রেমিটেন্স উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে হবে by এমএ খালেক
বিশ্ব মন্দার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনও যেহেতু মন্দার প্রভাব পড়েনি তাই আমরা মন্দা হতে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি।
এতে উলস্নসিত হবার কোন কিছু নেই। কারণ উন্নত দেশগুলো মন্দার প্রভাব অতিক্রম করার পর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মন্দার বিলম্বিত প্রভাব পড়েছে। মন্দার বিলম্বিত প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে প্রলম্বিত হতে পারে। তাই আমাদের এখনই সচেতন হওয়া দরকার। বিশ্ব মন্দা নিয়ে আমাদের দেশে যে আলোচনা হচ্ছে তার বেশিরভাগই মনগড়া এবং বাসত্মবতা বিবর্জিত। অনেকেরই হয়ত মনে আছে, মন্দা শুরম্ন হবার কিছু দিন পর রাজধানীতে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় দেশের খ্যাতিমান কোন কোন অর্থনীতিবিদ মনত্মব্য করেছিলেন, বিশ্ব মন্দা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর হবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নে এই মন্দা অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। উলেস্নখ্য, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসামগ্রীর সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে আমেরিকা। মন্দার কারণে সে দেশের মানুষের ক্রয়ৰমতা কমে যাবে। তারা দৈনন্দিন ভোগ ব্যয় কমিয়ে দেবে। উন্নতমানের পোশাকসামগ্রীর পরিবর্তে নিম্নমানের পোশাক ক্রয়ে সচেষ্ট হবে। বাংলাদেশ যেহেতু 'লোয়ার এন্ডে'র পোশাক রফতানি করে, তাই এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে। কিন্তু তাদের সেই বক্তব্য মোটেও সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়নি। ইতোমধ্যেই তৈরি পোশাক রফতানিতে ধস নেমেছে। আর তৈরি পোশাকসামগ্রী রফতানিতে ধস নামার অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য মুখথুবড়ে পড়া।বিশ্ব মন্দার মধ্যেও জনশক্তি খাতটি এখনও তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। শুধু তাই নয়, এ খাতের সাম্প্রতিক পারফরমেন্স বিস্ময়কর। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছু দিন আগে ১০০০ কোটি মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। এটা বাংলাদেশের এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ রিজার্ভ। কোন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ দিয়ে ৩ মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা গেলেই তাকে সনত্মোষজনক রিজার্ভ বলে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ দিয়ে ৬ হতে সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেতে পারে। আর এই বিপুল অঙ্কের রিজার্ভ সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় 'প্রভাবক' হিসেবে কাজ করেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। কিন্তু জনশক্তি রফতানি বাবদ যে আয় হয় তার প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। ফলে জনশক্তি রফতানি খাতকে কোনভাবেই উপেৰা করার সুযোগ নেই। আগামীতে উন্নত বিশ্ব মন্দার প্রভাব অতিক্রম করতে শুরম্ন করলে জনশক্তির চাহিদা দ্রম্নত বাড়বে। ফলে বাংলাদেশ হতে বর্ধিত হারে জনশক্তি রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যেই সে ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত নবেম্বর মাসে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রেমিটেন্স আয় করেছে। ঐ মাসে মোট ১০৫ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি রেমিটেন্স আয় করেছে। এটা কোন এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আয়। সংশিস্নষ্টরা মনে করছেন, রেমিটেন্স আয়ের এই ধারা বহাল থাকলে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ১২শ' কোটি ডলারেরও বেশি রেমিটেন্স আয় করতে সমর্থ হবে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ৯৭৫ কোটি ডলার রেমিটেন্স আয় করেছিল। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জনশক্তি রফতানি খাত যদি পণ্য রফতানি আয়কে অতিক্রম করে তা হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।
জনশক্তি রফতানি খাতের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই সামান্য। ফলে বিদেশগামী সাধারণ মানুষগুলো নানাভাবে প্রতারণার শিকারে পরিণত হচ্ছে। একজন মানুষের বিদেশে যাবার জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তার চেয়ে অনত্মত ৩/৪ গুণ অর্থ আদায় করা হচ্ছে। যারা বিদেশে গমন করে তাদের বেশিরভাগই বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে যায়। অথচ সম্পূর্ণ সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিদেশে গমনের ব্যবস্থা করা গেলে মানুষ খুব সহজে এবং স্বল্প খরচে বিদেশ যেতে পারত।
বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাত নানা জটিল সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রয়েছে। কোন পৰ থেকেই এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। অথচ এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হলে খাতটি সহজেই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে আরও ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারে। সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ২ লাখ ৪৮ হাজার লোক কর্মসংস্থান উপলৰে বিদেশ গমন করে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এসে এর পরিমাণ ৯ লাখ ৮১ হাজারে উন্নীত হয়। একই সময়ে প্রেরিত রেমিটেন্সের পরিমাণ ৯ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা হতে ৫৪ হাজার ২৪৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে দৰ জনশক্তি প্রেরণের ব্যর্থতা। ২০০৮ সালে মোট ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ বাংলাদেশী চাকরি নিয়ে বিদেশে গমন করে। এদের মধ্যে স্বল্প বা অদৰ মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। মোট ৪৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৮ জন স্বল্পদৰ বা অদৰ মানুষ বিদেশে যায়। অন্যদিকে আধাদৰ মানুষের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৮১০ জন। দৰ লোকবল প্রেরণ করা হয় ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৪৪ জন। এই দৰ মানুষের অনেকেই আবার ভুয়া সার্টিফিকেটের বলে দৰ জনসম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ঐ বছর মোট ১ হাজার ৬৬৪ জন পেশাজীবী বিদেশে গমন করে। আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, তাহলো_ সাধারণ শ্রমিক তা দৰ বা অদৰ যাই হোক না কেন তার চেয়ে পেশাজীবী জনশক্তি রফতানি করা অধিক লাভজনক। একজন পেশাজীবী মাসে যে অর্থ আয় করে ২০ জন সাধারণ শ্রমিক মিলেও তা করতে পারে না। তাই ২০ জন সাধারণ শ্রমিক প্রেরণের চেয়ে একজন পেশাজীবী বিদেশে রফতানি করা বেশি লাভজনক। বর্তমানে আমাদের দেশ থেকে যে সামান্যসংখ্যক পেশাজীবীকে বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে তা শতাংশের হিসেবেও আসে না। যেমন_ ২০০৮ সালে যে জনশক্তি বিদেশে প্রেরণ করা হয় তার মধ্যে স্বল্পদৰ লোকের সংখ্যা ছিল ৫২ শতাংশ। আধাদৰ মানুষের সংখ্যা ছিল ১৫ শতাংশ এবং দৰ লোকবলের সংখ্যা ছিল ৩৩ শতাংশ। পেশাজীবীরা শতাংশের হিসেবে আসেনি। অন্যদিকে ২০০০ সালে যে জনশক্তি রফতানি করা হয়েছিল তার মধ্যে স্বল্পদৰ মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৮ শতাংশ। আধাদৰ ১২ শতাংশ, দৰ ৪৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ ছিল পেশাজীবী। আমরা যদি জনশক্তি রফতানি খাতের সম্ভাবনাকে ভালভাবে কাজে লাগাতে চাই তাহলে পেশাজীবীদের বর্ধিত হারে বিদেশে প্রেরণের কোন বিকল্প নেই। অঞ্চলভিত্তিক জনশক্তি রফতানিতেও আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনশক্তি রফতানি করা হয় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় জনশক্তি রফতানি করা বেশি লাভজনক। কিন্তু আমরা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দিকেই তাকিয়ে আছি। ২০০৮ সালে যে জনশক্তি বিদেশে প্রেরণ করা হয় তার মধ্যে ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন বা ৪৮ শতাংশই যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সৌদিআরবে গমন করে ১ লাখ ৩২ হাজার ১২৪ জন বা ১৫ শতাংশ। অন্যান্য দেশের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন বা ১৫ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৫৬ হাজার ৮৫১ জন বা ৬ শতাংশ, ওমানে ৫২ হাজার ৮৯৬ জন বা ৬ শতাংশ জনশক্তি প্রেরণ করা হয়। কিন্তু একটি বা দুটি দেশের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। ২০০০ সালে সৌদিআরব ছিল বাংলাদেশী জনশক্তি রফতানির প্রধান লৰ্যস্থল। সে বছর দেশটিতে মোট ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬১৮ জন বাংলাদেশী চাকরি উপলৰে গিয়েছিল। ২০০৮ সালে তা ১ লাখ ৩২ হাজার ১২৪ জনে নেমে আসে।
জাতীয় অর্থনীতিতে জনশক্তি রফতানি খাতের অবদান ক্রমশ বাড়ছে, কিন্তু এখনও খাতটির ওপর তেমন কোন গুরম্নত্ব দেয়া হচ্ছে না। প্রবাসীদের কল্যাণে বেশকিছু পদৰেপ গ্রহণ এখন খুবই জরম্নরী হয়ে পড়েছে। অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে প্রবাসীদের ব্যাংক ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু এই উদ্যোগটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এটা যত দ্রম্নত সম্ভব বাসত্মবায়ন করা দরকার। এখানে আরও একটি ব্যাপার আমাদের মনে রাখতে হবে, তাহলো_ প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ অধিকাংশ ৰেত্রেই কোন উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। কারণ তাদের জন্য বিনিয়োগের কোন উপযুক্ত ৰেত্র এখনও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে উপার্জিত অর্থের বিরাট অংশই নানাভাবে অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যাচ্ছে। জমি বা ফ্যাট ক্রয় অথবা অন্যভাবে এই অর্থ স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিয়া ব্যয় করছে। দেশের শিল্প খাতে এই অর্থ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্যও তাদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানির যে আইপিও বাজারে ছাড়া হচ্ছে সেখানে প্রবাসীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। এটা বাড়ানো দরকার। প্রবাসীদের কোটা যদি ২৫ হতে ৩০ শতাংশ পর্যনত্ম বাড়ানো হয় তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশীদের উপার্জিত অর্থের একটি বড় অংশ শেয়ারবাজারে আসতে পারে। এতে স্থানীয় শেয়ারবাজারের গভীরতা যেমন বাড়তে পারে তেমনি বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা বিনিয়োগের একটি উপযুক্ত ৰেত্র খুঁজে পেতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভাল ভাল প্রতিষ্ঠানের শেয়ার জরম্নরীভিত্তিতে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সব শেয়ারে প্রবাসী বাংলাদেশীরা যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে তার উদ্যোগ নিতে হবে।
No comments