লঞ্চ দুর্ঘটনা-নৌপথের আহাজারি কবে থামবে?
নদীমাতৃক বাংলাদেশের নৌপথগুলো যে কতটা অবহেলিত ও নিরাপত্তাহীন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে মেঘনা নদীতে সর্বশেষ লঞ্চডুবির মধ্য দিয়ে তা আরেকবার স্পষ্ট হলো। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ঝড়ের কবলে পড়ে এমন দুর্ঘটনা আমাদের দেশে বিরল নয়।
কিন্তু কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জের সাচনাগামী এমভি বিপাশার সলিলসমাধি যে দুটি কারণে ঘটেছে, তার কোনোটিই প্রাকৃতিক নয়। সহযোগী একটি দৈনিকের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাত্রিবেলার জন্য অনুমোদিত সংখ্যা ৮০ জন হলেও লঞ্চটি তিন শতাধিক যাত্রী বহন করছিল। অন্যদিকে যাত্রাপথে নিমজ্জিত ছিল কিছুদিন আগে দুর্ঘটনায় পড়া একটি বালুবাহী ট্রলার। সেটাতে ধাক্কা লেগেই এমভি বিপাশা ডুবে যায়। আমরা মনে করি, যাত্রীসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত থাকলে কিংবা নিমজ্জিত ট্রলারটি সময়মতো অপসারণ করা গেলে এতগুলো মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়তো এড়ানো যেত। বস্তুত সামান্য সতর্কতা ও নজরদারিই আমাদের নৌপথগুলোকে নিরাপদ করে তুলতে পারে। ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী পরিবহন, ফিটনেস সনদ না থাকা, চালকের অদক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে নজরদারি থাকলেই লঞ্চ দুর্ঘটনা অনেকাংশে এড়ানো যায় বলে বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? উদ্ধারকারী জাহাজের সামর্থ্য বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের কথাও অনেক দিন ধরে বলা হচ্ছে। সে ব্যাপারেইবা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না কেন? আমরা দেখেছি, প্রত্যেকটি লঞ্চ দুর্ঘটনার পর অনেকটা রুটিনমাফিক তদন্ত কমিটি গঠন, সংবাদমাধ্যমে আলোচনা, লেখালেখি হয়। তারপর আর কোনো কাজ হয় না। এবার এর পুনরাবৃত্তি আশা করি না আমরা। এর আগের তদন্ত কমিটিগুলো দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলো কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, সে প্রশ্নও এখন তুলতে চাই। আমরা এও আশা করি, এবারের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সাত দিনের যে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, আগের নজির অনুসরণ করে তা আর বাড়ানো হবে না। তদন্ত কমিটির দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নেরও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। এক একটি লঞ্চ দুর্ঘটনার পর প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা যেভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সংবাদমাধ্যমের কাছে তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন, একইভাবে ওইসব তদন্ত কমিটির করা সুপারিশ বাস্তবায়নের খবরও যদি আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদমাধ্যমকে জানাতে পারেন, তা হবে যথার্থ দায়িত্বশীলতা। একই সঙ্গে নৌপথের দিকে নতুন করে নজর দেওয়ার আহ্বানও জানাই আমরা। আমরা জানি, গুটিকয়েক অযান্ত্রিক স্থলবাহনের কথা বাদ দিলে শত শত বছর ধরে এ দেশের মানুষ নদীপথকেই ব্যবহার করেছে। কিন্তু 'আধুনিক'কালে এসে বিশ্বের আর সব জনগোষ্ঠী যখন তাদের নৌপথকে আরও নিরাপদ ও কার্যকর করে তোলার দিকে মনোযোগ দিয়েছে, আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছি স্থলপথে। স্থল ও আকাশের তুলনায় নৌপথ যদিও অনেক বেশি সাশ্রয়ী, কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমরা ব্যয়বাহুল্যের দিকেই অগ্রসর হয়েছি। এর ফল হিসেবে এখন অতি প্রয়োজনীয় পূর্বাভাস ও সতর্কতামূলক অবকাঠামোও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের নৌপথে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী যেভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে চলাচল করে, সেটা সভ্যতার জন্য পরিহাসই বিবেচিত হবে। আমরা চাই, বিলম্বে হলেও সরকার নৌ দুর্ঘটনা রোধে তৎপর হোক। যাতে করে সরাইলের লঞ্চ দুর্ঘটনাটিই নৌপথের বেদনাগাথার শেষ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।
No comments