চালের মূল্য অস্থিতিশীল by রাশেদ রাবি্ব
বোরোর বাম্পার ফলন এবং আমনের লৰ্যমাত্রা অর্জনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও বার বার বিভিন্ন কৌশলে বাড়ছে চালের দাম। অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির ফলে চরম ভোগানত্মি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
অর্থনীতিবিদগণ অবশ্য চালের এই মূল্য বৃদ্ধিকে একেবারেই অতিরিক্ত মনে করছেন। কারণ কৃষিতে পর্যানত্ম পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ভতর্ুকি, বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়া এবং উৎপাদন লৰ্যমাত্রা অর্জন করার পরেও চালের মূল্য বৃদ্ধি একেবারেই অযৌক্তিক মনে করছেন তাঁরা।বর্তমানে বাজার ঘুরে দেখা যায় চালের মূল্য কেজিপ্রতি বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে চিকন এবং সুগন্ধি চালের মূল্য বাড়লেও এবার বেড়েছে মোটা চালের মূল্যও। সপ্তাহের প্রথমদিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানায়, বাজারে মোটা চাল চায়না ইরি ও স্বর্ণার কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে দুই টাকা। যেখানে খোলাবাজারে এই চালগুলোর দাম ছিল ২৫ টাকা, বর্তমানে সেগুলো বিক্রি হচ্ছে ২৭ টাকায়। এই মোটা চালগুলো ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ২৪ টাকা কেজি। টিসিবির হিসাবমতে, মাত্র ১ মাসের ব্যবধানে চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ১১ শতাংশ।
সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশিস্নষ্ট মহল থেকে জানানো হয়েছে (যদিও মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে তারা তেমন উদ্দিগ্ন নয়), চালের মূল্য অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে খোলাবাজারে (ওএমএস) নিয়ন্ত্রিত মূল্যে চাল বিক্রি করা হবে। খোলাবাজারে এর আগে বিভিন্ন সময় চাল বিক্রি করা হলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে বেশিরভাগ স্বল্পআয়ের মানুষকে অতিরিক্ত মূল্যেই চাল কিনতে হয়েছে।
২০০৯ সালে বিশ্ববাজারে চালের মূল্যের দিকে তাকালে দেখা যায় অভিন্ন চিত্র। বিশ্ববাজারেও চালের মূল্য বিভিন্ন সময়ে ছিল অস্থিতিশীল। যদিও তার পরিপ্রেৰিত ছিল আমাদের বর্তমান অবস্থা থেকে অনেকটা ভিন্ন। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক রিপোর্টে জানা যায়, ২০০৯ সালে সারা পৃথিবীতে মোট চালের উৎপাদন ছিল ছয় শ' ৬৮ মিলিয়ন টন, যা লৰ্যমাত্রার চেয়ে ২১ দশমিক মিলিয়ন টন কম। উৎপাদনের এই পরিমাণ ২০০৮ সালের তুলনায় ৩ শতাংশ কম। ফাও আরও জানায়, পৃথিবীর বেশিরভাগ চাল উৎপন্ন হয় এশিয়াতে। কিন্তু আবহাওয়া ও জলবায়ুগত সমস্যার কারণে ২২ মিলিয়ন টন চাল কম উৎপন্ন হয়। যদিও এ বছর আফ্রিকাতে অতিরিক্ত পরিমাণ চাল উৎপন্ন হয়, প্রায় ২৫ দশমিক চার মিলিয়ন টন, তার পরও পৃথিবীর মোট লৰ্যমাত্রা অর্জনে সমর্থ হয়নি।
২০০৯ সালে লাতিন আমেরিকাতেও চালের উৎপাদন ছিল অনেকটা ঈর্ষণীয়। সেখানে লৰ্যমাত্রার চেয়ে চার ভাগ অতিরিক্ত উৎপন্ন হয়েছিল। কিন্তু একই ভাবে অস্ট্রেলিয়াতে উৎপন্ন হয়েছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
এ সময়টাতে আনত্মর্জাতিক বাজারেও চালের মূল্য ছিল কিছুটা উর্ধমুখী যা এখনও বর্তমান। চালের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ফাও-এর রিপোর্টে কয়েকটি বিষয়ের ্ওপর বিশেষ গুরম্নত্বারোপ করা হয়। এর মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ডলারের মূল্য পতন এবং কম উৎপাদনকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্বমন্দার কারণে অধিক উৎপাদনশীল রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তামূলক চাল সংরৰণ করে এবং কিছুটা মূল্য বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে ডলারের মূল্য ওঠানামায় আনত্মর্জাতিক আমদানি-রফতানির ওপর প্রভাব বিসত্মার করে। এশিয়াতে চালের তুলনামূলক চাহিদা বেশি এবং যোগান কম থাকায় মূল্য কিছুটা স্ফিতাবস্থায় উপনীত হয়। সেই সঙ্গে সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজন অনুযায়ী চালের মজুদের ফলে চালের বাজারে দীর্ঘমেয়াদী সঙ্কট তৈরি হয়, যা মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন সঙ্কটের কারণে বিশ্ববাজারে চালের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। মাত্র এক মাসের ব্যবধানেই চালের মূল্য টনপ্রতি ১০০ ডলার বেড়ে যায়।
