ফেসবুক, টুইটার, ব্লগে তারুণ্যের নেতৃত্বে গণজাগরণ ॥ দেশে দেশে এবং বাংলাদেশে by মহিউদ্দিন আহমদ
শাহবাগ স্কোয়ারে আমি শুক্রবার ৮ জানুয়ারি
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত হাঁটতে থাকি। সঙ্গে স্ত্রী
বিলকিস এবং বন্ধু মিলন দত্ত। মিলন কাস্টমসের অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা,
এখন ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন এবং পূজা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত।
বিকেল
৩টায় ফেনী থেকে বাসে করে ঢাকার কমলাপুর বাসস্টপে নেমেছি। রওনা হয়েছিলাম
সকাল সাড়ে ৯টায়। সবটুকু পথ ঠিকই আসতে পারলাম, কিন্তু যাত্রাবাড়ী এসে প্রায়
দুই ঘণ্টার ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকলাম। কমলাপুর থেকে উত্তরা একঘণ্টা;
তারপর গোসল, দুপুরের খাওয়া, একটু বিশ্রাম, তারপর সন্ধ্যা ৬টায় শাহবাগ
চত্বরের উদ্দেশে রওনা। বিশ্রামের সময় শুয়ে শুয়ে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে
শাহবাগ স্কোয়ারের অনুষ্ঠানগুলোর সরাসরি সম্প্রচার দেখছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত
নিই, শরীরের অবস্থা যাই হোক, ক্লান্তি যতই ‘ওভার পাওয়ারিং’ হোক না কেন, এই
জায়গায় যেতেই হবে, এখানে ইতিহাস রচিত হয়েছে, এখানে ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে।
রবিবার ৪ ফেব্রুয়ারি সকালের ‘মহানগর প্রভাতী’ ট্রেন ধরে প্রথমে ফেনী স্টেশন, তারপর ফুলগাজী থানায় গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ দেখার, গ্রামগঞ্জে বেড়ানোর এটাই উত্তম সময়। শীত কমে আসছে, গরমও পড়েনি। গ্রামের রাস্তাঘাট ধরে প্রতিদিন চার-পাঁচ মাইল হেঁটেছি! ভেবেছিলাম তিনদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলাবেষ্টিত এই জায়গাগুলোর কিছু অপরূপ দৃশ্য এবং এই ঘোরাঘুরিকালে অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করব আজকের এই কলামে। কিন্তু না, সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। উত্তরায় বাসা থেকে স্ত্রী বিলকিস ৫ তারিখ সন্ধ্যায় টেলিফোনে বলেছিল, তুমি জান না, তুমি বুঝতে পারছ না, তুমি কি ‘মিস’ করছ, টিভির সরাসরি সম্প্রচারে আমরা শাহবাগে তারুণ্যের জোয়ার দেখতে পাচ্ছি। একটু পর বন্ধু তাজুল ইসলাম শাহবাগ স্কোয়ার থেকে মোবাইলে আমাকে ধারাবর্ণনা দিচ্ছিলেন। তাজুল ইসলাম প্রবলভাবে বঙ্গবন্ধুভক্ত। ছোটখাটো শিপিং ব্যবসা আছে তার, মতিঝিলে অফিস, বাড়ি নরসিংদীর বেলাব। কয়েক বছর আগে যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম পাকিস্তানকে হারাল, এই বিজয় উদযাপন করতে তার শাহজাহানপুরের বাড়ির ছাদে গরু জবাই করে ‘জেয়াফত’ দিয়েছিল তাজুল ইসলাম। ইনকিলাব নামক পত্রিকা নামের আড়ালে মৌলবাদী সংগঠনটি যখন বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস কলুষিত করছিল, বাংলাদেশের মাটিকে বিষাক্ত করে তুলছিল, তখন আমরা ইনকিলাবের তালেবানী সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালিয়েছি, সেই সংগ্রাম-আন্দোলনে তাজুল ইসলাম এবং মিলন দত্ত কখনও প্রকাশ্যে, কখনও পরোক্ষভাবে প্রবল ভূমিকা রেখেছে। টিভি এবং প্রিন্ট মিডিয়ার কোথাও কোথাও সাংবাদিকতায় ধান্ধাবাজি এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আদর্শ-উদ্দেশ্যের বিকৃতির বিরুদ্ধে তাদের প্রকাশ্য অবস্থান এখনও অব্যাহত আছে।
॥ দুই ॥
শুক্রবার বিকেলের মহাসমাবেশে উপরে বর্ণিত কারণে উপস্থিত থাকতে পারিনি; তবে টেলিভিশনে মহাসমাবেশের ঘোষণা এবং তার আগে কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতাগুলো শুনেছি। রং বদলানো এক সাংবাদিকের উপস্থিতি আমাকে আহত করেছে। তবে ডক্টর জাফর ইকবালের কয়েক মিনিটের কথাগুলো আমাকে প্রত্যাশিতভাবেই উৎসাহিত করেছে। তার কথায় আমার নিজের আবেগ অনুভূতিগুলোরও প্রতিফলন দেখতে পাই। আমাদের তরুণ-তরুণীরাই আমাদের দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তারাই সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকবে, তারাই রাস্তায় নামবে, আন্দোলন সংগ্রাম করবে, তারা অবশ্যই লেখাপড়ায় ভাল করবে, এবং একই সঙ্গে তারা প্রেম-ভালবাসাও চালিয়ে যাবে। এই বয়সটাই তো প্রেম ভালবাসার।
