'গলগণ্ড' শুধু ব্যাধিই নয়, সামাজিক সমস্যাও by ডা. এম এ করীম
দেশ এখন বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। বিদ্যুৎ, গ্যাস, যানজট, জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব এবং সর্বশেষ ইভ টিজিংয়ের মতো মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে। অবশ্য প্রায় সব কটি সমস্যা পৈতৃক সম্পত্তি পাওয়ার মতোই।
কিন্তু সমাজে আরো সমস্যা আছে যেগুলো এত প্রকট নয় সত্য, কিন্তু ধীরে ধীরে সেসব সমস্যা জাতিকে আরো বিপদগ্রস্ত করে তুলবে, যদি এখন থেকে জাতি এ ব্যাপারে সজাগ না হয়। সেগুলোরই একটি হলো 'গলগণ্ড' বা 'ঘ্যাগ'। আমরা রাস্তাঘাটে বা গ্রামগঞ্জে সচরাচর এ ধরনের রোগীর দেখা পাই। কিন্তু আমরা ততখানি গুরুত্বের সঙ্গে দেখি না। আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা। আমার এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। ছেলেপক্ষ আসবে মেয়েকে দেখতে। মেয়ের বাবা আমাকে অনুরোধ করেছেন অন্তত সেদিনের জন্য কষ্ট হলেও আমি যেন রংপুর যাই। কারণ মেয়ের মায়ের খুব ইচ্ছে, আমার উপস্থিতিতে বিয়ের কথাবার্তা যেন সম্পন্ন হয়। তাঁদের অনুরোধ আমি ফেলতে পারলাম না। ঘটনার দিন যখন পেঁৗছলাম ততক্ষণে মেয়ে দেখা শেষ হয়েছে। বাড়ি পেঁৗছে দেখি, বাড়িতে থমথমে ভাব। ছেলের বাবা এ ধরনের শারীরিক গঠনের মেয়েকে ঘরে তুলতে রাজি নন। আমি তো জানতাম মেয়েটি সুশ্রী ও সুঠাম দেহের অধিকারী। 'এ ধরনের শারীরিক গঠন' বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন জানতে চাইলে মেয়েকেই আমার কাছে হাজির করা হলো। মেয়ের মা মেয়ের গলা দেখিয়ে বললেন, "আমার মেয়ের নাকি 'ঘ্যাগ' হয়েছে, তাই তারা এ বিয়েতে নারাজ।" 'ভাই এটা কি খুব খারাপ রোগ? এটা কি ছোঁয়াচে?' প্রশ্নটা মেয়ের বাবার। মেয়েকে আমি ছোট বেলায় (৮-১০ বছর বয়সে) দেখেছিলাম। আর এখন দেখছি প্রায় ১৯ বছর পর।
ভাবছি, আমার দেশের জনগণ এখনো স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন নয়। তাহলে আমরা (২০২১ সালে) কিভাবে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' বিনির্মাণে সক্ষম হব! ভাইসাব, কী ভাবছেন? কিছু না; এটা তেমন কোনো কঠিন রোগ নয় বা ছোঁয়াচেও না। 'ঘ্যাগে'র আরেকটি নাম আছে, তা হলো 'গলগণ্ড'। গলার নিচে ফুলে ওঠা অংশকে 'গলগণ্ড' বলে। এটা থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ হওয়ার কারণেই হয়। এই গলাফোলা ছোটও হতে পারে আবার বড়ও হতে পারে। এক কথায় বলা যায়, থাইরয়েড গ্রন্থির ফুলে ওঠাকেই 'গলগণ্ড' বলা হয়। এ রোগ বেশির ভাগই মেয়েদের হয়। প্রথমে এটা ফুলে উঠলেও কোনো ব্যথা অনুভূত হয় না। ফলে যার এটা হয় সে কিন্তু ভালোভাবে বুঝতে পারে না। যদিও 'গলগণ্ড' রোগীরা ব্যথা অনুভব করে না; কিন্তু সময় সময় কাশি ও শ্বাসকষ্ট অনুভব করে। 'তা কিসের কারণে এ ধরনের রোগ হয়? প্রশ্ন আমার সেই ভেঙেপড়া আত্মীয়ের। এর প্রধান কারণ হলো, 'দেহে আয়োডিনের (একজন সুস্থ লোকের জন্য যা প্রয়োজন) অভাব হলে।' সে কারণে সব সময় প্রত্যেক মানুষকেই স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই প্রয়োজন। মেয়েদের শরীর পরিচর্যার সময় আয়নায় নিজ গলার দিকে তাকিয়ে দেখা প্রয়োজন, তার গলার সামনে ফোলা দেখা যায় কি না। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারে না। কখনো কখনো বিষণ্ন, কখনো আবার অস্থির ও মনমরা হতে দেখা যাবে। গলার স্বর ভেঙে যাবে, ঢোক গিলতে অসুবিধা মনে হবে। এসব শুনে মেয়ের বাবাকে খুব অস্থির দেখা গেল। 'এর কি কোনো চিকিৎসা নেই?' বললাম, আছে। আপনার মেয়ের যে অবস্থা তাতে রক্তের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করে, আলট্রাসাউন্ড ও পরমাণু চিকিৎসা (নিউক্লিয়ার মেডিসিন) পদ্ধতিতে রোগটা নির্ণয় করে সেই মোতাবেক চিকিৎসা করতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এ ধরনের রোগ বিস্তার করার আগেই এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। যেমন আয়োডিনের অভাব। মানুষ স্বাভাবিক 'আয়োডিন' গ্রহণ করে খাদ্যের মাধ্যমে। আর এসব খাদ্যে যদি 'আয়োডিন' কম থাকে তবে দেহেও 'আয়োডিন' কম হবে। 'থাইরয়েড গ্রন্থির' কার্যকারিতার জন্য এই আয়োডিনের প্রয়োজন হয়। এই গ্রন্থি থেকে যে 'হরমোন' শরীরে প্রবাহিত হয়, তা দেহের স্বাভাবিক গঠনে প্রয়োজন হয়ে পড়ে। শুধু শারীরিক নয় মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকরণের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় 'হরমোন'। এই আয়োডিনের ঘাটতির কারণে 'এনডেমিক গয়টার' বিস্তার লাভ করে। ফলে শিশুর (মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়) মস্তিষ্কের গঠন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শিশুর মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এমনকি বুদ্ধির পূর্ণতা অনেক সময় শিশু আর ফিরে পায় না। সারা বিশ্বে আয়োডিনের অভাব এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি চিহ্নিত হুমকি বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন। ১.৫ বিলিয়ন (১৫ কোটি) লোক সারা বিশ্বে আয়োডিনের অভাবের আওতায় আছে এবং এর মধ্যে প্রায় ৬৫৫ মিলিয়ন (ছয় কোটি ৫৫ লাখ) লোক এই রোগে আক্রান্ত।
ভারতে প্রায় ৭১ মিলিয়ন লোক এর আওতায় এবং প্রায় ২০০ মিলিয়ন আক্রান্ত। বাংলাদেশে বর্তমান সময়ের সঠিক হিসাব না থাকলে ১৯৯৩ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ৪৭ শতাংশ, এলাকার প্রকারভেদে এর তারতম্য ঘটে। প্রাকৃতিকভাবে 'আয়োডিন' মাটি এবং সমুদ্রের পানির মধ্যে পাওয়া যায়। আয়োডিনযুক্ত খাদ্যের প্রাপ্তিটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল। অনেক দেশে মানুষ 'আয়োডিনযুক্ত' লবণ (যদি না কোনো ব্যক্তির কাঁচা লবণ খাওয়ার নিষেধ না থাকে) ব্যবহার করে। সাধারণত দুগ্ধজাত খাদ্য, সামুদ্রিক খাদ্য, মাংস, কিছু কিছু রুটি ও ডিমের মধ্যে আয়োডিন বেশি পরিমাণে থাকে। কেউ আবার আয়োডিনযুক্ত ভিটামিন বড়িও ব্যবহার করেন। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, খাদ্যে আয়োডিন কিভাবে আসে তার উৎস এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি। একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য দৈনিক প্রায় ২২০ মাইক্রোগ্রাম এবং একটি নবজাতক শিশুর মায়ের জন্য (যিনি শিশুকে নিজের দুধ খাওয়ান) প্রায় ২৯০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন প্রয়োজন। আমেরিকা এবং কানাডাতে দেখা গেছে, প্রায় গর্ভবতী মা ও নবজাতক শিশুর মাকে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই মালটিভিটামিনের মাধ্যমে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন খাওয়ানো হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বেশি আয়োডিন খেলে কী সমস্যা দেখা দিতে পারে? এটা সমস্যা হতে পারে যাদের 'থাইরয়েড' গ্রন্থি সমস্যা আগে থেকে আছে তাদের বেলায় যেমন যাদের অতিমাত্রায় 'থাইরয়েড হরমোন' দেহে দেখা গেছে বা যাঁরা 'অটোএমিউন থাইরয়েড' সমস্যায় ভুগছেন। সে কারণে আয়োডিন গ্রহণ করার ব্যাপারেও সতর্ক থাকা দরকার। আর যদি কোনো শিশুর 'থাইরয়েড গ্রন্থি' দেহে না থাকে অথবা কম বৃদ্ধি পায়, বা কখনো কখনো এর জায়গায় না থেকে অন্য কোনোখানে (বিশেষ করে জিহ্বার পেছনে) থাকে তাহলেও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। মায়ের জেনেটিক সমস্যার কারণেও এটা দেখা যেতে পারে। অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই এ ধরনের রোগ হতে পারে। বাংলাদেশে এই প্রথম Institute of Nuclear Medicine and Ultrasound-এর অধ্যাপক ডা. মিজানুল হাসান ও অধ্যাপক ডা. ফরিদুল আলম মিলিতভাবে "Congenital-Hypothyroidisamoe প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। তাঁদের জরিপে এ পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে বাংলাদেশে দুই হাজার ২০০ নবজাতক শিশুর মধ্যে একটিকে পাওয়া যায় জন্মগত Hypothyroid হিসেবে; যেখানে অন্যান্য দেশে পাওয়া যায় পাঁচ হাজার নবজাতক শিশুর মধ্যে একটি। আমেরিকার এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিবছর ৬০-৭০টি নবজাতকের মধ্যে নতুন করে (Hypothyroid) পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৬০-৭০ জন (গত এক বছরে) পাওয়া গেছে। এটা দ্বিগুণও হতে পারে মেয়ে নবজাতকদের বেলায়। অঞ্চল ও জাতিভেদে পার্থক্য হয়ে থাকে। এশিয়া ও আমেরিকা অঞ্চলে বেশি হয় বলে জানা গেছে। এর চিকিৎসাও শুরু করতে হবে জন্মের এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, সব নবজাতককেই কি এ ধরনের প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে? যদি আনতে পারা যায় তবে ভালো। না হলে কিছু কিছু উপসর্গ আছে যাদের, তাদেরকেই পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যেমন শিশুকে খাওয়ানোর সমস্যা, শিশুর লেথার্জি ভাব, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অনেক দিন ধরে যদি শিশু জন্ডিসে আক্রান্ত থাকে, যদি দেরিতে শিশুটির পায়খানা হয়, জিহ্বা যদি বড় হয়ে বেরিয়ে আসে আর পেট যদি ওপরের দিকে ফোলা থাকে। দেরিতে যদি শরীরের হাড়গুলো (পেটে থাকা অবস্থায়) পোক্ত হয়। এ ধরনের রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা যায় না। তবে গলগণ্ডও বিভিন্ন ধরনের আছে তার মধ্যে 'সাধারণ গলগণ্ড' রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সহজেই সুস্থ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন বহুমুখী বিশেষজ্ঞদের। যেমন 'শিশু বিশেষজ্ঞ', 'ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ', 'হরমোন বিশেষজ্ঞ' ও 'পরমাণু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের' যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এ সমস্যা আজ প্রকট নয় বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু না, এ নিয়ে সরকার, সমাজবিদ, এনজিও, চিকিৎসক প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে এখন থেকেই।