আনত্মর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও আমাদের দেশের সার্বিক অবস্থা ততটা খারাপ ছিল না। বছরের মাঝামাফি বোরো মৌসুমে পর্যাপ্ত উৎপাদন ছিল, যা আমাদের লৰ্যমাত্র অর্জনে সৰম হয়। তার পরও মূল্যে তেমন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এনকি খোলাবাজারে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে চাল বিক্রি হয়েছে অনেকটা লোক দেখানোর মতো।
মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে সরকারকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে ব্যবসায়ীরা চালায় স্বেচ্ছাচারিতা। তারা আনত্মর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পালস্না দিয়ে মূল্য বৃদ্ধিতে ছিল তৎপর। মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে তারা দিয়েছে নানা অজুহাত।
ভারতে চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে বাংলাদেশেও। অথচ গত বছর ভারতের উৎপাদন ছিল লৰ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। যার ফলে গত দু'দশক ধরে ভারত চাল রফতানি করলেও এ বছর তাদের চাল আমদানির সিদ্ধানত্ম নিতে হয়। গত বছর ৯ কোটি ৯০ লাখ টন চাল উৎপন্ন হলেও শুধুমাত্র আপৎকালীন ঘাটতি মোকাবেলার জন্য ভারতকে এ সিদ্ধানত্ম নিতে হয়।
দেশীয় চালের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের রয়েছে দুর্দানত্ম দাপট। উৎপাদনকারী অর্থাৎ কৃষকদের কাছ থেকে তারা সরকার নির্ধারিত মূল্যে চাল সংগ্রহ করে। কিন্তু পরবতর্ীতে বাজারে সরবরাহ না করে নিজস্ব পদ্ধতিতে মজুদ করে। যার ফলে বাজারে সরবরাহে স্বল্পতা তৈরি হয়। এই সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের এ ধরনের কৃত্রিম সঙ্কটের পরিপ্রেৰিতে আমদানিকারকরা চাল আমদানিতে তৎপর হয়ে ওঠে। তারাও অতিরিক্ত মূল্যে চাল আমদানি করে এবং বর্ধিত মূল্যে বিক্রি করে। এভাবেই সাধারণের অজ্ঞাতে চালের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং নিম্নআয়ের লোকদের অতিরিক্ত দামে চাল কিনে হিমশিম খেতে হয়।
চালের বাজারে বর্তমান অনাকাঙ্ৰিত মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে রাজধানীর কাওরানবাজারের এক পাইকারি চাল বিক্রেতা বলেন, মাত্র একদিনের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মিল থেকে মোটা চাল বসত্মাপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা এবং সরম্ন চাল বসত্মাপ্রতি ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকা অতিরিক্ত দামে কিনতে হচ্ছে। যার ফলে খোলাবাজারে চালের মূল্য দুই থেকে তিন টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানের এই অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে উত্তরণে টিসিবি প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে দু'লাখ টন চাল আমাদানির সিদ্ধানত্ম নিয়েছে। বর্তমানে সরকারের যে পরিমাণ চাল মজুদ আছে তার পরিমাণ ১০ লাখ ৩৪ হাজার টন। এই মজুদ দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই সঙ্কট নিরসন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে চাল আমদানি প্রয়োজন বলে মনে করছে টিসিবি ও সংশিস্নষ্ট মহল। তবে আমাদানির ৰেত্রে লৰ্য রাখতে হবে, কোনভাবেই যেন আনত্মর্জাতিক মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে চাল আমদানি করা না হয়। চালের গুণগত মান যেন খারাপ না হয়। কোনভাবেই যেন মেয়াদোত্তীর্ণ চাল আমদানি করা না হয়। সেই সঙ্গে দেশের বাজার স্থিতিশীল রাখতে মধ্যস্বত্বভোগী এবং আমদানিকারকরা যেন কোনভাবেই কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে অতিরিক্ত মুনাফা লুটতে না পারে সেদিকে সরকার ও সংশিস্নষ্ট মহলের বিশেষ দৃষ্টিদান একানত্ম জরম্নরী।
No comments