শাহবাগ স্কোয়ারে হাঁটাহাঁটির সময় মিলন দত্ত, আমাদের ‘গাইড’। মিলন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, দেখুন একজন ‘ভলান্টিয়ারও’ নেই কোথাও, কোন দৃশ্যমান নেতৃত্বও নেই, নেই কোন বিশৃঙ্খলা, কোন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ। ছেলেমেয়েরা পাশাপাশি বসে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে সেøাগানের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে এবং কত রকমের সেøাগান! যে মেয়েটি কোন রকমের ক্লান্তি ছাড়া, একটির পর একটি সেøাগান দিয়ে যাচ্ছিল, তাকে দেখার খুবই ইচ্ছা হচ্ছিল, এই তরুণীটি গলায় এত শক্তি কোথায় পেল। কিন্তু কাছে ঘেঁষতেই পারলাম না। হাঁটতে হাঁটতে আমি ভাবতে থাকি। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর ভারতের অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ধ্বংসের উন্মাদ প্রতিক্রিয়ায় কিছু লম্বা কুর্তা পরিহিতি তরুণ ঢাকার তোপখানা রোডে কেমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। এখনও তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় তেমন হামলা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মানুষ হত্যা করে চলেছে। তার বিপরীতে “প্রজন্ম একাত্তর” স্কোয়ারের এই জমায়েতে, এই সমাবেশে সামান্যতম সহিংসতা নেই। বুঝতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই ছেলেমেয়েগুলো বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চায়। কতসব বিশাল বিশাল ত্যাগ, ‘সাফারিংস’-এর বিনিময়ে এই দেশটি অর্জিত হয়েছে। তার বিপরীতে, জামায়াত-শিবির একাত্তরে বাংলাদেশ চায়নি, তাদের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত, হত্যাকা-, সব কিছুকে ব্যর্থ করে দিয়ে তখন এই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সুতরাং তারা চাইছে এখনও, যেমন চেয়েছিল তারা ১৯৭১-এ, এই দেশটি যেন সফল না হয়। বাংলাদেশের ব্যর্থতায় তাদের আনন্দ। বাংলাদেশ ব্যর্থ হলে তাদের সাফল্য।
১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর তারা পুরানা পল্টনের ‘কম্যুনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ’-এর অফিসে ঢুকে লেনিন, মার্ক্স-এর মূর্তিগুলো বের করে এনে সেগুলোতে আগুন দিয়েছিল। কিন্তু বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের কতগুলো জায়গায় যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উত্তেজনা চলছিল, তখন কিন্তু পশ্চিম বাংলায় এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। কারণ পশ্চিম বাংলায় তখন জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কিন্তু এই দিকটি লক্ষ্য করার শিক্ষা বা ব্যাকগ্রাউন্ড বাংলাদেশের এই ধর্মান্ধ লোকগুলোর ছিল না। কার্ল মার্ক্স এবং লেনিন নাস্তিক, সুতরাং মূর্তি হলেও তাতে আগুন দিতে হবে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক আদর্শে দীক্ষিত পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা দিচ্ছে, তা কোন বিবেচনার বিষয় নয়,Ñএই আক্রোশে তাড়িত হতে সেদিন এই ধর্মান্ধ লোকগুলোকে দেখেছিলাম। ’৭১-এও তারা তা-ই ছিল, তারা এখনও তাই আছে।
১৯৯০ এর ডিসেম্বরের এরশাদ পতনের আগে বা পরে এবং তারপর ঢাকা শহরে যত রকমের আন্দোলন সমাবেশ হয়েছে, সবই দেখেছি। কোন কোনটিতে সরাসরি উপস্থিতও থেকেছি। লগি-বৈঠার কর্মসূচীতে নূর হোসেন চত্বরে আমরা স্বামী-স্ত্রী লগি বৈঠা হাতে ছবি তুলেছি। ১৯৯৬-এর মার্চে তোপখানা রোড জনতার মঞ্চের চারপাশে দিনের পর দিন ঘুরঘুর করেছি। ১৯৭১-এর ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালীদের বৃহত্তম সমাবেশে পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারির পদ থেকে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করেছি; একই দিন আটলান্টিকের ওপারে নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ জর্জ হ্যারিসন গান গেয়েছেন, প-িত রবিশংকর সেতার বাজিয়েছেন। কিন্তু এইসব স্কোয়ারের কোনটিই শাহবাগের এই “প্রজন্ম একাত্তর” স্কোয়ারের মতো ছিল না।