অনেকেই বলবেন, 'আয়োডিনযুক্ত লবণ' তো আমাদের দেশে আছে। কিন্তু সে লবণে কতটুকু আয়োডিন মিশ্রিত তা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করার কেউ নেই। আর এখনো জাতীয়ভাবে আমাদের কোনো জরিপ নেই, দেশে কোন কোন অঞ্চল 'আয়োডিন ঘাটতি'। বিদেশিদের কেউ কেউ এসে যা জরিপ করে যায়, তাও সাদামাটা। যেমন কয়েক দিন আগেই পত্রিকায় দেখা গেল, এ দেশের জনসংখ্যার (বিদেশিদের দ্বারা জরিপকৃত) হিসাব। সরকার তার বিরোধিতা করল। এ ধরনের জরিপের জন্যস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে একটি 'National Institute of Thyroid Diseases' নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। এর আওতায় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে এ ধরনের রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা দিয়ে গলগণ্ড ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মহার শূন্যের কোটায় আনা প্রয়োজন। গলগণ্ডকে শুধু ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত না করে তাদের সামাজিক অবস্থানটাও চিন্তা করার সময় এসেছে এখন। তা না হলে রংপুরের (আমার সেই আত্মীয়) মেয়েটির মতো আরো শত শত মেয়ে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবে। তখন এই সামাজিক ব্যাধি সারা জাতির জন্য কলঙ্কময় হয়ে উঠবে। এখনই রাষ্ট্রকে এ ধরনের সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা
ভাবছি, আমার দেশের জনগণ এখনো স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন নয়। তাহলে আমরা (২০২১ সালে) কিভাবে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' বিনির্মাণে সক্ষম হব! ভাইসাব, কী ভাবছেন? কিছু না; এটা তেমন কোনো কঠিন রোগ নয় বা ছোঁয়াচেও না। 'ঘ্যাগে'র আরেকটি নাম আছে, তা হলো 'গলগণ্ড'। গলার নিচে ফুলে ওঠা অংশকে 'গলগণ্ড' বলে। এটা থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ হওয়ার কারণেই হয়। এই গলাফোলা ছোটও হতে পারে আবার বড়ও হতে পারে। এক কথায় বলা যায়, থাইরয়েড গ্রন্থির ফুলে ওঠাকেই 'গলগণ্ড' বলা হয়। এ রোগ বেশির ভাগই মেয়েদের হয়। প্রথমে এটা ফুলে উঠলেও কোনো ব্যথা অনুভূত হয় না। ফলে যার এটা হয় সে কিন্তু ভালোভাবে বুঝতে পারে না। যদিও 'গলগণ্ড' রোগীরা ব্যথা অনুভব করে না; কিন্তু সময় সময় কাশি ও শ্বাসকষ্ট অনুভব করে। 'তা কিসের কারণে এ ধরনের রোগ হয়? প্রশ্ন আমার সেই ভেঙেপড়া আত্মীয়ের। এর প্রধান কারণ হলো, 'দেহে আয়োডিনের (একজন সুস্থ লোকের জন্য যা প্রয়োজন) অভাব হলে।' সে কারণে সব সময় প্রত্যেক মানুষকেই স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই প্রয়োজন। মেয়েদের শরীর পরিচর্যার সময় আয়নায় নিজ গলার দিকে তাকিয়ে দেখা প্রয়োজন, তার গলার সামনে ফোলা দেখা যায় কি না। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারে না। কখনো কখনো বিষণ্ন, কখনো আবার অস্থির ও মনমরা হতে দেখা যাবে। গলার স্বর ভেঙে যাবে, ঢোক গিলতে অসুবিধা মনে হবে। এসব শুনে মেয়ের বাবাকে খুব অস্থির দেখা গেল। 'এর কি কোনো চিকিৎসা নেই?' বললাম, আছে। আপনার মেয়ের যে অবস্থা তাতে রক্তের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করে, আলট্রাসাউন্ড ও পরমাণু চিকিৎসা (নিউক্লিয়ার মেডিসিন) পদ্ধতিতে রোগটা নির্ণয় করে সেই মোতাবেক চিকিৎসা করতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এ ধরনের রোগ বিস্তার করার আগেই এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। যেমন আয়োডিনের অভাব। মানুষ স্বাভাবিক 'আয়োডিন' গ্রহণ করে খাদ্যের মাধ্যমে। আর এসব খাদ্যে যদি 'আয়োডিন' কম থাকে তবে দেহেও 'আয়োডিন' কম হবে। 'থাইরয়েড গ্রন্থির' কার্যকারিতার জন্য এই আয়োডিনের প্রয়োজন হয়। এই গ্রন্থি থেকে যে 'হরমোন' শরীরে প্রবাহিত হয়, তা দেহের স্বাভাবিক গঠনে প্রয়োজন হয়ে পড়ে। শুধু শারীরিক নয় মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকরণের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় 'হরমোন'। এই আয়োডিনের ঘাটতির কারণে 'এনডেমিক গয়টার' বিস্তার লাভ করে। ফলে শিশুর (মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়) মস্তিষ্কের গঠন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শিশুর মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এমনকি বুদ্ধির পূর্ণতা অনেক সময় শিশু আর ফিরে পায় না। সারা বিশ্বে আয়োডিনের অভাব এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি চিহ্নিত হুমকি বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন। ১.৫ বিলিয়ন (১৫ কোটি) লোক সারা বিশ্বে আয়োডিনের অভাবের আওতায় আছে এবং এর মধ্যে প্রায় ৬৫৫ মিলিয়ন (ছয় কোটি ৫৫ লাখ) লোক এই রোগে আক্রান্ত।
ভারতে প্রায় ৭১ মিলিয়ন লোক এর আওতায় এবং প্রায় ২০০ মিলিয়ন আক্রান্ত। বাংলাদেশে বর্তমান সময়ের সঠিক হিসাব না থাকলে ১৯৯৩ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ৪৭ শতাংশ, এলাকার প্রকারভেদে এর তারতম্য ঘটে। প্রাকৃতিকভাবে 'আয়োডিন' মাটি এবং সমুদ্রের পানির মধ্যে পাওয়া যায়। আয়োডিনযুক্ত খাদ্যের প্রাপ্তিটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল। অনেক দেশে মানুষ 'আয়োডিনযুক্ত' লবণ (যদি না কোনো ব্যক্তির কাঁচা লবণ খাওয়ার নিষেধ না থাকে) ব্যবহার করে। সাধারণত দুগ্ধজাত খাদ্য, সামুদ্রিক খাদ্য, মাংস, কিছু কিছু রুটি ও ডিমের মধ্যে আয়োডিন বেশি পরিমাণে থাকে। কেউ আবার আয়োডিনযুক্ত ভিটামিন বড়িও ব্যবহার করেন। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, খাদ্যে আয়োডিন কিভাবে আসে তার উৎস এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি। একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য দৈনিক প্রায় ২২০ মাইক্রোগ্রাম এবং একটি নবজাতক শিশুর মায়ের জন্য (যিনি শিশুকে নিজের দুধ খাওয়ান) প্রায় ২৯০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন প্রয়োজন। আমেরিকা এবং কানাডাতে দেখা গেছে, প্রায় গর্ভবতী মা ও নবজাতক শিশুর মাকে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই মালটিভিটামিনের মাধ্যমে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন খাওয়ানো হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বেশি আয়োডিন খেলে কী সমস্যা দেখা দিতে পারে? এটা সমস্যা হতে পারে যাদের 'থাইরয়েড' গ্রন্থি সমস্যা আগে থেকে আছে তাদের বেলায় যেমন যাদের অতিমাত্রায় 'থাইরয়েড হরমোন' দেহে দেখা গেছে বা যাঁরা 'অটোএমিউন থাইরয়েড' সমস্যায় ভুগছেন। সে কারণে আয়োডিন গ্রহণ করার ব্যাপারেও সতর্ক থাকা দরকার। আর যদি কোনো শিশুর 'থাইরয়েড গ্রন্থি' দেহে না থাকে অথবা কম বৃদ্ধি পায়, বা কখনো কখনো এর জায়গায় না থেকে অন্য কোনোখানে (বিশেষ করে জিহ্বার পেছনে) থাকে তাহলেও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। মায়ের জেনেটিক সমস্যার কারণেও এটা দেখা যেতে পারে। অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই এ ধরনের রোগ হতে পারে। বাংলাদেশে এই প্রথম Institute of Nuclear Medicine and Ultrasound-এর অধ্যাপক ডা. মিজানুল হাসান ও অধ্যাপক ডা. ফরিদুল আলম মিলিতভাবে "Congenital-Hypothyroidisamoe প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। তাঁদের জরিপে এ পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে বাংলাদেশে দুই হাজার ২০০ নবজাতক শিশুর মধ্যে একটিকে পাওয়া যায় জন্মগত Hypothyroid হিসেবে; যেখানে অন্যান্য দেশে পাওয়া যায় পাঁচ হাজার নবজাতক শিশুর মধ্যে একটি। আমেরিকার এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিবছর ৬০-৭০টি নবজাতকের মধ্যে নতুন করে (Hypothyroid) পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৬০-৭০ জন (গত এক বছরে) পাওয়া গেছে। এটা দ্বিগুণও হতে পারে মেয়ে নবজাতকদের বেলায়। অঞ্চল ও জাতিভেদে পার্থক্য হয়ে থাকে। এশিয়া ও আমেরিকা অঞ্চলে বেশি হয় বলে জানা গেছে। এর চিকিৎসাও শুরু করতে হবে জন্মের এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, সব নবজাতককেই কি এ ধরনের প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে? যদি আনতে পারা যায় তবে ভালো। না হলে কিছু কিছু উপসর্গ আছে যাদের, তাদেরকেই পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যেমন শিশুকে খাওয়ানোর সমস্যা, শিশুর লেথার্জি ভাব, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অনেক দিন ধরে যদি শিশু জন্ডিসে আক্রান্ত থাকে, যদি দেরিতে শিশুটির পায়খানা হয়, জিহ্বা যদি বড় হয়ে বেরিয়ে আসে আর পেট যদি ওপরের দিকে ফোলা থাকে। দেরিতে যদি শরীরের হাড়গুলো (পেটে থাকা অবস্থায়) পোক্ত হয়। এ ধরনের রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা যায় না। তবে গলগণ্ডও বিভিন্ন ধরনের আছে তার মধ্যে 'সাধারণ গলগণ্ড' রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সহজেই সুস্থ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন বহুমুখী বিশেষজ্ঞদের। যেমন 'শিশু বিশেষজ্ঞ', 'ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ', 'হরমোন বিশেষজ্ঞ' ও 'পরমাণু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের' যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এ সমস্যা আজ প্রকট নয় বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু না, এ নিয়ে সরকার, সমাজবিদ, এনজিও, চিকিৎসক প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে এখন থেকেই।
অনেকেই বলবেন, 'আয়োডিনযুক্ত লবণ' তো আমাদের দেশে আছে। কিন্তু সে লবণে কতটুকু আয়োডিন মিশ্রিত তা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করার কেউ নেই। আর এখনো জাতীয়ভাবে আমাদের কোনো জরিপ নেই, দেশে কোন কোন অঞ্চল 'আয়োডিন ঘাটতি'। বিদেশিদের কেউ কেউ এসে যা জরিপ করে যায়, তাও সাদামাটা। যেমন কয়েক দিন আগেই পত্রিকায় দেখা গেল, এ দেশের জনসংখ্যার (বিদেশিদের দ্বারা জরিপকৃত) হিসাব। সরকার তার বিরোধিতা করল। এ ধরনের জরিপের জন্যস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে একটি 'National Institute of Thyroid Diseases' নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। এর আওতায় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে এ ধরনের রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা দিয়ে গলগণ্ড ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মহার শূন্যের কোটায় আনা প্রয়োজন। গলগণ্ডকে শুধু ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত না করে তাদের সামাজিক অবস্থানটাও চিন্তা করার সময় এসেছে এখন। তা না হলে রংপুরের (আমার সেই আত্মীয়) মেয়েটির মতো আরো শত শত মেয়ে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবে। তখন এই সামাজিক ব্যাধি সারা জাতির জন্য কলঙ্কময় হয়ে উঠবে। এখনই রাষ্ট্রকে এ ধরনের সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা
No comments