আসমা, কুলদীপ ও জসীমউদ্দীন by খুশবন্ত সিং
বেশ কয়েক দিন ধরে ঠাণ্ডা লাগার কারণে শরীরটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। চোখ এবং নাক বন্ধ হয়ে আসছিল। গলায় খুবই ব্যথা। কোনোক্রমেই কাশি থামছে না। বাইরের ঘরে মেহমান বসে আছেন। আমি মনে মনে ভাবছি, তারা যেন দীর্ঘ সময় নষ্ট না করে আমাকে পরিত্রাণ দিয়ে চলে যান।
ঠিক তখনই আসমা জাহাঙ্গীর এসে পেঁৗছলেন। তিনি সোজা লাহোর থেকে এসেছেন। তিনি তাঁর লাগেজ ইন্ডিয়ান সেন্টারে রেখে যখনই আমার কথা শুনেছেন, তখনই সোজা এক রকম দৌড়ে আমার কাছে চলে এসেছেন।
সঙ্গে সঙ্গে আমার অবসাদ এবং সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। আমি উঠে গিয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বললাম: মোবারক হো! শাবাশ!
আমি আসমা জাহাঙ্গীরকে তাঁর ঐতিহাসিক কর্মের জন্য মোবারকবাদ জানালাম। তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের অধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এমন একটি দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত একটি পদে আসীন হয়েছেন, যে দেশে মোল্লা আর তালেবানদের টোটা কথা বলে, যেখানে নারীকে বোরকা পরে থাকতে বাধ্য করা হয় এবং 'ব্যভিচার'-এর দায়ে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। আসমা সে দেশে সব সময় জোর দিয়ে বলে আসছেন যে পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে গভীর মিত্রতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এখানেই আসমার সফলতা উল্লেখ করার মতো। কারণ, পাকিস্তান এমনই একটি দেশ, যে দেশটি হিন্দুস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে নামার জন্য সর্বদা প্রস্তুত হয়ে আছে। আমি আগেও লিখেছি যে আসমা জাহাঙ্গীরই হলেন নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রকৃত দাবিদার। আমি এই তালিকায় কুলদীপ নায়ারের নামটিও জুড়ে দিতে চাই। কারণ এ দুজনই দুটি দেশের মধ্যে মৈত্রী গড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভারত এবং পাকিস্তান দুটি দেশেই এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা ভিন্ন একটি সময়ে বাস করছেন। একবিংশ শতাব্দীর সঙ্গে তাঁদের কোনো পরিচয় নেই। পাকিস্তানের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ এখনো মধ্যযুগে বাস করছে। এই জনগণ পাকিস্তানে শরিয়া আইন প্রচলনের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। ভারতে এখনো এমন গ্রাম আছে, যেখানে গ্রামের বুজুর্গ-মাতব্বররা আদেশ জারি করছেন, যদি সমগোত্রীয় যুবক-যুবতী নিজেদের মধ্যে প্রেম-প্রীতি করে, সমঝোতা করে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাহলে তাদের হয় গ্রাম থেকে বিতাড়িত হতে হবে অথবা হত্যার সম্মুখীন হতে হবে। এমন সব সামাজিক পরিবেশে, এমন পরিস্থিতির দেশে আসমা জাহাঙ্গীর এবং কুলদীপ নায়ারের মতো মানুষ দুর্লভ এবং ব্যতিক্রম। এরাই তো সর্বোচ্চ সম্মানের যথাযথ দাবিদার।
ইংরেজি যখন অভিশাপ
ইংরেজিতে এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলো উচ্চারণ করতে ভারতবাসীকে ভয়ানক মুশকিলে পড়তে হয়। মাঝেমধ্যেই ইংরেজি একটি শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে ভারতবাসী এমন একটি উচ্চারণ করে বসে যে অন্য একটি মজাদার বাক্য তৈরি হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ ভারতীয়রা ইংরেজি এম উচ্চারণ করে থাকে জম। অন্তত শুনতে শোনা যায় 'জম'। আমার মোহন রাওয়ের কথা মনে আছে। তিনি প্রকাশনা বিভাগের প্রধান ছিলেন। একবার তিনি এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ফোন রেখে তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, 'জম জম জমির জেম্পির সঙ্গে কথা বললাম। আসলে তিনি এম এম আমির এমপির সঙ্গে কথা বলছিলেন। ঠিক একইভাবে বাংলা ভাষার 'ব' উচ্চরণ করতে আমাকে হিমশিম খেতে হয়। বাংলা 'বৈরী' শব্দ উচ্চারণ করতে গেলে 'ভেরি'র মতো শোনা যায়। বাংলা ভাষার 'য়ো' উচ্চারণ করতে গিয়ে বহুবার গরমিল করে ফেলেছি। একবার পরিকল্পনা বিভাগের একজন বাঙালি সদস্য স্বামী বিবেকানন্দের জীবন ও শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করার জন্য ছয় মাসের ছুটির আবেদন করলেন। তিনি আবেদনে লিখলেন, তাঁকে লিখতে হলো, 'আমি স্বামী ভিভেকানন্দের ওপর পড়াশোনা করতে চাই।'
এমন বহু উদাহরণ আছে। ইংরেজি শব্দ স্কুলকে উর্দু ভাষাভাষীরা লিখে থাকে 'ইস্কুল'। পাঞ্জাবি ভাষায় সেটা হয়ে যায় 'সিকুল'। ইংরেজি স্টুল শব্দটি উর্দুভাষীদের কাছে ইস্টুল, আর পাঞ্জাবিরা বলে সিটুল। আঙ্কেল শব্দটি অঙ্কিল, আর পাঞ্জাবিদের কাছে অনকল। ইংরেজি স্পিচ শব্দটি উর্দু ভাষায় ইস্পিচ, আর পাঞ্জাবিদের কাছে সেটা সপিচ।
এমন কেন হয়? বাস্তবে এর উত্তর এই ভাষাগুলোর ভেতরই রয়েছে। উর্দুতে 'স' ধ্বনির সঙ্গে কোনো ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্ত হলে তার আগে একটি স্বরবর্ণ জুড়ে দিতে হয়। দেবনাগরী অক্ষর মূলত সংস্কৃত, এ ভাষায় এমন সমস্যা দেখা যায় না। সে কারণে হিন্দিভাষীরা ইংরেজি শব্দ সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে। বাংলাদেশের মশহুর কবি জসিমউদ্দীনের (তিনি নিজের নাম জোসিমউদ্দীন উচ্চারণ করতেন) কথা মনে পড়ে। তাঁর সঙ্গে আমার খুবই সখ্য গড়ে উঠেছিল। তাঁর সঙ্গে যখনই আমার দেখা হতো, তিনি আমাকে বলতেন, সর্দারজি, আপকো বারো বাজগায়া? আসলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে চাইতেন, 'কেয়া বারাহ বাজ কা ওয়াক্ত হো গয়া হ্যায়?'
ভারতের বহুল প্রচারিত হিন্দি দৈনিক ভাস্কর থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
সঙ্গে সঙ্গে আমার অবসাদ এবং সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। আমি উঠে গিয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বললাম: মোবারক হো! শাবাশ!
আমি আসমা জাহাঙ্গীরকে তাঁর ঐতিহাসিক কর্মের জন্য মোবারকবাদ জানালাম। তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের অধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এমন একটি দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত একটি পদে আসীন হয়েছেন, যে দেশে মোল্লা আর তালেবানদের টোটা কথা বলে, যেখানে নারীকে বোরকা পরে থাকতে বাধ্য করা হয় এবং 'ব্যভিচার'-এর দায়ে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। আসমা সে দেশে সব সময় জোর দিয়ে বলে আসছেন যে পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে গভীর মিত্রতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এখানেই আসমার সফলতা উল্লেখ করার মতো। কারণ, পাকিস্তান এমনই একটি দেশ, যে দেশটি হিন্দুস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে নামার জন্য সর্বদা প্রস্তুত হয়ে আছে। আমি আগেও লিখেছি যে আসমা জাহাঙ্গীরই হলেন নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রকৃত দাবিদার। আমি এই তালিকায় কুলদীপ নায়ারের নামটিও জুড়ে দিতে চাই। কারণ এ দুজনই দুটি দেশের মধ্যে মৈত্রী গড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভারত এবং পাকিস্তান দুটি দেশেই এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা ভিন্ন একটি সময়ে বাস করছেন। একবিংশ শতাব্দীর সঙ্গে তাঁদের কোনো পরিচয় নেই। পাকিস্তানের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ এখনো মধ্যযুগে বাস করছে। এই জনগণ পাকিস্তানে শরিয়া আইন প্রচলনের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। ভারতে এখনো এমন গ্রাম আছে, যেখানে গ্রামের বুজুর্গ-মাতব্বররা আদেশ জারি করছেন, যদি সমগোত্রীয় যুবক-যুবতী নিজেদের মধ্যে প্রেম-প্রীতি করে, সমঝোতা করে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাহলে তাদের হয় গ্রাম থেকে বিতাড়িত হতে হবে অথবা হত্যার সম্মুখীন হতে হবে। এমন সব সামাজিক পরিবেশে, এমন পরিস্থিতির দেশে আসমা জাহাঙ্গীর এবং কুলদীপ নায়ারের মতো মানুষ দুর্লভ এবং ব্যতিক্রম। এরাই তো সর্বোচ্চ সম্মানের যথাযথ দাবিদার।
ইংরেজি যখন অভিশাপ
ইংরেজিতে এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলো উচ্চারণ করতে ভারতবাসীকে ভয়ানক মুশকিলে পড়তে হয়। মাঝেমধ্যেই ইংরেজি একটি শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে ভারতবাসী এমন একটি উচ্চারণ করে বসে যে অন্য একটি মজাদার বাক্য তৈরি হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ ভারতীয়রা ইংরেজি এম উচ্চারণ করে থাকে জম। অন্তত শুনতে শোনা যায় 'জম'। আমার মোহন রাওয়ের কথা মনে আছে। তিনি প্রকাশনা বিভাগের প্রধান ছিলেন। একবার তিনি এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ফোন রেখে তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, 'জম জম জমির জেম্পির সঙ্গে কথা বললাম। আসলে তিনি এম এম আমির এমপির সঙ্গে কথা বলছিলেন। ঠিক একইভাবে বাংলা ভাষার 'ব' উচ্চরণ করতে আমাকে হিমশিম খেতে হয়। বাংলা 'বৈরী' শব্দ উচ্চারণ করতে গেলে 'ভেরি'র মতো শোনা যায়। বাংলা ভাষার 'য়ো' উচ্চারণ করতে গিয়ে বহুবার গরমিল করে ফেলেছি। একবার পরিকল্পনা বিভাগের একজন বাঙালি সদস্য স্বামী বিবেকানন্দের জীবন ও শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করার জন্য ছয় মাসের ছুটির আবেদন করলেন। তিনি আবেদনে লিখলেন, তাঁকে লিখতে হলো, 'আমি স্বামী ভিভেকানন্দের ওপর পড়াশোনা করতে চাই।'
এমন বহু উদাহরণ আছে। ইংরেজি শব্দ স্কুলকে উর্দু ভাষাভাষীরা লিখে থাকে 'ইস্কুল'। পাঞ্জাবি ভাষায় সেটা হয়ে যায় 'সিকুল'। ইংরেজি স্টুল শব্দটি উর্দুভাষীদের কাছে ইস্টুল, আর পাঞ্জাবিরা বলে সিটুল। আঙ্কেল শব্দটি অঙ্কিল, আর পাঞ্জাবিদের কাছে অনকল। ইংরেজি স্পিচ শব্দটি উর্দু ভাষায় ইস্পিচ, আর পাঞ্জাবিদের কাছে সেটা সপিচ।
এমন কেন হয়? বাস্তবে এর উত্তর এই ভাষাগুলোর ভেতরই রয়েছে। উর্দুতে 'স' ধ্বনির সঙ্গে কোনো ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্ত হলে তার আগে একটি স্বরবর্ণ জুড়ে দিতে হয়। দেবনাগরী অক্ষর মূলত সংস্কৃত, এ ভাষায় এমন সমস্যা দেখা যায় না। সে কারণে হিন্দিভাষীরা ইংরেজি শব্দ সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে। বাংলাদেশের মশহুর কবি জসিমউদ্দীনের (তিনি নিজের নাম জোসিমউদ্দীন উচ্চারণ করতেন) কথা মনে পড়ে। তাঁর সঙ্গে আমার খুবই সখ্য গড়ে উঠেছিল। তাঁর সঙ্গে যখনই আমার দেখা হতো, তিনি আমাকে বলতেন, সর্দারজি, আপকো বারো বাজগায়া? আসলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে চাইতেন, 'কেয়া বারাহ বাজ কা ওয়াক্ত হো গয়া হ্যায়?'
ভারতের বহুল প্রচারিত হিন্দি দৈনিক ভাস্কর থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
No comments