এই স্কোয়ারে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে শতাধিক গ্রুপে জড়ো হয়েছে, বসে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সেøাগান তুলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদ-ের দাবি তুলেছে তারা।
ঢাকার শাহবাগ স্কোয়ারে যখন এমন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ দেখছি, আমার মনে পড়ে এখন মিসরের কায়রোর তাহরীর স্কোয়ারেও বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ চলছে তিউনিসিয়াতেও। কায়রোতে বিক্ষোভ চলছে মিসরের নতুন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ র্মুসী এত বছরের অনুসৃত ‘সেক্যুলারণ্ড অসাম্প্রদায়িক মিসরকে একটি সাম্প্রদায়িক চেহারা-চরিত্র দিতে চাইছেন। র্মুসীর সরকারটিও যে একটি জামায়াতী সরকার, ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর সরকার। আর তিউনিসিয়ার চলমান বিক্ষোভ এই দেশটির একজন শীর্ষ ‘সেক্যুলার’ নেতা শুকরী বেলায়েতের হত্যার প্রতিবাদে। শুকরী বেলায়েতকে তিউনিসিয়ার ‘এন্নাহদা’ নামের জামায়াতে ইসলাম দলটির আততায়ীরা হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জামাত-শিবিরের চরিত্র সব দেশেই এক রকম। হত্যা, খুন, ষড়যন্ত্র তাদের ঈমানের অঙ্গ।
বাংলাদেশের এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও সেক্যুলারিজম, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-সমাজ প্রতিষ্ঠার একটি আগ্রহ, অঙ্গীকার প্রবলভাবেই লক্ষ্য করছি। ‘জয়বাংলা’, ‘বাংলার জয়’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’
তুমি কে, আমি কেÑবাঙ্গালী বাঙ্গালীÑএসব সেøাগানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ-উদ্দেশ্য-লক্ষ্য উৎকৃষ্টভাবে প্রতিফলিত হতে দেখি এই তারুণ্যের জোয়ার, আর মনে মনে উজ্জীবিত হই। দূরের লন্ডন থেকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একটু সম্পৃক্ত ছিলাম বলে আবার নতুন করে গৌরব ও গর্ব বোধ করতে থাকি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, ১৯৭৫-এর পর এই সেøাগানগুলো এমন দৃপ্ত উচ্চারণে বাংলাদেশের কোথাও, ঢাকার কোন রাস্তায় বা স্কোয়ারে গত ৩৭ বছরে কখনও শুনেছি বলে মনে করতে পারছি না। সাড়ে ৮টার দিকে যখন বাসায় ফেরার পথে শিশুপার্কের সামনে, দেখি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী এক ভদ্রলোক তিনি আজিমপুর থাকেন, ব্যবসায় করেন; তার দুই হাতে সাত আটটি শিশুকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। এই শিশুগুলোর সবচাইতে বড়টির বয়স ছয় হবে, সবচাইতে ছোটটির বোধহয়, তিন। ছোটটিকে উদ্দেশ করে আমি বলি, বলো, ‘জয় বাংলা’। শিশুটি লজ্জা পায়, মুখ লুকায়। আবারও আমি তাকে আহ্বান জানাই। কিন্তু এইবারও সে মুখ লুকায়। ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করি, শিশুগুলো তাঁর কি হয়? ভদ্রলোক তিনটি শিশুকে দেখিয়ে বলেন, এগুলো তার ছেলেমেয়ে; অন্যগুলো তার ভাইবোনের ছেলেমেয়ে। ভদ্রলোক শিশুগুলোকে উদ্দেশ করে এবার নিজেই বলেন, তোমরা বাসায় তো ‘জয়বাংলা’ সেøাগান দিয়ে থাক; তাহলে এখন দিচ্ছ না কেন? এইবার তিনি শিশুগুলোকে আহ্বান জানান, বলো আমার সঙ্গে, ‘জয় বাংলা’। শিশুগুলো তাদের কচি গলায় পুরো শক্তি ‘মোবিলাইজ’ করে চিৎকার করে বলে, ‘জয় বাংলা’। তাদের জয় বাংলা সেøাগানে আমার চোখে পানি আসে। বিলকিস এবং মিলন ভদ্রলোককে অনুরোধ করে, ‘প্লীজ’ ভাই, বাচ্চাগুলো যেন কোনভাবেই আপনার হাতছাড়া না হয়; এত মানুষের ভিড়ে যে কোন একটি দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
॥ তিন ॥
শাহবাগ স্কোয়ারের এই গণজাগরণের নেতৃত্বদানকারীদের একজন; ডাক্তার ইমরান সরকারকে প্রথম দেখি ধানম-ির ছায়ানট ভবনে গত ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কয়েক মিনিটের জন্য। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার দাওয়াতে আমার সস্ত্রীক ওখানে যাওয়া। উপলক্ষ, পার্বত্য-চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিল্পীদের অংশগ্রহণে বনপাহাড়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বৈভবের পরিবেশনার মাধ্যমে এক মঞ্চে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। নববিক্রমের স্ত্রী অনামিকা ত্রিপুরাও একজন সঙ্গীত শিল্পী। বছর দুই আগে আমার বাসা থেকে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি ত্রিপুরা ভাষায় টেলিফোনে গেয়ে লন্ডনে গাফফার ভাই, আবদুল গাফফার চৌধুরীকে শুনিয়েছিল অনামিকা। নিজ ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তাদের যেমন আগ্রহ, তেমন আগ্রহ তাদের বাংলাভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতিও। নববিক্রম অনামিকা দম্পতির ছেলে অমিত,-
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে আমাদের বেরিয়ে আসার সময় পরিচয় করিয়ে দিল ইমরানের সঙ্গে। তারা,- ব্লগাররা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারে, নিতে চায়, তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা, তার একটু বর্ণনা দিল ইমরান তখন। তখন মোটেও ভাবিনি, এই বালকের মধ্যে এত আগুন। এই তরুণের মধ্যে আগুন আছে, তা মনে হলো না দ্বিতীয় সাক্ষাতে, ৩০ দিন পর, ১ ফেব্রুয়ারিতে, পাবলিক লাইব্রেরীর সেমিনার হলে। আগুন আছে মনে হলো না তখন অন্য বালক-বালিকাগুলোর মধ্যেও। ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে অমর একুশের বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে এবং বইমেলায় একটু ঘোরাঘুরি করে সতীর্থ বন্ধু আমিনুল ইসলাম বেদুসহ জাতীয় কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে যাব বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছি। আর তখনই মোবাইলে টেলিফোন, স্যার, আমি ইমরান বলছি আপনার জন্য আমরা যে অপেক্ষা করছি। মনে পড়ল, ইমরানকে বলেছিলাম, তাদের ‘ব্লগারস এ্যান্ড অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক’-এর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারব বলে তাকে কয়েক দিন আগে কথা দিয়েছিলাম; কিন্তু তারা আমার জন্য অপেক্ষা করবে, এমন কথা ছিল না। বেদুকে বললাম, জাতীয় কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে পরে, রাতেও যাওয়া যাবে, চল এখন পাবলিক লাইব্রেরীতে যাই।
পাবলিক লাইব্রেরীর ছোট একটি কামরা, ৫০ জনের মতো তরুণ-তরুণী। আমরা তিনজন মাত্র প্রবীণ,Ñ সাংবাদিক শামসুল আরেফীন খান, বেদু এবং আমি। আর সকলেই পঁচিশ তিরিশ। শেষদিকে আমাকে যখন কিছু বলতে ডাকা হলো, শুরু করার আগে জিজ্ঞাসা করলাম আমার জন্য বরাদ্দ কত মিনিট? ইমরান প্রথমে একটু হেসে বলল, এক মিনিট; পরে বলল, ঠিক আছে, দেড় মিনিট। আমি কিন্তু তার কথা না শুনে পাঁচ ছয় মিনিট বললাম।
আমি বললাম, মাত্র ৪ দিন আগে, ২৭ জানুয়ারিতে বিবিসি টিভিতে প্রচারিত “ওয়ার্ল্ড ডিবেট”এ তুর্কী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ ডাভুটুগ্লোর নিজ জীবনের একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা। আরব দুনিয়ায় ‘ইজ ডেমোক্র্যাসি উইনিং’ শিরোনামের এই বিতর্কে অংশগ্রহণ আরও করেন, আরব লীগের সাবেক এক সেক্রেটারি-জেনারেল আমর মুসা, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই, নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টম্ ফ্রিডম্যান।
আহমেদ ডাভুটুগ্লো অনুষ্ঠানে বলছিলেন, তাঁর বাসায় পুরনো জামানার একটি টাইপরাইটার আছে। এই টাইপরাইটারে তিনি তার থিস্সিটা লিখেছিলেন বলে টাইপরাইটারটির প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। টাইপরাইটারটি যখন তিনি নিয়েছিলেন, তখন হোসনি মোবারক মিসরের প্রেসিডেন্ট। তারপর যখন কম্পিউটারের প্রচলন শুরু হয়, তখনও হোসনি মোবারক মিসরের প্রেসিডেন্ট। তারপর যখন ইন্টারনেট আসে, তখনও হোসনি মোবারক প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তারপর যখন ফেসবুক এবং টুইটার এল, একটানা ৩০ বছরের ডিক্টেটর হোসনি মোবারক উড়ে গেলেন। তারপর হোসনী মোবারক গেলেন দুই পুত্র নিয়ে জেলে, তারপর তার যাবজ্জীবন কারাদ-।
১ ফেব্রুয়ারির পর মাত্র পাঁচ দিন। তিরিশ-চল্লিশ তরুণ-তরুণ, তারা ‘ব্লগারস’ এবং ‘অনলাইন এক্টিভিস্ট’; তারা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল। তারা ইতিহাস সৃষ্টি করল। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তারা তারুণ্যের এমন শক্তি ক্ষমতা আবেগ, দেশপ্রেম মানুষের জন্য ভালবাসা ভবিষ্যতেও দেখাতে থাকবে। তারাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়বে। গত ৪২ বছরের অনেকগুলো বছর আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, বারবার আমি কেবলই স্বপন করেছি
বপন বাতাসে
তাই আকাশকুসুম ভরিনু যেন
হুতাসে।
আমার এখন দুঃখ, আমার বয়স যদি আজ ৫০ বছর কম হতো, তাহলে তাদের সঙ্গে আমিও আবার মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ, সমাবেশে সক্রিয়ভাবে যোগ দিতে পারতাম। আর ভাবতেও পারতাম এখন যৌবন যার, মিছিলে, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
‘শিউলীতলা’, উত্তরা; শনিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি
mohiuddinahmed1944@yahoo.com
রবিবার ৪ ফেব্রুয়ারি সকালের ‘মহানগর প্রভাতী’ ট্রেন ধরে প্রথমে ফেনী স্টেশন, তারপর ফুলগাজী থানায় গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ দেখার, গ্রামগঞ্জে বেড়ানোর এটাই উত্তম সময়। শীত কমে আসছে, গরমও পড়েনি। গ্রামের রাস্তাঘাট ধরে প্রতিদিন চার-পাঁচ মাইল হেঁটেছি! ভেবেছিলাম তিনদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলাবেষ্টিত এই জায়গাগুলোর কিছু অপরূপ দৃশ্য এবং এই ঘোরাঘুরিকালে অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করব আজকের এই কলামে। কিন্তু না, সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। উত্তরায় বাসা থেকে স্ত্রী বিলকিস ৫ তারিখ সন্ধ্যায় টেলিফোনে বলেছিল, তুমি জান না, তুমি বুঝতে পারছ না, তুমি কি ‘মিস’ করছ, টিভির সরাসরি সম্প্রচারে আমরা শাহবাগে তারুণ্যের জোয়ার দেখতে পাচ্ছি। একটু পর বন্ধু তাজুল ইসলাম শাহবাগ স্কোয়ার থেকে মোবাইলে আমাকে ধারাবর্ণনা দিচ্ছিলেন। তাজুল ইসলাম প্রবলভাবে বঙ্গবন্ধুভক্ত। ছোটখাটো শিপিং ব্যবসা আছে তার, মতিঝিলে অফিস, বাড়ি নরসিংদীর বেলাব। কয়েক বছর আগে যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম পাকিস্তানকে হারাল, এই বিজয় উদযাপন করতে তার শাহজাহানপুরের বাড়ির ছাদে গরু জবাই করে ‘জেয়াফত’ দিয়েছিল তাজুল ইসলাম। ইনকিলাব নামক পত্রিকা নামের আড়ালে মৌলবাদী সংগঠনটি যখন বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস কলুষিত করছিল, বাংলাদেশের মাটিকে বিষাক্ত করে তুলছিল, তখন আমরা ইনকিলাবের তালেবানী সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালিয়েছি, সেই সংগ্রাম-আন্দোলনে তাজুল ইসলাম এবং মিলন দত্ত কখনও প্রকাশ্যে, কখনও পরোক্ষভাবে প্রবল ভূমিকা রেখেছে। টিভি এবং প্রিন্ট মিডিয়ার কোথাও কোথাও সাংবাদিকতায় ধান্ধাবাজি এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আদর্শ-উদ্দেশ্যের বিকৃতির বিরুদ্ধে তাদের প্রকাশ্য অবস্থান এখনও অব্যাহত আছে।
॥ দুই ॥
শুক্রবার বিকেলের মহাসমাবেশে উপরে বর্ণিত কারণে উপস্থিত থাকতে পারিনি; তবে টেলিভিশনে মহাসমাবেশের ঘোষণা এবং তার আগে কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতাগুলো শুনেছি। রং বদলানো এক সাংবাদিকের উপস্থিতি আমাকে আহত করেছে। তবে ডক্টর জাফর ইকবালের কয়েক মিনিটের কথাগুলো আমাকে প্রত্যাশিতভাবেই উৎসাহিত করেছে। তার কথায় আমার নিজের আবেগ অনুভূতিগুলোরও প্রতিফলন দেখতে পাই। আমাদের তরুণ-তরুণীরাই আমাদের দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তারাই সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকবে, তারাই রাস্তায় নামবে, আন্দোলন সংগ্রাম করবে, তারা অবশ্যই লেখাপড়ায় ভাল করবে, এবং একই সঙ্গে তারা প্রেম-ভালবাসাও চালিয়ে যাবে। এই বয়সটাই তো প্রেম ভালবাসার।
শাহবাগ স্কোয়ারে হাঁটাহাঁটির সময় মিলন দত্ত, আমাদের ‘গাইড’। মিলন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, দেখুন একজন ‘ভলান্টিয়ারও’ নেই কোথাও, কোন দৃশ্যমান নেতৃত্বও নেই, নেই কোন বিশৃঙ্খলা, কোন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ। ছেলেমেয়েরা পাশাপাশি বসে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে সেøাগানের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে এবং কত রকমের সেøাগান! যে মেয়েটি কোন রকমের ক্লান্তি ছাড়া, একটির পর একটি সেøাগান দিয়ে যাচ্ছিল, তাকে দেখার খুবই ইচ্ছা হচ্ছিল, এই তরুণীটি গলায় এত শক্তি কোথায় পেল। কিন্তু কাছে ঘেঁষতেই পারলাম না। হাঁটতে হাঁটতে আমি ভাবতে থাকি। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর ভারতের অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ধ্বংসের উন্মাদ প্রতিক্রিয়ায় কিছু লম্বা কুর্তা পরিহিতি তরুণ ঢাকার তোপখানা রোডে কেমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। এখনও তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় তেমন হামলা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মানুষ হত্যা করে চলেছে। তার বিপরীতে “প্রজন্ম একাত্তর” স্কোয়ারের এই জমায়েতে, এই সমাবেশে সামান্যতম সহিংসতা নেই। বুঝতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই ছেলেমেয়েগুলো বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চায়। কতসব বিশাল বিশাল ত্যাগ, ‘সাফারিংস’-এর বিনিময়ে এই দেশটি অর্জিত হয়েছে। তার বিপরীতে, জামায়াত-শিবির একাত্তরে বাংলাদেশ চায়নি, তাদের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত, হত্যাকা-, সব কিছুকে ব্যর্থ করে দিয়ে তখন এই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সুতরাং তারা চাইছে এখনও, যেমন চেয়েছিল তারা ১৯৭১-এ, এই দেশটি যেন সফল না হয়। বাংলাদেশের ব্যর্থতায় তাদের আনন্দ। বাংলাদেশ ব্যর্থ হলে তাদের সাফল্য।
১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর তারা পুরানা পল্টনের ‘কম্যুনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ’-এর অফিসে ঢুকে লেনিন, মার্ক্স-এর মূর্তিগুলো বের করে এনে সেগুলোতে আগুন দিয়েছিল। কিন্তু বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের কতগুলো জায়গায় যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উত্তেজনা চলছিল, তখন কিন্তু পশ্চিম বাংলায় এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। কারণ পশ্চিম বাংলায় তখন জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কিন্তু এই দিকটি লক্ষ্য করার শিক্ষা বা ব্যাকগ্রাউন্ড বাংলাদেশের এই ধর্মান্ধ লোকগুলোর ছিল না। কার্ল মার্ক্স এবং লেনিন নাস্তিক, সুতরাং মূর্তি হলেও তাতে আগুন দিতে হবে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক আদর্শে দীক্ষিত পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা দিচ্ছে, তা কোন বিবেচনার বিষয় নয়,Ñএই আক্রোশে তাড়িত হতে সেদিন এই ধর্মান্ধ লোকগুলোকে দেখেছিলাম। ’৭১-এও তারা তা-ই ছিল, তারা এখনও তাই আছে।
১৯৯০ এর ডিসেম্বরের এরশাদ পতনের আগে বা পরে এবং তারপর ঢাকা শহরে যত রকমের আন্দোলন সমাবেশ হয়েছে, সবই দেখেছি। কোন কোনটিতে সরাসরি উপস্থিতও থেকেছি। লগি-বৈঠার কর্মসূচীতে নূর হোসেন চত্বরে আমরা স্বামী-স্ত্রী লগি বৈঠা হাতে ছবি তুলেছি। ১৯৯৬-এর মার্চে তোপখানা রোড জনতার মঞ্চের চারপাশে দিনের পর দিন ঘুরঘুর করেছি। ১৯৭১-এর ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালীদের বৃহত্তম সমাবেশে পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারির পদ থেকে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করেছি; একই দিন আটলান্টিকের ওপারে নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ জর্জ হ্যারিসন গান গেয়েছেন, প-িত রবিশংকর সেতার বাজিয়েছেন। কিন্তু এইসব স্কোয়ারের কোনটিই শাহবাগের এই “প্রজন্ম একাত্তর” স্কোয়ারের মতো ছিল না।
এই স্কোয়ারে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে শতাধিক গ্রুপে জড়ো হয়েছে, বসে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সেøাগান তুলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদ-ের দাবি তুলেছে তারা।
ঢাকার শাহবাগ স্কোয়ারে যখন এমন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ দেখছি, আমার মনে পড়ে এখন মিসরের কায়রোর তাহরীর স্কোয়ারেও বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ চলছে তিউনিসিয়াতেও। কায়রোতে বিক্ষোভ চলছে মিসরের নতুন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ র্মুসী এত বছরের অনুসৃত ‘সেক্যুলারণ্ড অসাম্প্রদায়িক মিসরকে একটি সাম্প্রদায়িক চেহারা-চরিত্র দিতে চাইছেন। র্মুসীর সরকারটিও যে একটি জামায়াতী সরকার, ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর সরকার। আর তিউনিসিয়ার চলমান বিক্ষোভ এই দেশটির একজন শীর্ষ ‘সেক্যুলার’ নেতা শুকরী বেলায়েতের হত্যার প্রতিবাদে। শুকরী বেলায়েতকে তিউনিসিয়ার ‘এন্নাহদা’ নামের জামায়াতে ইসলাম দলটির আততায়ীরা হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জামাত-শিবিরের চরিত্র সব দেশেই এক রকম। হত্যা, খুন, ষড়যন্ত্র তাদের ঈমানের অঙ্গ।
বাংলাদেশের এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও সেক্যুলারিজম, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-সমাজ প্রতিষ্ঠার একটি আগ্রহ, অঙ্গীকার প্রবলভাবেই লক্ষ্য করছি। ‘জয়বাংলা’, ‘বাংলার জয়’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’
তুমি কে, আমি কেÑবাঙ্গালী বাঙ্গালীÑএসব সেøাগানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ-উদ্দেশ্য-লক্ষ্য উৎকৃষ্টভাবে প্রতিফলিত হতে দেখি এই তারুণ্যের জোয়ার, আর মনে মনে উজ্জীবিত হই। দূরের লন্ডন থেকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একটু সম্পৃক্ত ছিলাম বলে আবার নতুন করে গৌরব ও গর্ব বোধ করতে থাকি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, ১৯৭৫-এর পর এই সেøাগানগুলো এমন দৃপ্ত উচ্চারণে বাংলাদেশের কোথাও, ঢাকার কোন রাস্তায় বা স্কোয়ারে গত ৩৭ বছরে কখনও শুনেছি বলে মনে করতে পারছি না। সাড়ে ৮টার দিকে যখন বাসায় ফেরার পথে শিশুপার্কের সামনে, দেখি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী এক ভদ্রলোক তিনি আজিমপুর থাকেন, ব্যবসায় করেন; তার দুই হাতে সাত আটটি শিশুকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। এই শিশুগুলোর সবচাইতে বড়টির বয়স ছয় হবে, সবচাইতে ছোটটির বোধহয়, তিন। ছোটটিকে উদ্দেশ করে আমি বলি, বলো, ‘জয় বাংলা’। শিশুটি লজ্জা পায়, মুখ লুকায়। আবারও আমি তাকে আহ্বান জানাই। কিন্তু এইবারও সে মুখ লুকায়। ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করি, শিশুগুলো তাঁর কি হয়? ভদ্রলোক তিনটি শিশুকে দেখিয়ে বলেন, এগুলো তার ছেলেমেয়ে; অন্যগুলো তার ভাইবোনের ছেলেমেয়ে। ভদ্রলোক শিশুগুলোকে উদ্দেশ করে এবার নিজেই বলেন, তোমরা বাসায় তো ‘জয়বাংলা’ সেøাগান দিয়ে থাক; তাহলে এখন দিচ্ছ না কেন? এইবার তিনি শিশুগুলোকে আহ্বান জানান, বলো আমার সঙ্গে, ‘জয় বাংলা’। শিশুগুলো তাদের কচি গলায় পুরো শক্তি ‘মোবিলাইজ’ করে চিৎকার করে বলে, ‘জয় বাংলা’। তাদের জয় বাংলা সেøাগানে আমার চোখে পানি আসে। বিলকিস এবং মিলন ভদ্রলোককে অনুরোধ করে, ‘প্লীজ’ ভাই, বাচ্চাগুলো যেন কোনভাবেই আপনার হাতছাড়া না হয়; এত মানুষের ভিড়ে যে কোন একটি দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
॥ তিন ॥
শাহবাগ স্কোয়ারের এই গণজাগরণের নেতৃত্বদানকারীদের একজন; ডাক্তার ইমরান সরকারকে প্রথম দেখি ধানম-ির ছায়ানট ভবনে গত ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কয়েক মিনিটের জন্য। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার দাওয়াতে আমার সস্ত্রীক ওখানে যাওয়া। উপলক্ষ, পার্বত্য-চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিল্পীদের অংশগ্রহণে বনপাহাড়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বৈভবের পরিবেশনার মাধ্যমে এক মঞ্চে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। নববিক্রমের স্ত্রী অনামিকা ত্রিপুরাও একজন সঙ্গীত শিল্পী। বছর দুই আগে আমার বাসা থেকে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি ত্রিপুরা ভাষায় টেলিফোনে গেয়ে লন্ডনে গাফফার ভাই, আবদুল গাফফার চৌধুরীকে শুনিয়েছিল অনামিকা। নিজ ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তাদের যেমন আগ্রহ, তেমন আগ্রহ তাদের বাংলাভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতিও। নববিক্রম অনামিকা দম্পতির ছেলে অমিত,-
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে আমাদের বেরিয়ে আসার সময় পরিচয় করিয়ে দিল ইমরানের সঙ্গে। তারা,- ব্লগাররা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারে, নিতে চায়, তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা, তার একটু বর্ণনা দিল ইমরান তখন। তখন মোটেও ভাবিনি, এই বালকের মধ্যে এত আগুন। এই তরুণের মধ্যে আগুন আছে, তা মনে হলো না দ্বিতীয় সাক্ষাতে, ৩০ দিন পর, ১ ফেব্রুয়ারিতে, পাবলিক লাইব্রেরীর সেমিনার হলে। আগুন আছে মনে হলো না তখন অন্য বালক-বালিকাগুলোর মধ্যেও। ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে অমর একুশের বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে এবং বইমেলায় একটু ঘোরাঘুরি করে সতীর্থ বন্ধু আমিনুল ইসলাম বেদুসহ জাতীয় কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে যাব বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছি। আর তখনই মোবাইলে টেলিফোন, স্যার, আমি ইমরান বলছি আপনার জন্য আমরা যে অপেক্ষা করছি। মনে পড়ল, ইমরানকে বলেছিলাম, তাদের ‘ব্লগারস এ্যান্ড অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক’-এর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারব বলে তাকে কয়েক দিন আগে কথা দিয়েছিলাম; কিন্তু তারা আমার জন্য অপেক্ষা করবে, এমন কথা ছিল না। বেদুকে বললাম, জাতীয় কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে পরে, রাতেও যাওয়া যাবে, চল এখন পাবলিক লাইব্রেরীতে যাই।
পাবলিক লাইব্রেরীর ছোট একটি কামরা, ৫০ জনের মতো তরুণ-তরুণী। আমরা তিনজন মাত্র প্রবীণ,Ñ সাংবাদিক শামসুল আরেফীন খান, বেদু এবং আমি। আর সকলেই পঁচিশ তিরিশ। শেষদিকে আমাকে যখন কিছু বলতে ডাকা হলো, শুরু করার আগে জিজ্ঞাসা করলাম আমার জন্য বরাদ্দ কত মিনিট? ইমরান প্রথমে একটু হেসে বলল, এক মিনিট; পরে বলল, ঠিক আছে, দেড় মিনিট। আমি কিন্তু তার কথা না শুনে পাঁচ ছয় মিনিট বললাম।
আমি বললাম, মাত্র ৪ দিন আগে, ২৭ জানুয়ারিতে বিবিসি টিভিতে প্রচারিত “ওয়ার্ল্ড ডিবেট”এ তুর্কী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ ডাভুটুগ্লোর নিজ জীবনের একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা। আরব দুনিয়ায় ‘ইজ ডেমোক্র্যাসি উইনিং’ শিরোনামের এই বিতর্কে অংশগ্রহণ আরও করেন, আরব লীগের সাবেক এক সেক্রেটারি-জেনারেল আমর মুসা, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই, নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টম্ ফ্রিডম্যান।
আহমেদ ডাভুটুগ্লো অনুষ্ঠানে বলছিলেন, তাঁর বাসায় পুরনো জামানার একটি টাইপরাইটার আছে। এই টাইপরাইটারে তিনি তার থিস্সিটা লিখেছিলেন বলে টাইপরাইটারটির প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। টাইপরাইটারটি যখন তিনি নিয়েছিলেন, তখন হোসনি মোবারক মিসরের প্রেসিডেন্ট। তারপর যখন কম্পিউটারের প্রচলন শুরু হয়, তখনও হোসনি মোবারক মিসরের প্রেসিডেন্ট। তারপর যখন ইন্টারনেট আসে, তখনও হোসনি মোবারক প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তারপর যখন ফেসবুক এবং টুইটার এল, একটানা ৩০ বছরের ডিক্টেটর হোসনি মোবারক উড়ে গেলেন। তারপর হোসনী মোবারক গেলেন দুই পুত্র নিয়ে জেলে, তারপর তার যাবজ্জীবন কারাদ-।
১ ফেব্রুয়ারির পর মাত্র পাঁচ দিন। তিরিশ-চল্লিশ তরুণ-তরুণ, তারা ‘ব্লগারস’ এবং ‘অনলাইন এক্টিভিস্ট’; তারা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল। তারা ইতিহাস সৃষ্টি করল। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তারা তারুণ্যের এমন শক্তি ক্ষমতা আবেগ, দেশপ্রেম মানুষের জন্য ভালবাসা ভবিষ্যতেও দেখাতে থাকবে। তারাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়বে। গত ৪২ বছরের অনেকগুলো বছর আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, বারবার আমি কেবলই স্বপন করেছি
বপন বাতাসে
তাই আকাশকুসুম ভরিনু যেন
হুতাসে।
আমার এখন দুঃখ, আমার বয়স যদি আজ ৫০ বছর কম হতো, তাহলে তাদের সঙ্গে আমিও আবার মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ, সমাবেশে সক্রিয়ভাবে যোগ দিতে পারতাম। আর ভাবতেও পারতাম এখন যৌবন যার, মিছিলে, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
‘শিউলীতলা’, উত্তরা; শনিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি
mohiuddinahmed1944@yahoo.com
No comments