্তার। তাঁর এক ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮ এবং মুক্তিযুদ্ধে আট নম্বর সেক্টর, বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধ, কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments